চীনের বসন্ত উত্সব

0
618

খ্রীষ্টানদের বড় দিনের মতো বসন্ত উত্সব চীনাদের পক্ষে বছরের সবচেয়ে বড় উত্সব । যুগ পরিবর্তনের সংগে সংগে বসন্ত উত্সবের বিষয়বস্তুর কিছু পরিবর্তন হয়েছে , নাগরিকদের বসন্ত উত্সব পালনের কায়দারও কিছু পরিবর্তন হয়েছে , কিন্তু চীনা নাগরিকদের জীবনে ও চিন্তাভাবনায় বসন্ত উত্সবের অবস্থানের এখনো পরিবর্তন হয় নি ।

২৪ জানুয়ারি চীনের চান্দ্রপঞ্জিকার শেষ বছরের শেষ দিন। এদিন রাতে বিভিন্ন নতুন প্রযুক্তির হাত ধরে ‘২০২০ সালের বসন্ত উৎসবের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ’আড়ম্বরপূর্ণভাবে দর্শকদের সামনে হাজির হবে। এটা হবে বিশ্বজুড়ে দর্শকদের জন্য বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির মিলন মেলা।

ঐতিহাসিক তথ্য অনুসারে চীনাদের বসন্ত উত্সবের ইতিহাস চার হাজার বছরেরও বেশী দীর্ঘ । তবে তখন এই উত্সবের নাম বসন্ত উত্সব ছিল না , উত্সবের দিনতারিখও স্থির করা হয় নি । খৃষ্টপূর্ব দু হাজার এক শ’ সালের সময় তখনকার অধিবাসীরা বৃহষ্পতিগ্রহের একবার প্রদক্ষিণের সময়কে এক সুই বলে অভিহিত করতেন , সেই সময় বসন্ত উত্সবের নাম ছিল সুই । খৃষ্টপূর্ব এক হাজার সালের কাছাকাছি সময় তখনকার অধিবাসীরা বসন্ত উত্সবকে চীনা ভাষায় ‘ নিয়েন ’ বলে ডাকতেন । ‘ নিয়েন ’ অর্থ বছর , তবে তখনকার বছরের অর্থ ছিল সুফসল । যে বছর খাদ্যশস্যের ভালো ফলন হয়েছে , সেই বছরকে ফসলের নিয়েন বলা হতো , যে বছর খুব ভালো ফসন হয়েছে , সেই বছরকে ভালো ফসলের নিয়েন বলা হতো ।

চীনের ঐতিহ্যিক রীতিনীতি অনুসারে চীনের বসন্ত উত্সব চীনের চান্দ্রবর্ষের শেষ মাসের ২৩ তমো দিন থেকে নতুন বছরের প্রথম মাসের ১৫তমো দিন অর্থাত্ লন্ঠন উত্সব পর্যন্ত স্থায়ী হয় , বসন্ত উত্সব উদযাপনের সময় প্রায় তিন সপ্তাহ । এই সময়পর্বে বসন্ত উত্সবের আগের দিন অর্থাত পুরনো বছরের শেষ দিন ও নতুন বছরের প্রথম দিন অর্থাত বসন্ত উত্সবের প্রথম দিন হচ্ছে বসন্ত উত্সবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুই দিন ।

বসন্ত উত্সবকে স্বাগত জানানোর জন্য চীনের শহরাঞ্চল ও পল্লী অঞ্চলের অধিবাসীরা নানা ধরনের প্রস্তুতিমূলক কাজ করেন । চীনের পল্লী অঞ্চলে প্রস্তুতির কাজ বছরের শেষ মাসের প্রথম দিক থেকেই শুরু হয় । কৃষকরা বাড়ীঘর পরিষ্কার করেন , লেপতোষক ধুয়ে পরিষ্কার করেন , বাজার থেকে বসন্ত উত্সবের খাওয়া ও মেহমানকে খাওয়ানোর খাদ্যদ্রব্য কিনেন , যেমন মিষ্টিজাতীয় খাদ্য , কেক , ফলমুল , মাছ-মাংস ইত্যাদি । বড় বড় শহরে উত্সবের প্রস্তুতিও উত্সবের অনেক দিন আগে থেকে শুরু হয় । সাংস্কৃতিক বিভাগগুলো ও বিভিন্ন শিল্পী দল উত্সবকালের সাংস্কৃতিক কর্মসূচী তৈরীর কাজে ব্যস্ত, টেলিভিশন কেন্দ্র বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নেয় , বিভিন্ন পার্কে নানা ধরনের মেলা আয়োজনের প্রস্তুতি নেয় আর বিভাগীয় দোকানগুলো নাগরিকদের চাহিদা মেটানোর জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে তথা বিদেশ থেকে পন্যদ্রব্য জোগাড় করার প্রচেষ্টা করে । একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে , বসন্ত উত্সবকালে চীনাদের কেনাকাটা তাদের গোটা বছরের কেনাকাটার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশী ।

চীন একটি বড় দেশ , কাজেই বিভিন্ন জায়গায় বসন্ত উত্সব উদযাপনের রীতিনীতি ভিন্ন । তবে বসন্ত উত্সবের আগের দিন রাত্রে অর্থাত্ পুরনো বছরের শেষ দিন রাত্রে পরিবারের সবাই এক সংগে মিলে বছরের শেষ খাওয়া সম্পন্ন করার প্রথা সমগ্র দেশে প্রায় একই । দক্ষিণ চীনে বছরের শেষ খাবারের টেবিলে দশ-বারোটি তরিতরকারী আছে , এগুলোর মধ্যে টোফু অর্থাত্ সয়াবীনের দই ও মাছ থাকতে হবে । কারণ এই দুটি খাবারের চীনা উচ্চারণের সংগে ঠিক সমৃদ্ধির চীনা শব্দের উচ্চারণের অনেক মিল আছে । এতে নতুন বছরে চীনাদের আশা-আকাংখা প্রতিফলিত হয়েছে । উত্তর চীনে বছরের শেষ খাবারের টেবিলে চিয়াও চি নামক এক খাবার অবশ্যই থাকতে হবে । সেদিন সন্ধ্যায় পরিবারের সবাই এক সংগে মিলে চিয়াও চি তৈরী করেন । চিয়াউ চি চীনের এক জনপ্রিয় খাবার , চিয়াও চি মাংসের পুর দেয়া এক কুলী পিঠে , বছরের শেষ রাতে পরিবারের সকল সদস্য মিলিতভাবে চিয়াও চি তৈরী করে ফুটন্ত পানির মধ্যে সেদ্ধ করে ভিনেগা ও অন্যান্য মশলার সংগে খান ।

বছরের শেষ রাতে সারারাত জেগে কাটানোও বসন্ত উত্সবের এক রেওয়াজ । সেই রাতে লোকেরা নাচগান ও গল্প করার মধ্য দিয়ে বছরের শেষ রাত কাটান । অতীতে বছরের শেষ রাতে নতুন বর্ষকে স্বাগত জানানোর জন্য নাগরিকরা পটকাবাজি ফাটাতেন , নিরাপত্তা ও পরিবেশ দুষনের কারণে পেইচিংসহ চীনের কিছু বড় শহরে পটকাবাজি ফাটানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে । বসন্ত উত্সবের প্রথম দিন অর্থাত চান্দ্র বর্ষের প্রথম দিন সকালে পরিবারের সবাই নতুন জামা-পোশাক পরে মেহমানদের স্বাগত জানান অথবা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাতে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের বাড়ীতে যান । সেদিন সবাই পরস্পরের সংগে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন এবং চা , বাদাম ও মিষ্টি খেয়ে গল্প করেন । চীনে এরকম রেওয়াজও আছে যে গত এক বছরে যদি আত্মীয় বা বন্ধুবান্ধবের মধ্যে ঝগড়া বা গন্ডগোল হয় , বসন্ত উত্সবের সময় এক পক্ষ আরেক পক্ষের বাড়িতে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাতে গেলে দুজনের বিরোধ মিটে গেছে বলে মনে করা হয় ।

বসন্ত উত্সবের কর্মসুচী বৈচিত্র্যময় । স্থানীয় অপেরা ও চলচ্চিত্র অনুষ্ঠান , সিংহনাচ , বিভিন্ন ধরনের মেলা ইত্যাদি কর্মসুচীর কল্যানে সর্বত্রই উত্সবের আনন্দমুখর পরিবেশ বিরাজ করে । অবশ্য বেশীর ভাগ লোক বাড়িতে বসে টেলিভিশন কেন্দ্রের বসন্ত উত্সব উপলক্ষে তৈরী বিশেষ অনুষ্ঠান উপভোগ করেন ।

বসন্ত উত্সব চলাকালে বাড়ীর প্রবেশদ্বারে দ্বি-চরণ শ্লোক ও নতুন বছরের দেওয়াল চিত্র এঁটে দেয়া আর বাড়ীর ফটকে অথবা সদর দরজায় নানা ধরনের চীনা লন্ঠন ঝুলানোও বসন্ত উত্সবের এক রেওয়াজ । বসন্ত উত্সবের আগে বাজারে প্রচুর দেওয়াল চিত্র ও দ্বি-চরণ শ্লোক পাওয়া যায় , নাগরিকদের সুখী জীবনের ছবি , সুন্দর ফুল ও মনোরম দৃশ্যের চিত্র অত্যন্ত জনপ্রিয় । বসন্ত উত্সবের লন্ঠন প্রদর্শনীও দেখার মতো , চীনা লন্ঠন চীনের এক ঐতিহ্যিক শিল্পকর্ম , সেগুলোর কোনোটার আকার খরগোসের মতো , কোনোটা ছাগলের মতো , কোনোটা টেলিভিশন কার্টুনের কোনো জনপ্রিয় চরিত্রের আকার ।

জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের সংগে সংগে চীনাদের বসন্ত উত্সব উদযাপনের উপায়ের পরিবর্তন হচ্ছে , এখন পর্যটনে যাওয়া চীনাদের বসন্ত উত্সবের ছুটি কাটানোর এক নতুন বিকল্প হয়েছে ।