করোনা মোকাবিলায় হোম কোয়ারেন্টাইন নিয়ে বিশৃঙ্খলা-প্রস্তুতিহীনতার দায় কার !

0
577
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও স্থানীয়ভাবে নভেল করোনা ভাইরাস ছড়াতে শুরু করেছে। হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে না পারলে এ রোগের বিস্তার ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে।যা ইতির্পূবে চীন, WHO-সহ বিশেষজ্ঞরা সর্তক করেছিলেন । করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকানোর সবচেয়ে ভাল উপায় কোয়ারান্টিন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা৷ কতটুকু প্রস্তুত বাংলাদেশ !
করোনা ভাইরাস চীন থেকে দক্ষিণ কোরিয়া ,ইরান, জাপান, ইটালিতে ছড়িয়ে বাড়তে থাকলো আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। সরকারের মন্ত্রীদের কাজ ও কথায় মানুষ বুঝতে পারলো যে, বাংলাদেশ নিরাপদ। বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের সমস্যা নেই।আক্রান্ত দেশগুলোতে থাকা প্রবাসীরা দেশে ফিরে আসতে শুরু করলো । অবশ্য সঠিক তথ্য জানানো হলে নিশ্চয়ই অনেক প্রবাসী দেশে ফিরতো না।
হোম কোয়ারেন্টাইন সঠিকভাবে হচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ঠ অনেকে মনে করেন । হোম কোয়ারেন্টাইন নিয়ে সরকারের অনুরোধ, গণবিজ্ঞপ্তি জারি, জরিমানা—এসব কিছুই এখনও বিদেশ ফেরতদের হোম কোয়ারেন্টাইনে নিতে পারছে না। অনেকের মতে উপযুক্ত পরিবেশ না ধাকায় কোয়ারেন্টাইনে নেওয়া সফল হচ্ছে না।
কোভিড-১৯ সংক্রমণের পর থেকে বাংলাদেশ আড়াই মাসের মতো সময় পেয়েছে । এরপরও, প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন করার মতো সম্ভব হ্যয়নি ।এতদিনেও কেন কোনও প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন করার মতো ব্যবস্থা করতে পারলো না—এমনপ্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রী বলেন, ‘ সব ব্যবস্থা হয়েছে । হোম কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থাও হয়েছে। গত দুই মাস ধরে আমরা হোম কোয়ারেন্টাইনের যে ব্যবস্থা নিয়েছি, সেটা কোনও দেশই নেয়নি। সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক উত্তর দেননি।
বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস ঠেকাতে প্রথম কোয়ারান্টিন উদ্যোগ নেয়া হয় ফেব্রুয়ারি মাসে ৷ চীনের উহান থেকে ৩১২জনকে এনে রাখা হয় আশকোনা হজ ক্যাম্পে৷ কিছু অব্যবস্থাপনার অভিযোগ উঠলেও ১৪ দিন পর প্রবাসীরা সুস্থ অবস্থায় বাড়ি ফিরেন৷
এরপর মার্চ মাসের ১৪ তারিখ ১৪২ জন আসে ইটালি থেকে । তাদেরকেও বিমানবন্দর থেকে নিয়ে যাওয়া হয় আশকোনা হজ্ব ক্যাম্পে৷ কিন্তু অব্যবস্থাপনার কারণে সেখানে থাকতে রাজি হননি তারা৷ এক পর্যায়ে পিছু হটে কর্তৃপক্ষ৷ তাদেরকে সেই দিনই বাড়িতে যেতে দেয়া হয়৷
ইটালি ফেরতরা হজ ক্যাম্পে না থাকতে চাওয়ায় পরের দিন ক্ষোভ প্রকাশ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন৷ তিনি বলেন, ‘‘তারা দেশে আসলে সবাই নবাবজাদা হয়ে যান৷ ফাইভ স্টার হোটেল না হলে অপছন্দ করেন৷ আমাদেরতো একটা দৈন্য আছে৷ এটাতো একটা বিশেষ অবস্থা৷’’ তার এই মন্তব্যের পক্ষে বিপক্ষে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা হয়৷
গত ৫ মার্চ ইতালি থেকে দেশে ফেরেন চট্টগ্রামে । বিমানবন্দর থেকে তিনি সরাসরি আসেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। সাজেক যাওয়ার জন্য সঙ্গে করে নিয়ে আসেন আরও কয়েকজনকে। বেশ কিছুদিন তারা ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আবদুর রব হলের একটি কক্ষে। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে সোমবার (১৬ মার্চ) বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রসহ ছয়জনকেই চট্টগ্রামের ফৌজদারহাট আইসোলেশন সেন্টারে পাঠানো হয়েছে।
বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের অনেকে কোয়ারান্টিন এড়ানোর জন্য পালিয়ে যান৷ এজন্য বেশ কয়েকজনকে জরিমানা করা হয়৷ মানিকগঞ্জে অষ্ট্রেলিয়া ফেরত একজনকে ১৫ হাজার টাকা, শরিয়তপুরে ইটালি ফেরত একজনকে ৫০ হাজার টাকা এবং টাঙ্গাইলে সিঙ্গাপুর ফেরত একজনকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে প্রশাসন৷
হবিগঞ্জে ফ্রান্স থেকে ফিরে একজন কোয়ারান্টিনে না গিয়ে বিয়েও করেছেন৷ পরে পুলিশ খবর পেয়ে দম্পতিকে কোয়ারান্টিনে পাঠিয়েছে৷ বৌভাতের অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে৷ জার্মানি ফেরত ঢাকার আরেক প্রবাসীরও বিয়ে আটকে দেয় প্রশাসন৷ তাকে পাঠানো হয় হোম কোয়ারান্টিনে৷
দিনাজপুরের পার্বতীপুরে বিদেশ থেকে আসার পর ‘হোম কোয়ারান্টিনে’ রাখা এক তরুণকে পুলিশ খুঁজে পাচ্ছে না বলে ১৯ মার্চ প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে৷ স্বাস্থ্য বিভাগের লোকজন দুদিন ধরে তাকে খুঁজছে৷ ১৩ মার্চ তিনি আসেন সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে৷
বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের অনেকে হোম কোয়ারান্টিনে যাননি৷ কেউ কেউ দেশে আসার সময় শরীরে তাপ কমাতে উড়োজাহাজে প্যারসিটামল জাতীয় ট্যাবলেট খান বলেও কোয়ারান্টিনে যাওয়া যাত্রীরা জানিয়েছেন৷ তারা ওই ট্যাবলেট খান যাতে বিমানবন্দরে চেকের সময় তাদের শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকে৷
প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে সবার দাবির মুখে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে সরকার৷ কিন্তু ছুটি পেয়ে হোম কোয়ারান্টিনে থাকার পরিবর্তে পরিবার নিয়ে অনেকেই ঘুরতে গেছেন বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে৷ যা ঠেকাতে বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয় প্রশাসন পর্যটন স্থানগুলো বন্ধ ঘোষণা করেছে৷
হোম কোয়ারেন্টাইনের গুরুত্বই  বোঝেন না অনেকে। কিন্তু এটা সাংঘাতিক রকমের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে কোয়ারেন্টাইন ঠিকমতো না হলে পুরো দেশ ঝুঁকিতে পড়বে। যারা বিদেশ থেকে এসেছেন, তারা বাড়ি চলে গিয়ে অবলিলায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
তাদের বেলায় কেবল স্পর্শ না সংশ্রব-ই যথেষ্ট মন্তব্য করে তিনি বলেন, সংস্পর্শে কেউ আসতে পারবে না, তার ব্যবহৃত জিনিসপত্র কেউ ব্যবহার করতে পারবে না, সেগুলো বাইরেও যাবে না, কিন্তু সেটা কতটুকু সম্ভব।
বাংলাদেশের কালচারে হোম কোয়ারেন্টাইন আসলেই কাজ করবে বলে মনে হয় কিনা প্রশ্ন আছে । অনেকের মতে কৌশল হিসেবে এটা ঠিক কৌশল ছিল কিনা সে নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। কোয়ারেন্টাইন সবসময় ‘ইনফোর্সড’ হয়, হোম কোয়ারেন্টাইন বাংলাদেশে কখনও কাজ করবে না। কাজ যে করছে না সেটা এখন প্রমাণ হয়ে গেছে। বাসায় থেকে কোনোদিন কোয়ারেন্টাইন হবে না বাংলাদেশে।তবে এটাও ঠিক হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে না পারলে এ রোগের বিস্তার ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে। আমাদেরকে অবশ্যই প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে যেতে হবে। আইন না মানাটাই আমাদের স্বভাব ।
নভেল করোনা ভাইরাসে (কোভিড-১৯) এখন পর্যন্ত মোট আক্রান্ত হয়েছেন ১৭ জন, আক্রান্তদের বেশিরভাগই বিদেশ থেকে আসা আত্মীয়ের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়েছেন। এমনকি যিনি মারা গেছেন তিনিও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা তার মেয়ের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়েছিলেন বলে জানিয়েছে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। এদিকে, স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় হোম কোয়ারেন্টিনে রয়েছেন দুই হাজার ৬৯৮ জন, আর গত ২১ জানুয়ারি থেকে হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন মোট ৯ হাজার ১৩ জন।

ঝুঁকির কথা স্বীকার করেছেন জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। তিনি বলেন, হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে না পারলে এ রোগের বিস্তার ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে। কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধ করার মূল কৌশল হলো—দ্রুত রোগীকে শনাক্ত করে তাকে সবার থেকে আলাদা করে ফেলা। তবে রোগের উপসর্গ নিয়ে বাড়িতে বসে থাকলে করোনা রোগী শনাক্ত করা সম্ভব হবে না বলেও জানান তিনি।দেরী হলেও, পৃথিবী এখন প্রায় অবরুদ্ধ । সরকার আপ্রান চেষ্টা করছে, তবে সকলের সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন ।