কানাডায় কোয়ারেন্টাইনরত মায়ের কাছে সন্তানের হৃদয়স্পর্শী চিঠি

0
872

নাজনীন নাহারের ছেলের বয়স ১৯ । কানাডার ভ্যানকুভারে পড়া-লেখা করে সে । সে এখন এই করোনা ভাইরাসের লকডাউনের মধ্যে বাসায় কোয়ারেন্টাইনে আছে। ছেলে ভ্যানকুভার থেকে মাকে ইংরেজীতে একটা চিঠি লিখেছে।ফেসবুক থেকে নেওয়া ‍চিঠিটি হুবুহু দেওয়া হল।

মাগো মা, আমার ভালো লাগে না। আমি দেশে যাবো। মা আমি তোমার কাছে যাবো। তোমাকে খুব ছুঁতে ইচ্ছে করছে।খুব দেখতে ইচ্ছে করছে তোমাকে। কী ভীষণ একাকীত্ব মা আমার। কী ভীষণ একা আমি মা। জন্ম শৈশব পেড়িয়ে আসা কোলাহলের শহরটায় খুব ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে। আমার চারপাশে ভয়ঙ্কর এক নীরবতা। তেমন শীত না থাকা শহরটায় যেন আরও গড়িয়ে পড়ছে হীম বরফ। মৃত্যুর হাতছানি আমার আশেপাশে বেশ জোরালো। ওঁৎ পেতে অপেক্ষা করছে মৃত্যু তার নিয়মের ব্যাস্ততায়। এমনিতেই কানাডার ভেনকুভারের বৃটিশ কলম্বিয়া শহরে সুনসান নিস্তব্ধতা প্রায় সর্বকালের। পাহাড়ের গা বেয়ে রাস্তা আর বাড়িঘর। বেশ দূরত্বে দূরত্বে অবস্থান বসতিস্থলের। সমুদ্র আর পাহাড়ে ঘেরা চমৎকার সুন্দর এ শহর। যেটুকুও মানুষের চলাচল ছিলো এ শহরে। পৃথিবীতে মৃত্যু পরোয়ানা জারি হবার পর থেকে গা শিউরে ওঠা নির্জনতা এখন সর্বত্র। শুধু গ্রোসারি শপের সামনে কেবল মানুষের কিছুটা গন্ধ পাওয়া যায়। তাও কারও সাথে কারও কথা নেই। শব্দ নেই, কোলাহল নেই। অবশ্য চেনা মানুষগুলোও চেনার উপায় নেই কারণ যেভাবে মাস্ক পরে সবাই সতর্ক। খুব খেয়াল করলে বোঝা যায় এই নিরাপদ শহরের মানুষগুলোর চোখ আজ মৃত্যু ভয়ে কেমন বিবর্ণ হয়ে আছে সব সময়ের চাইতে আজকাল তোমাকে বেশি বেশি মনে পড়ছে মা। তোমাদের নিয়েও আমার ভয় করে। কী অদ্ভুত তাই না মা। পৃথিবীতে এখন কোথাও কোন নিরাপদ শহর গ্রাম লোকালয় নেই। অথচ তুমি সবসময় চাইতে আমার ভবিষ্যতটা নিরাপদ হোক। নিরাপদ শহরে হোক আমার বসবাস। আমিও তাই চাইতাম। অথচ আজ! কতটা অনিরাপদ আমাদের পৃথিবী। আমাদের পৃথিবীর বিশস্ত নিঃশ্বাস গুলো। কী ভয়ঙ্কর তাই না মা!

বাবা কি এখনও বাইরে যায়? বাবাকে বলো ঘরে থাকতে। সাবধানে থাকতে। বাবাকেও খুব দেখতে ইচ্ছে করে মা। সারাটা জীবন আমার সাথে ভয় দেখানো শাসনের দূরত্বে থাকা বাবাকেও আমি যথেষ্ট ভালোবাসি জানো। খুব কষ্ট হয় এই ভেবেও যে, আমার জন্য বাবার এতো কষ্টের উপার্জনের ইনভেস্টমেন্ট বুঝি বৃথাই যাবে। আমি যদি আর বেঁচে না ফিরি।তোমাদের জন্য কিছুই তো করে যেতে পারলাম না মা। কেমন অদ্ভুত এক ব্যর্থতা নিয়েই চলে যেতে হবে আমায়।চলে যেতে হবে তোমাদের আদরের স্পর্শ ছাড়াই। মাঝে মাঝে একেবারেই ঘুমাতে পারি না মা। আমি যদি সত্যি অসুস্থ হয়ে পড়ি। কে দেখবে আমাকে? কে আমার মাথায় হাত বুলাবে? কে আমাকে চুমু খাবে মা? কে আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বলবে সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ বাবা। কে বলবে, এইতো মা আছে তোমার কাছে।

মাগো আমি কী হেরে যাচ্ছি। আমি কী হেরে যাবো মা। তুমি সবসময় বলো সাবধানে থেকো। আমি তো এই শহরে একা। আমাকেই দেখতে হয় নিজেকে। আমার খাওয়ার ব্যাবস্থা আমাকেই করতে হয়। আমাকে তো কম হলেও বাইরে বেড়োতে হয়। বাসা থেকে একটা স্টেশন দূরত্বে আমাদের গ্রোসারি শপ। বাসে করে গিয়ে বিশাল বড়ো লাইনে দাঁড়িয়ে থাকি। কখনও কখনও শপে ঢোকার সুযোগ পাওয়ার পরে দেখি আমার প্রয়োজনীয় যথেষ্ট খাবার নেই শপে। আবারও অন্য বেলায় আসতে হয়। আবার খাবার পেলেও অনেক খাবার একসাথে এনে রাখবো কোথায়? আমারা তো ফ্লাটের কয়েকজন মিলে একটা ফ্রীজ ব্যাবহার করি। তোমাকে সেভাবে কিছু বলি না তুমি আরও মন খারাপ করবে। শত হোক তোমার ছেলেটাতো তোমার থেকে অনেক দূরে। যেমন আমার থেকে আমার মা টা। কী অদ্ভুত তাই না মা! আমরা এখন মানুষ ভয় পাই। মানুষ থেকে পালাই। কাউকে ধরা যাবে না ছোঁয়া যাবে না।

ক্যাম্পাস বন্ধ। ভালো খবর হলো এর মধ্যে অনলাইনে সেমিস্টার ফাইনাল দিচ্ছি। এই রকম মানসিক চাপের মধ্যে লেখাপড়া ও পরীক্ষা! হায়রে জীবন! বাঁচো আর মরো নিয়মের সূচীপত্র চলমানই থাকবে তার কেমিস্ট্রিতে। আমিও চেষ্টা করছি সেই নিয়ত সূচীপত্রের সাথে তাল রেখে চলতে। আসলে কখনও কখনও মৃত্যু ভয়কে হার মানিয়ে দেয় জীবনের পরাবাস্তবতা। যেমন আমাদের দেশে সরকারি নিষেধাজ্ঞার মধ্যে ক্ষুধার্ত পেটে রিকশা চালাতে বের হয়ে কান ধরে উঠবস করতে হয় শাস্তি হিসেবে একজন বৃদ্ধকে। জীবন বুঝি আমাদের বেশির ভাগ মানুষের একই সমান্তরালে চলে! পোশাকটা যা একটু ভিন্ন। আমার আগামী সেমিস্টারও অনলাইনেই ক্লাস হবার সম্ভাবনা আছে। যদি বেঁচে থাকি মা। এখন তো বাঁচাটাই মূখ্য আমাদের। অথচ মৃত্যুর স্বাদ নেয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত জীবনের প্রার্থনায়ই আমাদের নিমগ্ন থাকতে হয়।কী অদ্ভুত বিস্ময় জীবনের তাই না মা!

তবুও সময় কাটে না মা।সময় গুলোও যেন আগের চেয়ে বেশ ভারি হয়ে গেছে আজকাল।কারণে অকারণে তোমাকেই খুব দেখতে ইচ্ছে করে।অর্থহীন ইচ্ছেতে ছুঁয়ে থাকতে ইচ্ছে করে তোমাকেই। এখানে এখন কোন বন্ধুকেও ছোঁয়া যায় না।আচ্ছা মা, কাছে থাকলে তুমিও কি আমাকে ছুঁতে দিতে না তোমাকে?আমার মাঝে মাঝে খুব দম বন্ধ হয়ে আসে মা। পৃথিবীর তাবৎ জ্ঞান বিজ্ঞান গবেষণা সব আজ থমকে গেলো মা।ওইটুকুন করোনা নামক অণুজীবের কাছে! কী ভয়ার্ত বিস্ময় !

এলোমেলো ভাবনা পোড়ায় আমায়। বর্তমান অসহায়ত্বের কারণেই পোড়ায় জানি। মনে হয় কেন এতো কষ্ট করে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি, গনিত পড়লাম শিখলাম? কি শিখলাম মা? সব তো ফেইল এখন। বড়ো বড়ো সায়েন্টিস্ট বধির হয়ে আছে প্রকৃতির একমাত্র করোনা বিস্ফোরণে!

কেন যেন ছোটবেলার কথা খুব মনে পড়ছে মা। কত কষ্ট করেছ তুমি আমাকে নিয়ে। সব মায়েরাই করেছে। ভোর সারে পাঁচটায় উঠিয়ে তৈরি করে স্কুলে নিয়ে গেছ। সাতটার মধ্যে স্কুলে ঢুকতাম জ্যামের ভয়ে। তোমার কাছে শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে যে, মাত্র তিন বছর তিন মাস বয়সে ক্লাস শুরু করেছিলাম আমি। ক্লাসের সব থেকে বয়সে ছোট ছিলাম আমি। আমায় স্কুলে নামিয়ে তুমি কতদিন স্কুলের সামনে ফুটপাতে বসে থেকেছ। তুমি কত কষ্ট করেছ, আমাকে কষ্ট করিয়েছ মা। শুধুমাত্র আমাকে লেখাপড়া শিখতে হবে বলে। আমাকে অনেক বড়ো মানুষ হতে হবে বলে।আমি আজ তাই এই দূর দেশে বড়ো হতে এসে। বড়ো বেশি একা হয়ে গেলাম মা। আমি আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ আমার মা’কে ছাড়া হলাম পৃথিবীর এই ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের দিনে। কেন মা? কিভাবে এই আতঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসবো বলো মা?

এখন এই একটা অণুজীবের কাছে আমি যদি হেরে যাই মা। আর যদি কোনদিন আমাদের দেখা না হয়। আমি ভাবতে পারি না। আমিও খুব বিষণ্ন হই আতঙ্কিত হই মা। আতঙ্কিত হই এই ভেবে যে,আমি চলে গেলে তোমার যেমন কষ্ট হবে। তুমি চলে গেলে আমার যেমন কষ্ট হবে। তেমন কষ্ট তো ওই মায়েরও হচ্ছে বলো, যার ছেলেটা মেয়েটা আজ এই মুহূর্তে মারা গেলো। যার মা আজই মারা গেলো। অসময়ে কেন আমরা পরাজিত হচ্ছি। কেন আমরা পরাজিত হলাম মা। জানো মা অনেকেই বলে পাপ। বলে শাস্তি। আচ্ছা মা যে শিশুটির পাপের বয়স হয়নি তার শাস্তিটা কি জন্মপাপ মা? কে দিবে এর জবাব আজ?

গত রাতে চারটার সময় আমার ফ্লাটমেটের হাউমাউ কান্নায় আমি দৌড়ে তার রুমে গেলাম। কেমন উদভ্রান্তের মতো সে কাঁদছে। আমার চেয়ে না হলেও বছর পাঁচেকের বড়ো সেই ভাইয়াটা। তবুও সে আমাকে পাগলের মতো আঁকড়ে ধরে শিশুর মতো কাদঁছিলো।সে ভয়ঙ্কর এক স্বপ্ন দেখেছে। সারা শরীর অদ্ভুত পোশাকে আবৃত কতগুলো লোক না-কি তাঁকে মোটা পলিথিনে পেঁচিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কবরের কাছে। সে মরতে চায় না বলে সেই কি আর্তনাদ!

বাকি রাতটুকু আমরা আর ঘুমাইনি। জানো মা আমি তখন তোমার মতো সাহসী হয়ে গিয়েছিলাম। ঘরের আলোগুলো জ্বেলে তাকে খুব শক্ত করে বুকের মধ্যে জাপটে ধরে রাখলাম। সাহস দিলাম। তখনও খুব তোমার কথাই মনে পড়ছিলো।
তুমি যে খুব করে চাও মা। তোমার ছেলে ইনশাআল্লাহ অনেক বড়ো হবে। সত্যি মা তখন মনে হলো আমি বুঝি একটুখানি বড়ো হয়েছি। ওই ভাইয়াকে আমিই গ্রোসারি শপ থেকে খাবার এনে দেই এখন। যতটা পারি তাকে সাপোর্ট দিচ্ছি আলহামদুলিল্লাহ।

মাগো তবুও আমার তোমাকে ছাড়া একা একা খুব কান্না পায়। তোমাকে বিশেষ থ্যানক্স মা তুমি আমাকে কখনও কাঁদলে বাঁধা দিয়ে বলনি, ছেলেদের কাঁদতে নেই। ছেলেদেরও কাঁদতে হয় মা। কাঁদলে বুকটা হালকা লাগে মাঝে মাঝে। আমাকে শুধু ছেলে না তুমি মানুষ হতে শিখিয়েছ। তাইতো নিজের জন্য সকলের জন্যও কাঁদতে যেমন পারি তেমনি সাপোর্ট দিতেও পারি।

তবুও একাকীত্ব, গুমোট পরিস্থিতি, পৃথিবীর মৃত্যুযজ্ঞ আমাকে মাঝে মাঝে অসহায় করে তোলে। খুব তোমার কাছে যেতে ইচ্ছে করে। কি অদ্ভুত বাস্তবতা! এখন না আমি তোমার কাছে যেতে পারছি। না তুমি আসতে পারছো আমার কাছে। মুহূর্তে আমাদের সৃষ্টিকর্তা আমাদের সকল ক্ষমতাকে কেমন তুচ্ছ আর অসহায় বানিয়ে দিলো। এখন আমরা সৃষ্টির স্রেষ্ট হয়েও মৃত্যুর জন্য পিপড়াদের মিছিলে শামিল।

পৃথিবীর যেখানেই তুমি থাকো আর যেখানেই আমি থাকি মা। আমরা এখনও বেঁচে আছি আলহামদুলিল্লাহ। এটাও পৃথিবীর বড়ো বিস্ময়। আল্লাহর অনেক বড়ো নেয়ামত। তাই নিজের খেয়াল রেখো। তুমি ছাড়া আমার পৃথিবীটা আমি ভাবতে পারি না মা। তুমি আমার খুব সাহসী মা। আমি জানি। আমিও তোমারই ছেলে। আমিও সাহসী হচ্ছি। আরও হবো ইনশাআল্লাহ।

মা তুমি খুব সহসের সাথে বলো, তুমি মৃত্যুকে সেভাবে ভয় পাও না। নির্ধারিত নিয়তিকে তুমি সহজে মেনে নিতে পারো। তোমার সকলের প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য প্রায় শেষ। শোনো মা আমি সাহসী হলেও মৃত্যুকে ভয় পাই।আমি একাকীত্ব ভয় পাই। আমি তোমাকে ছাড়া বেঁচে থাকতেও ভয় পাই। তাই আমার জন্য তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে মা। তোমাকে সুস্থ থাকতে হবে। আর রোজ রোজ আমাকে ফোনে কথা বলে, মেসেজ লিখে সাহস দিতে হবে। আমার জন্য আর পৃথিবীর সকলের জন্য দোয়া করতে হবে। মনে থাকবে তো!

এবার এসো তো মা। আমাকে ফোনের ওই পাশ থেকেই এবার খুব করে তোমার বুকের মধ্যে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখো। আমিও তোমাকে ধরে রাখি মা। অনেক ভালোবাসি মা তোমায়।

আমার মা ও পৃথিবীর সব মা ভালো থেকো। সব মা’কে ভালো রেখো আল্লাহ।

৩১.০৩.২০২০

# সন্তানের চিঠি
# অনুবাদ ও অলঙ্করণঃ নাজনীন নাহার