শিক্ষা নিয়ে শিক্ষক ভাবনা

0
545

বিশেষ রচনা: দখিনা-৩৯

শিক্ষা নিয়ে শিক্ষক ভাবনা

মাসউদুর রহমান

পেশায় আমি শিক্ষক। পেশার খাতিরেই স্কুলের বার্ষিক সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছাত্র ছাত্রীদের দিয়ে একটি ছোট্ট নাটক করিয়েছিলাম। যথারীতি অনুষ্ঠানের পরদিন থেকে নিয়মমাফিক ক্লাস শুরু হল। আমি আমার ডেস্কে বসে কাজ করছি, হঠাৎ আমার ক্লাস সেভেন পড়–য়া এক ছাত্রী এসে মুখ গোমড়া করে বলল, “স্যার আমরা কি আর কখনো নাটক করতে পারব না?” তার দিকে তাকিয়ে  একটা মুচকি হাসি দিয়ে চুপ করে থাকা ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না। বললাম, “ওয়েট এন্ড সি, এখন ক্লাসে যাও।” মজা লাগলো সে কত সুন্দরভাবে তার ভবিষ্যতের হিসাবটা দেখে ফেলেছে। আগামী বছর অবশ্যই বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। সেখানে নাটকও হবে। কিন্তু আগামী বছর সে উঠবে ক্লাস এইটে। জেএসসি পরীক্ষা। স্কুলের এডুকেশন পলিসি মোতাবেক পিইসিই, জেএসসি এবং এসএসসি পরীক্ষার্থীদের কোন ধরণের এক্সট্রা কারিকুলাম কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে দেয়া হবে না। আমার ছাত্রীটি সেটা জানে। তাই সে বুঝে নিয়েছে আগামীতে সে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। যদিও তার অভিনয় দক্ষতা খোদা প্রদত্ত। তার পরের বছর সে ক্লাস নাইনে উঠবে। এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি তো তখন থেকেই নিতে হবে। অতএব নাটক তোমায় খোদা হাফেজ। এই জায়গায় এসে একজন শিক্ষক হিসেবে নিজেকে ভালো রকমের অপরাধী মনে হল।

একজন ব্যক্তির নিজস্ব একটা খোদা প্রদত্ত দক্ষতা আছে, কিন্তু ভাল ফলাফল, ভালো মার্ক্স, জিপিএর ওজনদার বাটখারার নিচে তাকে আমরা পিষে দিচ্ছি। তারপর প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত তিন তিনটা সরকারী পরীক্ষা-বাবা মায়েরা আগেও যদি ভাবতেন আমার বাচ্চাটা একটা ভালো গান গাক, ভালো ছবি আঁকুক, সুন্দর আবৃত্তি করুক, ভিন্ন কিছু একটা করুক-এখন সেই ভিন্ন কিছু করার চাইতে তারা সন্তানকে আরেকজন প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়ানোটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। বর্তমানে শিক্ষার গোটা চিত্রটাই এমন। রাষ্ট্র চাচ্ছে যে কোন উপায়ে পাশের হার বাড়াতে, স্কুল কর্তৃপক্ষ চাচ্ছে এ প্লাসের সংখ্যা বাড়াতে আর অভিভাকরা চাচ্ছেন তাদের বাচ্চা একশতে একশ পাচ্ছে কিনা। আর এই চাওয়ার ধাক্কায় শিক্ষার্থীর মাথা থেকে ঠেলে বেরিয়ে যাচ্ছে যাবতীয় সৃজনশীলতা। যদিও আমরা মুখে বলি শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য মানুষ হওয়া কিন্তু আমরা স্কুলে এখন কিছু যন্ত্রমানব উৎপাদন করছি মাত্র।

শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য কি? মোটা দাগে বলি আর চিকন দাগে বলি মানুষ হওয়া যা আমাদের মুনী ঋষিরা বলে গেছেন কিন্তু বর্তমানে যেটা চলছে তা থেকে উপলব্ধি হয় মূল উদ্দেশ্য এসে দাঁড়িয়েছে-একদল ‘সুযোগ্য’ কর্মচারী শ্রেণী তৈরি করা। বাবা মা-রা ঠিক করে দিচ্ছেন তাদের সন্তান ব্যাংকার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হবেন এবং ছোটবেলা থেকেই সেই ভাবনা সন্তানের মগজে প্রোহিত করে দিচ্ছেন এবং বালেগ হওয়ার পর সন্তানের নিজ বুঝ ব্যবস্থা তৈরি হওয়ার পরও সে আর এই সীমাবদ্ধ চিন্তার বাইরে যেতে পারে না। ছোটবেলায় যে কাজটা সে ভালো পারতো, হতে পারে গান গাওয়া, ছবি আঁকা এমনকী গল্পের বই পড়া সেই কাজটাকে সচেতনভাবে একপাশে সরিয়ে রেখে একজন ভালো কর্মচারী হওয়ার স্বপ্নকে সত্যি করার প্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগ করে থাকে অহর্নিশ।

স্যার কেন রবিনসনের মতে, শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলিত বর্তমান রূপটির বীজবপন হয়েছিল ১৯ শতকে এবং এটা করা হয়েছিল শিল্প বিপ্লবের প্রয়োজন মেটাতে। শিক্ষার উদ্দেশ্য হয়ে গেছে ভাত-কাপড় নির্ভর। আর যে যত ভালোভাবে এই ব্যবস্থার ভেতর দিয়ে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারবে সে তত ভালোমানের ভাত ও কাপড় পাবে। তামাম ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাকেরা এই ভাত-কাপড়ের পেছনেই ছুটে চলেছেন। আর মনে হয় আমরা বাঙালিরা আরো একটু  বেশিই ছুটছি।

কিন্তু সত্যিকারের কথা হলো এই ব্যবস্থা মানুষের অফুরন্ত সম্ভাবনার কণা মাত্রকেই বিকাশ করছে। ঢেকে ফেলছে মানুষের সামর্থ্যরে বিশাল একটা অংশকে।

শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ মানুষের জীবনের চূড়ান্ত লক্ষণ কী হওয়া উচিত সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সামর্থ্য দান করা। মনীষী আহমদ ছফার মতে, “আগেকার নবী পয়গম্বরেরা মানবজীবনের চরম পরম লক্ষ্য বলতে বুঝতেন পরম সত্ত্বার জ্ঞান। এই কালের মানবজীবনের পরম লক্ষ্য কী? সম্ভবত মানুষের সমস্ত সম্ভাবনা বিকশিত করে তোলাই যদি বলা হয়, আশা করি অন্যায় হবে না।”(আহমদ ছফা, বাঙালী মুসলমানদের মন: শিক্ষার দর্শন)

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের প্রচলিত শিক্ষা কাঠামো আর জনমনে প্রোথিত শিক্ষার লক্ষ্য উদ্দেশ্যের যা রূপ তার সাথে উল্লেখিত শিক্ষার উদ্দেশ্য কতটা সঙ্গতিপূর্ণ। আমার তো মনে হয় একজন অন্যজনকে পিঠ দেখিয়ে চলছে। একজন নিতান্ত শিক্ষক হিসেবে এই পুরো শিক্ষাস্রোতের বিপরীতে দাঁড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে আমার ক্লাসে আমি যখন পাঠ দিতে দাঁড়াই তখন আমিই রাজা। আমার ছাত্র ছাত্রীদেরকে এ ব্যাপারে যতটা বেশি অনুপ্রাণিত করা সম্ভব, যতটা ‘প্ররোচিত’ তাদেরকে করা যায় ততটা করা। বাকী দায়িত্বটুকু দেশজুড়ে আমার যারা সহকর্মী আছেন তারা পালন করলেই হয়ে যাবে।

মাসউদুর রহমান : নাট্য সংগঠক ও সম্পাদক- ঘুলঘুলি

rajonrahman@yahoo.com