আমাদের বহির্বিদ্যালয় আমাদের অন্তর্বিদ্যালয়

0
668

প্রচ্ছদ রচনা

আমাদের বহির্বিদ্যালয় আমাদের অন্তর্বিদ্যালয় : হাফিজ রশিদ খান

আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয় জীবন পারিপার্শ্বিকতার দিক থেকে তেমন আনন্দময় ছিল না। শিক্ষকদের যে-মুখাবয়ব স্মরণ করতে পারি, তা ছিল থমথমে ধরনের। সর্বক্ষণ খিটখিটে মেজাজে তাঁরা ক্লাসের সময়টা পার করতেন। পড়া শিখে না-এলে বা দুষ্টুমির কারণে বেত্রাঘাত, হাতের আওতায় কান টেনে এনে দশাসই খাপ্পড় Ñ এ ছিল তাঁদের শাস্তিদানের নিয়মিত কৌশল। প্রাথমিক স্কুলের ছেলেরা (মেয়েদের আলাদা ব্যবস্থা ছিল) ডানপিটে বা দুরন্ত গোছের হবে, এ তো স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিকতাকে শাসনের ভঙ্গিতে একরৈখিক কর্তৃত্বের উপস্থিতি ছিল পীড়াদায়ক। বহুকাল আগে ওই পর্ব পার হয়ে আসা আমার আজ মনে হয়, আমাদের রাশভারি অভিভাবকেরাও এক্ষেত্রে ছিলেন আসহায়। এক কিসিমের কেজো বা তাৎক্ষণিক ফললাভের আশায় শিশুদের ওইসব বিদ্যালয়ে পাঠাতে বাধ্য ছিলেন তারা। তথাকথিত জীবন গড়ার ওই প্রাথমিক শিক্ষা ও পরবর্তি সময়ের উচ্চতর শিক্ষার্জনের বেলায়ও একই দৃশ্যের পুনরাভিনয় দেখেছি আরেকটু ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে। কড়াকড়ির বদলে তাতে ছিল বেদম শৈথিল্য শিক্ষক ও অভিভাবকমহলের। বস্তুত, একই সঙ্গে কাজের ও অন্তর্জগত দীপায়নের শিক্ষা সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ ছিল তখনও, এখন তো বটেই। বিগত শতাব্দির ষাটের দশকের মধ্যভাগে আমাদের বাল্যকালে এদেশীয় মধ্যবিত্তশ্রেণি ওই সমন্বয়ী শিক্ষার কথা চেতনায় হয়তো লালনে সমর্থ ছিলেন, বাস্তবে যা ফলপ্রসূ করে তোলাটা তাদের পক্ষে ছিল কঠিনতর ব্যাপার।

কাজের শিক্ষা ও অন্তর্জগত আলোকায়নের শিক্ষা বিষয়ে আমাদের প্রস্তুতি এখনো তেমন প্রণিধানযোগ্য বলে মন মানতে চায় না। প্রচারণার ঢাকঢোল ও বাস্তবতার চিত্র এ প্রতীতির জন্ম দিতে বাধ্য হয়েছে। তবে এ অবস্থার পরিবর্তন আনতে যে-প্রয়াস চলছে দেশজুড়ে, তাকে অবশ্যই ইতিবাচকভাবে স্বাগত জানাতে চাই। নিশ্চয়ই এর কোনো সুফল ভবিষ্যতের গর্ভে জমা হয়ে আছে, যা সময়ই কেবল খোলসা করে দিতে পারে।

আমরা বর্তমানে যে-সমাজবাস্তবতার ভেতর বসবাস করছি, সেখানে অন্তর্জগতের শিক্ষার চেয়ে বাইরের চাকচিক্যময় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কদর সবচেয়ে বেশি। শিক্ষার এই ধারণাটির উন্মেষ ও বিকাশ ঘটেছে উপনিবেশিক আবহে। বিশেষ করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ভারতের শাসনভার যখন ইংল্যান্ডের কমন্স সভার কর্তৃত্বে ন্যস্ত হলো। দুর্ভাগ্য যে, এ ব্যবস্থায় প্রাধান্য পেল ইংরেজি ভাষা, ইঙ্গ সংস্কৃতি ও সভ্যতার আদলে শিক্ষিত হওয়ার ফর্মুলাটা। ফলে ধর্মবর্ণগোত্র নির্বিশেষে সকল স্তরের নিষ্পেষিত ভারতীয়গণ ইংরেজি ভাষা কায়দা মতো রপ্ত করা ও ইঙ্গ চলনবলন মস্ক করার দিকে ঝুঁকে পড়লেন আত্যন্তিক আগ্রহে। কারণ তাতেই সুলভ হয়ে উঠছিল মান-সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা, প্রতিষ্ঠিত হওয়া অর্থে চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যে যুক্ত হওয়া ইত্যাদি। অর্থাৎ সারভাইভাল অব দি ফিটেস্ট Ñ চার্লস ডারুইনের এই আপ্তবাক্যের স্পষ্ট অর্থ দাঁড়াল এখানে যে চেহারা-সুরতে ভারতীয় হলেও চিন্তাচেতনা ও বহির্জগতের কর্মক্ষেত্রে হতে হবে খাস ইংরেজ ভদ্রলোক। তাহলেই কেবল টিকে থাকার মওকা পাওয়া যেতে পারে। এই প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হয়ে ইংরেজের খাসমহলের বাসিন্দা হয়েছিলেন ভারতমাতার বহু বিশ্রুত সন্তান। যেখানে ধর্মবর্ণগোত্রের কোনো ব্যারিকেড আদতেই ছিল না। আবার এই বাস্তবমুখি শিক্ষায় প্রতিষ্ঠিত ভারতবর্ষের বহু পরিবারই পরবর্তিকালে বিভিন্ন দিকে প্রভাব-প্রতিপত্তিও অর্জন করেন বেশুমার। সেই বিবরণ ভারতের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের পাতায়-পাতায় লিপিবদ্ধ হয়ে আছে বিশেষভাবে। এখানে আর সেই ফিরিস্তি অর্থাৎ টীকা-টিপ্পনী না-ই বা দিলাম। ভারত ইতিহাসের ওই গোলকধাঁধার দিকে পক্ষপাতশূন্য মন নিয়ে তাকালে বহু ইতি ও নেতিবাচক বিষয়ের সমারোহ আমাদের একই সময়েই সন্ত্রস্ত, আপ্লুত ও নিঃসঙ্গ করে ফেলে অবলীলায়। কেননা ওই শিক্ষা কাঠামোর ভেতর থেকেই তো দেখি বেরিয়ে এলেন সৃজনশীলতা ও সমাজচেতনার দিকপাল রাজা রামমোহন রায়, নমস্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের জনক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ধর্মে ও কাব্যে প্রথম দ্রোহী মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপের সম্রাট প্যারীচাঁদ মিত্র প্রভৃতি মহীরুহ। রাজনীতি ও স্বদেশভাবনার আকাশে পাওয়া গেল মহাত্মা গান্ধি, সুপরিসর বুদ্ধিবৃত্তির ধারক জওহরলাল নেহরু, মুক্তচিত্ত চিত্তরঞ্জন দাশ, বিভাজক রাজনীতির উদয়তারা মুহম্মদ আলি জিন্নাহ, সত্যসন্ধ বাঙালি পুরুষ সুভাষচন্দ্র বসু, বাংলার বাঘ আবুল কাশেম ফজলুল হক, গণতন্ত্রের মানসসন্তান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বিপ্লবী সূর্য সেন, বাঘা যতীন আর ক্ষুদিরামকে।

আবার এ ধারার ভেতরেই একটু আলাদা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন প্রান্তিক জনজীবনের রাজপুরুষ ফকির লালন শাহ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, উপনিবেশিক চৈতন্যের  বিরুদ্ধে মৌল বিদ্রোহী কাজী নজরুল ইসলাম। শেষের তিনজন উপনিবেশিক শিক্ষায়তনের মনোহর ঘেরাটোপ থেকে, এক অর্থে প্রায় ‘ব্রাত্যজন’ই ছিলেন। তাঁদের জীবনকথা ও সৃষ্টির চরিতার্থতার ভেতরমহলে নজর ফেললে তাঁদের ওই আলাদা হওয়ার ঠিকুজির সন্ধান পাওয়া বিশেষ আয়াসসাধ্য কিছু নয়। লালনের ক্ষেত্রে যেমন তা বিশিষ্ট রকমের নিম্নবর্গীয় ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ বাস্তবতা, রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে যেমন তা পারিবারিক বিশেষ নজরদারিত্ব, নজরুলের বেলায় তা বৈশিষ্ট্যমূলক আত্মজাগরণের উদ্ভাস। বাংলা সাহিত্যভুবনের এই ত্রয়ী আবার বিশেষ বৈশিষ্ট্যরেখায় সমৃদ্ধ কবিসত্তা। তাঁরা কীভাবে উপনিবেশিক শাসন  ও সেই সময়ের শিল্পসাহিত্য-সংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিতের ভেতরে থেকেও আলগা ও উজ্জ্বল হলেন তা আলাদা আলোকপাতের দাবি রাখে। তবে তার আগে কেজো শিক্ষার উপনিবেশিক উত্তরাধিকার আমাদের কোন্ জলাবদ্ধতায় সীমিত করে রেখেছে আজও, তার দেহতল্লাশি আরও কিঞ্চিৎ সাধিত হওয়া দরকার।

চিন্তা-পদ্ধতির প্রথাভাঙার সমর অধিনায়ক হুমায়ুন আজাদ স্বাধীন বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে শিল্পসাহিত্যের বি-মানবীকরণের মৌলিক প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। তাঁর এই অনুধ্যানটি ইতিহাসচেতনার প্রকৃষ্ট বিস্ফোরণ বটে। তিনি যখন ক্রোধাত্মক অথচ অনুপম কথন ও লেখনভঙ্গি সহকারে আমাদের জীবনযাপনের কদর্যতার চিত্র তুলে ধরেন, সেই আঘাত মর্মে লাগলেও অসম্ভব ধৈর্যে তা হজম করতে হয় শিক্ষিত সমাজকে। সন্ত ও স্বচ্ছন্দ ভাবুকতার কিংবদন্তি আহমদ ছফাও তাঁর সময়ের বাংলামুলুকের বৃহত্তর জনসমাজকে অন্ধকারে ডুবিয়ে রেখে কেজো শিক্ষায় ফুলে-ফেঁপে ওঠা, ব্রিটিশ শাসক লর্ড মেকলে-কথিত বেশভূষা ও গায়ের রঙে বাংলাদেশি অথচ মন-মানসিকতায় ‘ইংরেজ’দের গভীর সমালোচনা  করে গেছেন। তারপরও বাস্তবতা এই যে, বাংলাদেশ ভারত পাকিস্তানে ওই উপনিবেশিক উত্তরাধিকারই উত্তরোত্তর আমাদের লোকালয় ও কলাকেন্দ্রসমূহ দখল করে চলেছে। ওই অদৃশ্য ভূতই আমাদের তাবৎ বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ-সহায়কে পাশ্চাত্য শিক্ষা-সংস্কৃতির সঙ্গে সমন্বিত করছে যথাযথ সোপান নির্মাণ ব্যতিরেকেই।

বিপরীতে লালন-রবীন্দ্র-নজরুলের  আধ্যাত্মিক ও বস্তু দর্শনের সমন্বিত রূপের কথা যখন ভাবা যায়, তখন উপলব্ধিতে জ্বলজ্বল করে এই প্রত্যয় যে, আমাদের অন্তর্বিদ্যালয়ের পরিসরও অনেক বড়। কথায়-কথায় ঐতিহ্য ও পুরাকালের সৌন্দর্যের প্রতি আমরা প্রণতি সহযোগে ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রকাশে কসুর করি না অনুষ্ঠানে, আলোচনা সভায়। তাতে নিবেদিত কান্না ও বিলাপের মায়াও কম থাকে না। কিন্তু ওই অতীতের জৌলুস অনুধাবনায় আমাদের অননুমেয় ব্যর্থতার ঝাঁপি তাতেও উন্মোচিত হয় না। কেজো শিক্ষার ইলেকট্রোপ্লেটিং নামক নির্মোক ছেড়ে ওই মার্গে প্রবেশে আমরা এখনো কুণ্ঠিত, যথেষ্ট বিড়ম্বিতও বটে। এদেশের কিছু দুঃসাহসী চিরযুবা আর আলোকিত বিদ্যার্থীই কেবল পূর্বপুরুষের অন্তর্বিদ্যালয়ে খুশবু ও গৌরব নিয়ে প্রব্রজ্যায় নিরত আছেন বড় দায়ভারে। কিন্ত তারা বড়ই নিঃসঙ্গ। গভীর আঁধারে জোনাকির মতো আলোময় তারা। সুখের বিষয় যে, তরুণ প্রজন্মে এই কাফেলার সংখ্যা দিন-দিন বাড়ছে। মানে অন্বয় ক্রমে বর্ধিত হচ্ছে প্রকৃত উপলব্ধির সঙ্গে সাচ্চা অনুভূতির।

ওই অন্তর্বিদ্যালয়ে সকলের ডাক পড়ছে। যেখানে ফকির লালন গাইছেন : ‘আপনাকে চিনতে পারলে যাবে অচেনারে চেনা …’, রবীন্দ্রনাথ বলছেন : যেথায় তুমি বস দানের আসনে/চিত্ত আমার সেথায় যাবে কেমনে।/নিত্য নতুন রসে ঢেলে/আপনাকে যে দিচ্ছ মেলে,/ সেথায় কি ডাক পড়বে না গো জীবনে …’ নজরুল সুর তুলেছেন : ‘আমি আপনারে খুঁজি আপনায়…’

আমাদের এই অন্তর্বিদ্যালয়গুলো পরিপূর্ণ উন্মুক্ত হতে এখন আরও উন্মুখ। কারণ এই চৈতন্যের সারিতে আছে খানকা-তপোবন বা আশ্রমিক শিক্ষার লোকায়ত শুদ্ধতা ও শক্তি। বিপরীতে  কেজো শিক্ষার উপনিবেশিক উত্তরাধিকারের স্কুলগুলো আমাদের দিল্-মন্দিরে তালা ঝুলিয়ে ভেতরের সব ডাকাতি করতে লেগেছে। হ্যাঁ, ওই অভ্যস্ত জীবন বা সমাজবাস্তবতার বাইরে থেকে নয় বরং ওখানে থেকেই এ সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, অ্যাভরি অ্যাকশন হ্যাজ ইকুয়াল রিঅ্যাকশন ..

হাফিজ রশিদ খান : কবি ও সাংবাদিক, সম্পাদক-পুষ্পকরথ। pushpakrath@gmail.com