স্বাস্থ্য, চিকিৎসা এবং উপনিবেশবাদ

0
514

স্বাস্থ্য, চিকিৎসা এবং উপনিবেশবাদ : ফ্রাঁনৎস ফাঁনো

ভূমিকা ও অনুবাদ: শাহ্ মোহাম্মদ ফাহিম

ভূমিকা: ফ্রাঁনৎস ফাঁনোর জন্ম মার্তিনিক (Martinique)-এর রাজধানী ফোর্ট দে ফ্রান্স (Fort-de-France) শহরে, ১৯২৫ সালের ২০ জুলাই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর লিয়ন (Lyon)-এ ডাক্তারি পড়তে যান ফাঁনো। সেখানেই মনোবিজ্ঞান ও মানসিক রোগ বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেন তিনি। ১৯৫৩ সালে মনোরোগবিদ্যায় উচ্চতর ডিগ্রি লাভের পর তিনি আলজেরিয়াতে যান। থাকেন তিন বছর। আলজেরিয়াতে যাবার পর ফাঁনো এক নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। বিশেষ করে সেখানকার গরীব, অসহায় লোকজনকে চিকিৎসা দিতে গিয়ে তিনি বিরোধিতার সম্মুখীন হন। উপনিবেশবাদীদের আচরণ এবং তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি স্থানীয়দের মানসিক প্রতিক্রিয়া ও মনোভাব তিনি খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। এর উপর ভিত্তি করেই ১৯৫৯ সালে লিখেন ‘‘LÕan cinq de la revolution alge´rienne’’, যা ইংরেজিতে ‘A Dying Colonialism’ নামে তরজমা হয়েছে। এই বইয়ের চতুর্থ অধ্যায়ে ফাঁনো ফরাসি উপনিবেশকালে আলজেরিয়ার স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে আলোচনা করেছেন। বাংলা ভাষার পাঠকদের জন্য এই অংশটাই তরজমা করেছি এখানে।

ফাঁনোর মৃত্যুর অর্ধশতাব্দীকালেরও বেশি সময় পরে এসে তার লেখা নিয়ে আলাপের বিশেষ তাৎপর্য আছে। উপনিবেশি কাঠামোর মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসাব্যবস্থা উপনিবেশভুক্তদের মনে কিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয় বা এর ফলে কোন কিসিমের পরিবেশ-পরিস্থিতির উদ্ভব হয় তা নিয়ে গভীর চিন্তা-পর্যালোচনার দরকার আছে। কেননা আর সব উপনিবেশি অঞ্চলের মত ভারতবর্ষেও পশ্চিমা চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রবর্তন হয় ইউরোপীয় সাহেবদের হাত ধরে। ফাঁনোর লেখায় আলজেরিয়ার জায়গায় ভারতবর্ষের যেকোন অঞ্চল এবং ফরাসিদের জায়গায় ব্রিটিশদের বসিয়ে দিলে আমরা দেখব হুবহু এখানকার বর্ণনাই দিচ্ছেন তিনি।

উপনিবেশবাদের ধারণাই ছিল এমন যে, যা কিছু পশ্চিমা তাই আধুনিক, চিরন্তন ও একমাত্র সহীহ তরিকা। আগে থেকে বিদ্যমান যে কোন পদ্ধতি বা কৌশল প্রাচীন ও সেকেলে। ফলে পশ্চিমা চিকিৎসাবিজ্ঞান পুরাতন চিকিৎসা পদ্ধতিকে পুরোদমে নাকচ করে দেয়। এ কারণে উপনিবেশবাদীদের প্রবর্তিত চিকিৎসাব্যবস্থা সব দেশে, সব অবস্থাতেই উপকারী বলে বিবেচিত হলেও স্থানীয় জনগণ একে জুলুমের নতুন তরিকা বলেই মনে করত। জুলুমতন্ত্রের অংশ হওয়ায় স্থানীয় জনগণ ইউরোপীয় ডাক্তারদের বিশ্বাস করত না। এই অবিশ্বাস পশ্চিমা ব্যবস্থায় শিক্ষিত স্থানীয় ডাক্তারদের বেলায়ও প্রযোজ্য ছিল। কারণ তারাও উপনিবেশি প্রভুদের স্বভাব রপ্ত করত। আমাদের এখানে এখনো এই অবিশ্বাসের সংস্কৃতি দেখা যায়। রোগীরা এখনো ডাক্তারদের বিশ্বাস করে না। ডাক্তারও মনে করে রোগীরা মূর্খ, কিছুই জানে না বা বোঝে না। ঢালাওভাবে এর জন্য ডাক্তার বা রোগীকে দায়ী করলেই দায়মুক্তি ঘটে না। এখানকার স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে সামগ্রিকভাবে এখনো পর্যন্ত কোন পর্যালোচনামূলক আলাপ-আলোচনা হয় নাই। ফলে উত্তর উপনিবেশি ডাক্তারি ব্যবস্থা ও তত্ত্ব যে এখনো উপনিবেশকালের প্রেতাত্মা বয়ে বেড়াচ্ছে তা কারো কাছেই স্পষ্ট নয়। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ও একটি গণমুখী স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রণয়নের জন্য ফাঁনোর আলাপের বোঝাপড়া জরুরি। সেই তাগিদ থেকেই এই তরজমা কর্ম। দখিনার পাঠকদের জন্য কিছুটা সংক্ষেপিত করা হলেও এর সাথে সংযোজিত হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ টীকা-সূত্রসমূহও

ভূমিকা ও অনুবাদ: শাহ্ মোহাম্মদ ফাহিম

স্বাস্থ্য, চিকিৎসা এবং উপনিবেশবাদ : আলজেরিয়ার উদাহরণ

ফরাসিদের অব্যহত শোষণ ও জুলুমতন্ত্রের অংশ হিসাবেই আলজেরিয়াতে পশ্চিমা চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রবর্তন করা হয়। বৈশিষ্ট্যগত দিক দিয়ে তা ছিল চরম বর্ণবাদী ও স্থানীয় জনগণের প্রতি অপমানকর। এ কারণে সাহেবদের চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে স্থানীয়দের মনে হামেশাই অনিশ্চয়তার দোলাচল ঘুরপাক খেতে থাকে। অবশ্য দখলদারদের সব কর্মকান্ডের ব্যাপারেই স্থানীয় মানুষজনের মনে এই ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব লক্ষ্য করা যায়। চিকিৎসা সেবা বা ওষুধও তার ব্যতিক্রম নয়। কার্যত পশ্চিমা চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে উপনিবেশি ব্যবস্থার অন্যতম করুণ একটা দিক আমাদের সামনে খোলাসা হয়ে উঠে। এই আলোচনায় আমরা সেদিকেই নজর দিব।

প্রযুক্তিগতভাবে অগ্রসর যেকোন দেশ তার বিজ্ঞানীদের জ্ঞান, মেধা ও উদ্ভাবন দ্বারা উপকার লাভ করে থাকে। বস্তুগতভাবে মানব সমাজের সব ক্ষেত্রে, সব অবস্থাতেই এটা প্রযোজ্য। কিন্তু যখন এটা মানুষের স্বাস্থ্য বা দৈহিক সুস্থতার সাথে জড়িত, যার প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে শারীরিক ব্যথা-বেদনা বা কষ্ট থেকে মুক্তি, তখন কোন নেতিবাচক প্রক্রিয়াই গ্রহণযোগ্য নয়। উপনিবেশ কালের পরিস্থিতি এমন ছিল যে উপনিবেশভুক্ত জনগণ উপনিবেশি শক্তির সব অবদানকেই চরম মানহানিকর বলে গণ্য করত। এ কারণে তারা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, স্কুল শিক্ষক, পুলিশ, গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সৈনিক, এদের সবাইকে সহজাত সন্দেহের চোখে দেখত। ডাক্তারের বাধ্যতামূলক রোগী দেখা কার্যক্রম তখন পুলিশ প্রশাসনের মধ্যস্থতাতেই সম্পন্ন হত। পুলিশ সাধারণ মানুষদের ডাক্তারের দুয়ারে এনে হাজির করত। সাধারণত যেসব ডাক্তাররা প্রভাবশালী মহলের অন্তর্ভূক্ত কিংবা সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন তারাই এ ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতেন।

উপনিবেশবাদীরা প্রায়ই স্থানীয়দের স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা বিষয়ক বিভিন্ন সূচকের উন্নতি দেখিয়ে প্রতিবেদন পেশ করত। এর মাধ্যমে তারা দাবী করত যে, তাদের প্রবর্তিত চিকিৎসার কল্যাণেই স্থানীয়দের রোগ-ব্যাধি মোকাবেলার ক্ষমতা বেড়েছে। তবে স্থানীয়রা কখনোই এমনটা মনে করত না। তারা বরং এসব পরিসংখ্যানগত তথ্যকে দখলদারের কর্তৃত্ব বৃদ্ধির সুনির্দিষ্ট প্রমাণ বলেই মনে করত। তবে স্থানীয়দের তরফে মানসিক জড়তা ছিল। বস্তুনিষ্ঠ ভূমিকা পালন করাটা তাদের জন্য কঠিন ছিল। আসলে গম থেকে তুষ আলাদা করার কাজটা অত সহজ ছিল না। অবশ্য ব্যতিক্রমও ছিল। পরিস্থিতি শান্ত থাকলে কিংবা পারস্পরিক বিরোধপূর্ণ মনোভাব কিছুটা শিথিল থাকলে, স্থানীয় লোকজন শাসকদের অনেক ভালো কাজের কথাই খোলাখুলিভাবে স্বীকার করত। কিন্তু দখলদাররা তাৎক্ষণিকভাবে এই আস্থা ও বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে নিত। তারা একে দখলের পক্ষে ন্যায্যতা হিসেবে হাজির করত।

বিরোধীদের যোগ্যতম হিসাবে গড়ে তুলতে উপনিবেশবাদীদের মধ্যে সব সময়ই তীব্র অনীহা ছিল। পুরো উপনিবেশি সমাজ জুড়ে এমনটিই আমাদের নজরে আসে। ব্যাপারটি এমন যে দখলদাররাই সব যোগ্যতার অধিকারী এবং তাদের যোগ্যতাকে স্বীকৃতি দেয়ার অর্থ হচ্ছে জুলুম-নিগ্রহের অনুমোদন বা স্থানীয়দের জন্মগত অক্ষমতার স্বীকারোক্তি। এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার পরে উপনিবেশভুক্ত জনগণ ভালো-খারাপ নির্বিশেষে শাসক শ্রেণীর সব কাজ-কর্মের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট পন্থায় কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখানো শুরু করে। এ কারণে এমন মন্তব্য খুব একটা অস্বাভাবিক শোনায় না যে, ‘তোমাদের কাছে তো কেউ কিছু চায় নাই। তোমাদের কে এখানে দাওয়াত করে এনেছে? তোমাদের হাসপাতাল আর বন্দরের সুবিধা আমাদের দরকার নাই। এগুলো বন্ধ করে নিজ দেশে ফেরত যাও।’

প্রকৃতপক্ষে সামরিক অভিযান ও পুলিশি ব্যবস্থার মাধ্যমেই উপনিবেশবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ কারণে তা সব সময় নিজের দখলদারির ন্যায্যতা ও কাজের বৈধতার পক্ষে যুক্তি খুঁজে বেড়াত।

সত্য ও যুক্তির দোহাই দিয়ে দখলদারদের নিত্য নতুন কর্মসূচীতে সায় দেয়ার মাধ্যমে স্থানীয় জনগণ যে ধীরে ধীরে পুরো উপনিবেশ ব্যবস্থায় বন্দী হয়ে পড়ছে তা তারা বুঝতে পারছিল। তাদের কাছে এটাও স্পষ্ট ছিল যে, ফরাসি উপনিবেশবাদ এবং সেখানকার ফরাসি স্বাস্থ্যসেবা এই দু’টিকে কোনমতেই জুদা করা সম্ভব না। কাজেই ফরাসি স্বাস্থ্যসেবাকে মেনে নেয়া মানে উপনিবেশবাদকেই স্বীকৃতি দেয়া। নিজ দেশের জনগণ, যারা নিজেদের মাটিতে স্বাধীন অস্তিত্বে বিশ্বাসী, তাদের প্রত্যাখ্যান করা। কিন্তু স্থানীয়দের জন্য এ কাজটা সহজ ছিল না। অতএব তারা ভিনদেশি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, স্কুল শিক্ষক, বিমান আরোহী ছত্রীসেনা সবাইকে একই সাথে একই কায়দায় উপেক্ষা করা শুরু করল।

উপনিবেশ বহির্ভূত বা অ-উপনিবেশি সমাজে ডাক্তারের উপর রোগীর এক ধরনের আস্থা কাজ করে। রোগী তাকে বিশ্বাস করে। এই বিশ্বাসের কারণেই সে নিজেকে ডাক্তারের হাতে সঁপে দেয়। নিজের শরীরকে পুরোপুরি ডাক্তারের কাছে সমর্পণ করে। ডাক্তার তাকে ব্যথা দিতে পারে বা ব্যথার তীব্রতা আরো বাড়তে পারে বলেই সে মেনে নেয়। কারণ সে বিশ্বাস করে ডাক্তারি পরীক্ষার এই তীব্র যন্ত্রণা হয়ত তাকে দৈহিক সুস্থতার পথে নিয়ে যাবে।

উপনিবেশ বহির্ভূত সমাজে রোগী কখনোই ডাক্তারকে অবিশ্বাস করে না। জ্ঞান এবং পেশাগত দক্ষতার উপর ভিত্তি করে হয়ত রোগীর মনে উদ্ভূত সংশয় দূর করা সম্ভব। কিন্তু ডাক্তারের তরফে যদি কোন সীমাবদ্ধতা থাকে তবে রোগীরা খুব একটা ভরসা পান না। এটা যে কোন জায়গাতেই ঘটতে পারে। তবে এটা সুস্পষ্ট যে, সুনির্দিষ্ট কিছু পরিস্থিতিতে ডাক্তার ও রোগীর সম্পর্কে দৃশ্যমান পরিবর্তন ঘটতে পারে। কোন জার্মান কারাবন্দীকে যদি ফরাসি সার্জন অপারেশন করতে যায় তবে চেতনানাশক ওষুধ প্রয়োগের আগে সে বারবার তার জীবননাশ না করার জন্য ডাক্তারের কাছে মিনতি করতে থাকে। একই অবস্থায় সফলতার সাথে অপারেশন সমাপ্ত করা নিয়ে সার্জনও খুব পেরেশান থাকেন। কারণ অপারেশন টেবিলে রোগী মারা গেলে কি ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হবে বা অন্য কারাবন্দীরা এটাকে কিভাবে নিবে তা তিনি উপলব্ধি করতে পারেন। জার্মান ক্যাম্পে বন্দী ফরাসি কারাবন্দীদের ক্ষেত্রেও একই চিত্র লক্ষ্য করা যায়। তাদেরকে ক্যাম্প হাসপাতালে কর্মরত জার্মান ডাক্তারদের অপারেশনে সহায়তা করতে বলা হলে তারাও একই ধরনের উদ্বেগ প্রকাশ করত। উপনিবেশি অঞ্চলগুলোতে এই ধরনের পরিস্থিতি আরো বেশি দেখা যেত।

রুগ্ন ও আহতদের সেবা প্রদানকারী যে কোন প্রতিষ্ঠানে হঠাৎ করেই কেউ না কেউ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পারে। ঐসব প্রতিষ্ঠানের এটাই সাধারণ চিত্র। অথচ হাসপাতালে আলজেরিয় নাগরিকদের হঠাৎ মৃত্যুকে ইচ্ছাকৃত হত্যা বা ইউরোপীয় ডাক্তারের অপরাধমূলক কর্মকান্ড বলেই ধরে নেয়া হত। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ব্যাপারে আলজেরিয় নাগরিকদের মধ্যে চরম অনীহা কাজ করত। মূলত স্থানীয় জনগণের মনে উপনিবেশি ডাক্তারদের মৌলিক মানবীয় গুণাবলির ব্যাপারে দীর্ঘস্থায়ী সন্দেহই এর পিছনে মূল কারণ ছিল। এটাও বলা রাখা দরকার যে, নির্দিষ্ট কিছু হাসপাতালে সেবা দেয়ার নাম করে জীবিত রোগীদের উপর গবেষণা চালানো হত। সম্পূর্ণ বেআইনি এই কাজটা এমন পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল যে একে নগণ্য বলেও ধরে নেয়া যায় না।১

ডাক্তারদের নানা রকম অনুরোধ-উপদেশ সত্ত্বেও প্রায় এক যুগ ধরে হাসপাতালে ভর্তির ব্যাপারে আলজেরিয় জনগণের মনে চরম দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাজ করত। এই ব্যাপারে কোন ধরনের দোনোমনা ভাব যে রোগীর জীবনকে আরো বিপন্ন করে তুলতে পারে তা জানার পরও রোগীকে বাড়িতে ফেরত নিয়ে যাওয়া হত। এমনকি বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা জোরাজুরি করলেও রোগীকে কোনমতেই হাসপাতালে নেয়া হবে না বলে তাদেরকে জানিয়ে দেয়া হত। দেখা যেত, একেবারে শেষ সময়ে যখন ডাক্তারের আর তেমন কিছুই করার থাকে না, তখন হাসপাতালে নেয়ার ব্যাপারে সম্মতি মিলত। তবে যিনি অনুমতি দিতেন তাকে সবার মতের বিরুদ্ধে গিয়েই এই সিদ্ধান্ত নিতে হত। কিন্তু যেহেতু রোগীর অবস্থা আগে থেকেই সংকটাপূর্ণ ছিল এবং হাসপাতালে আনার সিদ্ধান্তটাও ছিল অনেক বিলম্বিত, সে কারণে বেশিরভাগ সময়ই রোগীকে আর বাঁচানো যেত না।

এই অভিজ্ঞতা দখলদারদের ব্যাপারে স্থানীয়দের পুরনো বিশ্বাসকেই আরো মজবুত করত। আর তা হচ্ছে, মৌলিকভাবেই দখলদাররা সবাই বদ এবং ডাক্তাররাও এর ব্যতিক্রম নয়। স্থানীয়দের কেউ কেউ অনেক চেষ্টার পরে চিরাচরিত সংস্কারগুলোকে লক্ষণীয় মাত্রায় অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছিল। রোগীকে হাসপাতালে নেয়ার ব্যাপারে তারাও জোরালো ভূমিকা রাখত। কিন্তু এই ধরনের পরিস্থিতির পর তাদের মনেও মারাত্মক অপরাধবোধ কাজ করত। একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করবে না বলে তারা মনে মনে ওয়াদা করে নিত। পক্ষান্তরে মূহুর্তের মধ্যে স্থানীয়রা সব মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে তাদের বিশ্বাসের সপক্ষে জোরালো এবং একরোখা অবস্থান নিত।

উপনিবেশভুক্ত জনগণ যে শহরের ভয়ে, দূরত্বের ভয়ে কিংবা পারিবারিক নিরাপত্তা ও সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হবার ভয়ে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধা দিত এমনটা নয়। তাদের কাছে হাসপাতালে পাঠনোর অর্থই ছিল পরিবারের বোঝা কমানোর নামে কাউকে নিশ্চিত মৃত্যুর পথে ঠেলে দেয়া। এই বিষয়টাকেই তারা ভয় পেত। এ কারণেই তারা রোগীদের সাদা চামড়ার ভিনদেশি বিজেতাদের হাসপাতালে পাঠানোর তীব্র বিরোধী ছিল।

ধৈর্য্য সহকারে এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় উনিবেশভুক্ত জনগণের প্রতিটি প্রতিক্রিয়ার পর্যালোচনা করা জরুরি। কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের মনোভাব না বুঝলে মেনে নিতে হবে যে, এখন আর কোনভাবেই উপনিবেশ আমলে ফিরে যাওয়া সম্ভব না। ফলে সেই সময়কার যে কোন ঘটনার পটভূমি ঠাহর করা আমাদের তরফে অনেকটাই অসম্ভবই।

স্থানীয় জনগণ আরোগ্যের জন্য নিজ দেশীয় প্রাচীন ডাক্তারি কৌশল-পদ্ধতি এবং সগোত্রীয় হেকিম, দরবেশ বা ফকির-কবিরাজের উপর নির্ভর করত। অনেক সময় এ কারণেই ইউরোপীয় ডাক্তারদের উপর পূর্ণ আস্থা জানাতে তাদের মধ্যে অনাগ্রহ কাজ করত। এই ধরনের মানসিক প্রতিক্রিয়া ডাক্তারদের মধ্যেও দেখা যেত। লেরিখ (খবৎরপযব)-এর বরাতে আমরা জানতে পারি, অনেক ডাক্তারই থার্মোমিটার ব্যবহারে অস্বীকৃতি জানাতেন বা কুণ্ঠাবোধ করতেন। কারণ তারা নাড়ী টিপে বা পালস দেখে তাপমাত্রা মাপতে অভ্যস্ত ছিলেন। বিশেষ কোন রোগের চিকিৎসায় যিনি নির্দিষ্ট ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করতেন তার পক্ষে নিজস্ব পদ্ধতি বাদ দিয়ে ঐ একই রোগের প্রতিকারে নতুন পদ্ধতির অনুসরণ করতে না চাওয়াটাকে খুব একটা অস্বাভাবিক বলা যাবে না। কারণ নতুন কার্যপদ্ধতি বা চিকিৎসা কৌশল তার উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। তাছাড়া নতুন পদ্ধতি পুরাতন পদ্ধতিকে সম্পূর্ণ নাকচ করে দিয়ে তার জায়গা দখল করে নেয় এবং তা পুরাতন চিকিৎসা পদ্ধতির বিন্দুমাত্র অস্তিত্বও সহ্য করতে পারত না। এটাও নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি বা কৌশল প্রত্যাখান করার অন্যতম কারণ ছিল।

উপনিবেশভুক্ত সমাজ ও উপনিবেশি সমাজের পক্ষে একই সময়ে, একই জায়গায়, নির্দিষ্ট কোন বিশ্বাস বা মূল্যবোধের ব্যাপারে সম্মতি জ্ঞাপন ও সম্মান প্রদর্শন করা সম্ভব ছিল না। সব সম্ভাব্যতার বিপরীতে, যদি কোন বিষয়ে উপনিবেশভুক্ত সমাজ উপনিবেশি দখলদারদের সাথে একমত পোষণ করত, তবে সাথে সাথেই সেখানে এই দুই সমাজের সফল একীভূতকরণের ব্যাপারে আলোচনা শুরু হয়ে যেত। স্থানীয়দের ধারণা ছিল ফরাসি দখলদারির কারণে নতুন নতুন অসুখ-বিসুখের উদ্ভব হয়েছে। এসবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সমস্যা নিয়ে আলজেরিয় সমাজে যে সাধারণ প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল তার বিয়োগান্তক গলিঘুঁজির প্রতি এখনই নজর দেয়া জরুরি। তাহলে আমরা দেখতে পাব যে, মুক্তি সংগ্রামের পথে ডাক্তারি কলা-কৌশল সম্পর্কে আলজেরিয় জনগণ কর্তৃক গৃহীত নতুন আচার পদ্ধতি কোন সব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়েছে।

ডাক্তার দেখানোর প্রক্রিয়া

উপনিবেশি আমলে ডাক্তার দেখাতে যাওয়া যে কোন ব্যক্তির মধ্যে এক ধরনের দ্বিধা বা সংকোচ কাজ করত। ডাক্তারের প্রশ্নের জবাবে সে এক অক্ষরে উত্তর দিত এবং এর ব্যাখ্যা জানতে চাইলে সে ডাক্তারকে খুব সামান্য পরিমাণ তথ্যই প্রদান করত। এতে খুব সহসাই ডাক্তারের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটত। সাধারণত ডাক্তারের উপস্থিতিতে রোগীর মনে এক ধরনের অদম্য ভয়ের উদ্ভব হয়। তবে স্থানীয়দের আচরণকে এর সাথে মিলিয়ে ফেললে চলবে না। আমরা প্রায়ই শুনে থাকি অমুক ডাক্তারের আদব-লেহাজ ভালো, কেননা রোগী তার আচরণে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কিন্তু উপনিবেশকালে ব্যক্তিগত সান্নিধ্য, একাত্ম হওয়ার সামর্থ্য বা যোগাযোগ স্থাপণ করা ও তা বজায় রাখার ঘটনা খুব একটা নজরে পড়ত না। উপনিবেশি দখলদারি সম্পর্কগুলোকে নতুন আকার দান করে এবং এর মাধ্যমে উপনিবেশি সমাজ লক্ষণীয় মাত্রায় দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়ে।

দেখা যেত, ডাক্তার নিজেও উপনিবেশভুক্ত রোগীর কাছ থেকে কোন ধরনের তথ্য পাওয়ার আশা ছেড়ে দিতেন। তিনি শারীরিক পরীক্ষার জন্য রোগীকে চটজলদি শুয়ে পড়তে বলতেন। কারণ তার ধারণা ছিল, এর মাধ্যমে হয়ত রোগ সম্পর্কে আরো বেশি তথ্য পাওয়া যাবে। কিন্তু রোগীর দেহকেও তিনি একইরকম অনমনীয় অবস্থায় দেখতে পেতেন। পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণের পুরো সময় রোগীর মাংসপেশীগুলো সংকুচিত অবস্থাতেই থাকত। প্রসারণের কোন লক্ষণ দেখা যেত না। এটা এমন এক পরিস্থিতি যখন উপনিবেশভুক্ত ব্যক্তি একই সাথে একজন আরোগ্যশিল্পী এবং একজন উপনিবেশবাদীর মুখোমুখি হতেন।২ এই বিষয়ে অবশ্য ইউরোপীয় ডাক্তার যিনি রোগীকে পরীক্ষা করে দেখেছেন তার মন্তব্যও শোনা উচিত। তিনি বরং বলতেন, ‘তাদের ব্যথার ধরনটা প্রোটোপ্যাথিক, খুব সামান্যই তফাৎযোগ্য এবং সারা শরীর জুড়ে বিস্তৃত। অনেকটা পশুদের মত। মূলত এটা এক ধরনের সাধারণ অস্বাচ্ছন্দ্যবোধ, দেহের কোন নির্দিষ্ট স্থানে সীমাবদ্ধ অসুস্থতা নয়’। রোগীর ভাষ্য ছিল এমন যে, ‘তারা আমার সমস্যা সম্পর্কে জানতে চাইল। ভাবখানা এমন যে আমিই ডাক্তার। তারা নিজেদের খুব বুদ্ধিমান ও করিৎকর্মা মনে করে। অথচ আমার কোথায় ব্যথা তাই বলতে পারে না। বরং তাদের কাছে যাওয়া মাত্রই জিগেশ করে, আপনার সমস্যা কোথায়?’ ডাক্তার বলেন, ‘এই মানুষগুলা অভদ্র এবং রুক্ষ’। আর রোগীর কথা হচ্ছে, ‘আমি এদের বিশ্বাস করি না’। ডাক্তারের মতে, উপনিবেশভুক্ত রোগীরা আসলে জানেই না যে তারা কি চায়, তারা কি সুস্থ হতে চায় নাকি অসুখ নিয়েই বাঁচতে চায়। কিন্তু স্থানীয়রা সেই পুরানো কথাই বলতে থাকে, ‘আমি জানি কিভাবে তাদের হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। কিন্তু সেখান থেকে ছাড়া পাওয়ার কোন উপায় আমার জানা নাই’। কাজেই খুব দ্রুত ডাক্তাররা, এমনকি নার্সরাও এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতেন যে, এদের উপর চিকিৎসাবিদ্যা প্রয়োগ করার কোন উপায় অবশিষ্ট নাই। এদের সাথে বরং পশুচিকিৎসকের মতই আচরণ করতে হবে।৩ শেষ পর্যন্ত অবশ্য সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় রোগ সম্পর্কে ডাক্তারের কমবেশি একটা ধারণা হত এবং সে অনুসারে তিনি রোগীকে একটা ব্যবস্থাপত্র দিতেন। কিন্তু অনেক সময়ই রোগীরা তা মানত না। সমাজবিজ্ঞানীরা এ সমস্ত কর্মকান্ডগুলোকে ব্যাখ্যা করার একটা ঝুঁকি নিতে পারেন এবং একে নিয়তিবাদের অধীনে শ্রেণীবদ্ধ করতে পারেন। এর বিপরীতে, উপনিবেশি কাঠামোর অভ্যন্তরে বিদ্যমান এই ধরনের আচরণ পর্যালোচনার মাধ্যমে আমরা ভিন্ন ধরনের উপসংহার টানতে পারি।

উপনিবেশভুক্ত কোন ব্যক্তি যদি তার শরীরের ইন্টেগ্রিটি বা অখন্ডতা অক্ষুন্ন রেখে ডাক্তারের কাছ থেকে পালাতে পারত তবে সে নিজেকে চমকপ্রদ মাত্রায় বিজয়ী বলে মনে করত। স্থানীয়দের কাছে ডাক্তার দেখানোর বিষয়টা সব সময়ের জন্যই অগ্নিপরীক্ষা বলে বিবেচিত হত। যদি উপনিবেশবাদীদের আরোপিত চিকিৎসা সুবিধা বড়ি বা তরল মিক্শ্চার গেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত, তবে উপনিবেশভুক্তদের মনে শত্রুর উপর বিজয় লাভের গভীর সুখানুভূতি তৈরী হত। ডাক্তার দেখানো শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটত। অবশ্য ডাক্তারের দেয়া ওষুধ, উপদেশ ইত্যাদি অগ্নিপরীক্ষার ধারাবাহিকতা বলেই বিবেচিত হত।

উপনিবেশভুক্ত ব্যক্তির উপলব্ধি অনুন্নত দেশের সাধারণ জনগোষ্ঠী কিংবা দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা এতিমদের মত হয়। সে অনুধাবন করে, জীবনটা অত্যাবশ্যক উৎপাদনশীলতার উন্নয়ন বা সমৃদ্ধি নয়। বরং সর্বত্র বিরাজমান মৃত্যুর সাথে চিরস্থায়ী সংগ্রাম। ডাক্তারি চিকিৎসাকে উপেক্ষা করা বা প্রত্যাখান করার মানে যে বেঁচে থাকতে অস্বীকৃতি জানানো তা নয়। বরং এর অর্থ ছিল আসন্ন মৃত্যুর সংক্রমণের প্রতি চূড়ান্ত নির্লিপ্ততা প্রদর্শন করা। ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে অবশ্য বলা যায় যে, স্থানীয়দের আচরণে উন্নত স্বভাব-চরিত্রের অনুপস্থিতি উপনিবেশি ডাক্তারদের উপর উপনিবেশভুক্তদের অবিশ্বাসই নির্দেশ করে। ডাক্তার বা কারিগরী প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অন্যান্য পেশাজীবিদের যেকোন কথাই নিন্দনীয় অর্থে বুঝা হত। ফলে নিরপেক্ষভাবে বর্ণিত সত্য কথাও উপনিবেশি পরিস্থিতির মিথ্যা দ্বারা প্রতিনিয়ত কলুষিত হতে থাকে।

ডাক্তারি তত্ত্বাবধান, চিকিৎসা এবং ‘ক্ষমতার দ্বৈত রূপ’

ডাক্তারের অফিসে উপনিবেশভুক্ত আলজেরিয়দের অসন্তোষজনক রোগী হিসাবেই সাব্যস্ত করা হত। উপনিবেশবাদী ডাক্তারের নজরে আসে যে, তার রোগী নিয়মিত ওষুধ খাচ্ছে না। খেলেও তা ভুল মাত্রায় খাচ্ছে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর ডাক্তার দেখানোর কথা থাকলেও সে নিয়মিত আসছে না। এমনকি ডাক্তারের নির্ধারণ করে দেয়া খাদ্যতালিকার প্রতিও সে এক ধরনের আপাত বিরোধী ও ছেলেমানুষি আচরণ প্রদর্শন করছে। এগুলাই সব নয়। সব চাইতে বিস্ময়কর এবং অদ্ভুত আচরণ হিসেবে এই কয়টাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে একটা সাধারণ ধারণা তৈরী হয় যে, রোগী ডাক্তারের সাথে লুকোচুরি খেলছে। তার উপর ডাক্তারের কোন নিয়ন্ত্রণ নাই। ডাক্তারের তরফে আরো লক্ষ্য করা হল যে, বারবার ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি নেয়ার পরও রোগীর পলায়নপর, নির্লিপ্ত স্বভাবটা রয়ে গেছে। এসব পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য ডাক্তার এবং তার সহযোগী নার্সদের সব প্রচেষ্টাই রোগীর পক্ষ থেকে মোকাবেলা করা হত। তবে কোন সুনির্দিষ্ট পন্থায় নয়, বরং হুট করে উধাও হয়ে যাওয়ার মাধ্যমেই তা করা হত।

প্রথমত লক্ষণীয় যে, রোগী আর কখনোই ফিরে আসত না। অথচ রোগীকে ভালো করে বুঝিয়ে বলা হত যে, নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোর জন্য তাকে আসতে হবে। পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার জন্য বেশ কয়েকবার হাজিরা দেয়াটা অত্যন্ত জরুরি। ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্রে এটা স্পষ্ট করে লেখা থাকত। বারবার এর গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে রোগীকে বুঝানো হত। এমনকি ডাক্তারের সাথে সাক্ষাতের জন্য তাকে নির্দিষ্ট দিন-তারিখও ধার্য করে দেয়া হত। কিন্তু ডাক্তারের সব প্রচেষ্টা এবং রোগীর জন্য তার অপেক্ষা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হত। কারণ রোগী আর আসত না। কিংবা যখন সে আসত, ততদিনে রোগের তীব্রতা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। প্রকৃতপক্ষে রোগী পাঁচ থেকে ছয়মাস বা কখনো কখনো বছরখানেক পরে আসত। আরও খারাপ বিষয় হচ্ছে, রোগী ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ওষুধ খেত না। জিগেশ করলে জানা যেত, সে হয়ত মাত্র একবার ওষুধ খেয়েছে। কিংবা যে ওষুধ পুরো এক মাস ধরে খাওয়ার কথা ছিল তা একবারের বেশি ছোঁয়াও হয় নাই। এই ধরনের ঘটনার বিচার-বিশ্লেষণ রোগীকে সম্পূর্ণ অসন্তোষজনক বিবেচনা করার কারণ বুঝতে আমাদের সাহায্য করে।

সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, স্থানীয়দের মনে এই বিশ্বাস অটুট ছিল যে একবার সুস্থ হওয়া মানে সম্পূর্ণরূপে আরোগ্যলাভ করা। রোগ যে তাদের দেহে ধীরে ধীরে বাসা বেঁধেছে এটা তারা মনে করত না। তারা বরং একে ব্যক্তিবিশেষের উপর আকস্মিক অভিঘাত বলেই মনে করত। তাদের কাছে যে কোন পথ্যের কার্যকারিতা এর নিয়মিত, পরিমিত এবং সঠিক মাত্রায় গ্রহণের উপর নির্ভর করত না। স্থানীয়রা ওষুধের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া বা ফলাফল দেখতে চাইত। এ কারণে ইনজেকশনের প্রতি তাদের বিশেষ অনুরক্তি ছিল। তাদের কথা হচ্ছে, এক বসাতেই রোগীকে সুস্থ করে দিতে হবে। ডাক্তারের কাজ বলতে তারা এটাকেই বুঝত। ধর্মীয় আচার-বিধির অবমাননা বা নিষিদ্ধ পাপকাজে জড়িয়ে পড়াকেই স্থানীয়রা রোগের কারণ হিসেবে মনে করত। পূণ্যস্থানে তীর্থযাত্রা করা, তাবিজ-কবজ লাগানো বা এক টুকরা কাগজে মন্ত্র লিখে সাথে রাখা- এগুলোকে তারা সর্বোচ্চ কার্যকারিতার চিকিৎসা হিসাবে বিবেচনা করত এবং এগুলোর তাৎক্ষণিক প্রয়োগে বিশ্বাসী ছিল। তাদের ধারণা ছিল, এই কাজগুলো করা বা কবিরাজ-দরবেশের পথ্য গ্রহণের মাধ্যমে অসুখ-বিসুখ বিতাড়ন এবং জীবন পরিচালনার নির্ণায়ক শক্তিগুলোর মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। নিঃসন্দেহে এই মতামত বা বিশ্লেষণের যথার্থতা আছে।

আমরা দেখেছি, উপনিবেশি আধিপত্য উপনিবেশভুক্তদের মনে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ও প্রত্যাখানের আচরণ জন্ম দেয় এবং স্বভাবগত এই জটিলতাকে টিকিয়ে রাখে। উপনিবেশভুক্ত জনগণ উপনিবেশি দুনিয়া থেকে দূরে থাকতে ও দখলদারদের যে কোন কর্মকান্ড থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাত। তারপরও প্রতিনিয়ত উপনিবেশভুক্ত জনগণ ও উপনিবেশি দখলদারদের মধ্যে দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন বিষয়ে অর্থনৈতিক, কৌশলগত এবং প্রশাসনিক নির্ভরতা গড়ে উঠছিল। এটা স্পষ্ট যে, উপনিবেশবাদ স্থানীয় সমাজব্যবস্থার সব উপাদানকেই গড়বড়ে করে দেয়। ক্ষমতাবান শ্রেণী তাদের নিজস্ব মূল্যবোধ ও বিশ্বাস সঙ্গে করে নিয়ে আসত এবং বলপ্রয়োগের মাধ্যমে তা উপনিবেশভুক্তদের দৈনন্দিন জীবনের উপর চাপিয়ে দিত। প্রতিরোধ করা ছাড়া স্থানীয়দের তখন আর কোন উপায় থাকত না। কমবেশি গোপন কর্মপন্থার মাধ্যমেই তাদের এই প্রতিরোধ কার্যক্রম পরিচালিত হত। উপনিবেশি কর্তৃত্বপরায়নতা উপনিবেশভুক্তদের নিজস্ব সংস্কৃতির সাথে বিরাজমান সম্পর্ককে বিনষ্ট করে দিত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঐতিহ্যের চর্চাকে উপদ্রব বলে গণ্য করা হত। উপনিবেশভুক্তরাও চিকিৎসাবিজ্ঞানের আধুনিক উদ্ভাবন এবং রোগের বিরুদ্ধে হাসপাতাল, অ্যাম্বুলেন্স ও নার্সদের কার্যকর হাতিয়ারগুলোকে এড়িয়ে চলতে পারত না। এ কারণে স্থানীয়দের অনেকেই তাদের উপর ডাক্তারি কায়দা-কানুনের হস্তক্ষেপ মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু এটা মেনে নেয়ার পর কেউ যদি হাসপাতালে না যেত তবে নিজ গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে তার উপর চাপ প্রয়োগ করা হত। তার ক্ষেত্রে আধুনিক চিকিৎসা কৌশলের পাশাপাশি চিরায়ত চিকিৎসা পদ্ধতিও অনুসরণ করা হত। তাদের মত ছিল, ‘দুই পদ্ধতির পথ্য অন্তত এক ধরনের চিকিৎসা হতে উত্তম’। আমাদের মনে রাখতে হবে, পেনিসিলিন বা ডিজিটালিনের মত ওষুধ গ্রহণ করার পরও উপনিবেশভুক্ত ব্যক্তিকে তার নিজ গ্রাম বা জেলার কবিরাজ বা হেকিমের চিকিৎসা গ্রহণ করতে হত।

পেনিসিলিন যে তুলনামূলক বেশি কার্যকর তা উপনিবেশভুক্ত ব্যক্তিও অল্প অল্প বুঝত। কিন্তু রাজনৈতিক, মানসিক ও সামাজিক কারণে তাকে চিরায়ত চিকিৎসা পদ্ধতির প্রাপ্যও প্রদান করতে হত। কেননা স্থানীয় কবিরাজ অন্তত একটা দায়িত্ব তো পালন করেছে। জীবিকা হিসাবে তারও তো কিছু প্রাপ্য। মানসিকভাবে উপনিবেশভুক্তকে খুব কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হত। কারণ এই অসুখের সময় তাকে তার নিজস্ব সমাজ-সংস্কৃতির আচার-প্রথা-কর্মকান্ড পরিহার করতে হত। বিদেশি ওষুধ গ্রহণ করার অর্থই ছিল পশ্চিমা ব্যবস্থার বৈধতা মেনে নেয়া। মাত্র একবার খেলেও বা মনের মধ্যে সন্দেহ থাকলেও স্বল্প পরিসরে এর যথার্থতাই স্বীকার করে নেয়া হয়। এর মাধ্যমে বিদেশিদের চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রতি যে কারো আস্থাই প্রমাণিত হয়। এমনকি এক ঢোকে পুরো ওষুধ গিলে ফেললেও তা একই অর্থ বহন করে।

উপনিবেশবাদীদের ব্যবস্থাপত্রের প্রতি বদ্ধমূল শ্রদ্ধাবোধ অবলম্বন করা প্রায়ই কঠিন বলে গণ্য হত। আসলে প্রতিটা বড়ি বা ইনজেকশনের মাধ্যমে উপনিবেশি ব্যবস্থা আরোপ বা ভিনদেশি যাজকদের সাথে সাক্ষাতের দাওয়াত দেয়া হত। মাঝে মাঝে রোগীদের মনে যুদ্ধের ময়দানের মত সম্পূর্ণ ভিন্ন ও বিরোধী শক্তিকে মোকাবেলার ভয় অনুভূত হত। এই ভয় থেকে উদ্ভূত মানসিক চাপের কারণে অসুস্থতার পুরো চিত্রই বদলে যেত। মূলত এর মাধ্যমে উপনিবেশি দুনিয়া আরো একবার তার জটিল ও বিচিত্র কাঠামো পেশ করত, যেখানে সব সময় দুনিয়াদারি, এর বিভিন্ন কৌশল-পদ্ধতি এবং মূল্যবোধের মধ্যে স্ববিরোধী মিথস্ক্রিয়া বা প্রবল বিরোধিতা পরিলক্ষিত হত।

উপনিবেশভুক্ত ব্যক্তি ও স্থানীয় ডাক্তার

উপনিবেশি পরিস্থিতি কেবল ডাক্তার ও রোগীর সম্পর্কে ফাটলই ধরাত না। বরং আমরা দেখেছি যে, উপনিবেশি ব্যবস্থায় ডাক্তার সব সময় দখলদার শক্তির মুখপাত্র হিসেবে ভূমিকা রাখত। আমরা দেখব যে, ডাক্তার স্থানীয় হলেও রোগীর মধ্যে চিকিৎসা গ্রহণে দোটানা কাজ করত। নিজেদের কেউ যদি ভিনদেশি বিজেতাদের কোন কায়দা-কানুন বা আচার-প্রথা গ্রহণ করত তবে তার ব্যাপারেও স্থানীয়দের মধ্যে এক ধরনের দ্বিধা লক্ষ্য করা যেত। অথচ নিজ দেশের কেউ পেশাজীবি হলে তা এটাই প্রমাণ করে যে, স্থানীয়দের মধ্য থেকেও ডাক্তার, প্রকৌশলী বা উকিল হওয়া যায়। তারাই স্থানীয়দের সক্ষমতার সাক্ষাৎ প্রমাণ। কিন্তু সেখানে একই সময় পর্দার অন্তরালে নিজ জাতিগোষ্ঠী ও স্থানীয় দক্ষ পেশাজীবিদের হঠাৎ বিপথগামিতার বিষয়ে সচেতনতা তৈরী হয়। যদিও সে ব্যক্তি নিজে তার কওমের মানসিক ও আবেগতাড়িত বিভাজন প্রক্রিয়াকে উতরে গেছে। স্থানীয় ডাক্তারও ইউরোপীয় বা পশ্চিমা ধাঁচের ডাক্তার। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাকে আর স্থানীয়দের সমাজভুক্ত বলে বিবেচনা করা হত না। অত্যাচারীদের বা বিরোধী শিবিরের অন্তর্ভূক্ত হিসাবে তাকে নীরবে-নিভৃতে প্রত্যাখান করা হত। কিছু উপনিবেশি অঞ্চলে স্থানীয় লোকজন শিক্ষিত হবার পরে তারা প্রভুর স্বভাব রপ্ত করেছে বলে প্রচার করা হত। অবশ্য এটা যে ভুলবশত করা হত তা বলা যাবে না।

উপনিবেশভুক্তদের কাছে স্থানীয় ডাক্তার আর স্থানীয় পুলিশের মধ্যে কোন তফাৎ ছিল না। উভয়ের আচরণই প্রভু বা বিশিষ্টজনের মত ছিল। উপনিবেশভুক্তরা তার স্বগোত্রীয়র সাফল্যে গর্ববোধ করত। কিন্তু একই সাথে তাকে ‘খারেজি’ হিসেবে বিবেচনা করত। এ কারণেই হয়ত বহুদিন পর্যন্ত নিজ দেশীয় চিরায়ত চিকিৎসা পদ্ধতির প্রতি স্থানীয় ডাক্তারদের আচরণ যথেষ্ট আক্রমনাত্মক ছিল।

নতুন শেখা বিদ্যা তুলনামূলক যৌক্তিক দুনিয়ায় প্রয়োগের ব্যাপারে স্থানীয় ডাক্তার মানসিক তাগিদ অনুভব করত। এই কারণে সে অপ্রত্যাশিতভাবে নিজ দেশের জনগণের চর্চিত ঝাড়ফুঁক-পানিপড়া ইত্যাদি পদ্ধতিকে প্রত্যাখ্যান করত। স্থানীয় ডাক্তারের ব্যাপারে উপনিবেশভুক্তদের এবং নিজস্ব সংস্কৃতির বেশ কিছু রীতি-রেওয়াজের ব্যাপারে স্থানীয় ডাক্তারের দোটানা ডাক্তার-রোগীর সম্পর্কের মাঝখানে অপরিহার্য দেয়াল গড়ে তোলে। এক্ষেত্রে উপনিবেশভুক্ত রোগীই প্রথমে আওয়াজ তুলত। চিরায়ত চিকিৎসা পদ্ধতির উপরে যদি পশ্চিমা চিকিৎসার শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নেয়া হত তবে উপনিবেশবাদীদের কাছে যাওয়াই শ্রেয় বলে বিবেচিত হত। কেননা তারাই তো এই পদ্ধতির মূল অধিকর্তা। ফলে দেখা যেত ইউরোপীয় ডাক্তারের কাছে আলজেরিয় এবং ইউরোপীয় দুই ধরনের রোগীই যেত। কিন্তু আলজেরিয় ডাক্তার শুধুমাত্র আলজেরিয়ার রোগীই পেত। ব্যতিক্রম অবশ্যই ছিল। তবে মোটা দাগে বলা যায় পুরো আলজেরিয়ার চিত্র এমনই ছিল। উপনিবেশি সমাজকে নিয়ন্ত্রণকারী জটিল মানসিক আচার-বিধির প্রভাবে স্থানীয় ডাক্তারকে প্রায়ই এই ধরনের কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হত।

মুক্তি সংগ্রামের সময় ইউরোপিয় ডাক্তারের ভূমিকা

এমনিতে আলজেরিয়দের মুক্তি সংগ্রামের ব্যাপারে উপনিবেশবাদী ডাক্তাররা তাদের স্বদেশি দখলদারদের মত একই ধারণাই পোষণ করতেন। মানবতার অসুখ সারানোই ডাক্তারের কাজ। অথচ আলজেরিয়াতে দেখা যেত কর্তৃত্বশালী সমাজের অংশে পরিণত হওয়ার মাধ্যমে ডাক্তাররা উচ্চমাত্রার সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত। শহরে বাসরত অন্য পেশার সহকর্মীদের তুলনায় তাদের জীবনযাত্রার মান অনেক উন্নত ছিল।৪

উপনিবেশভুক্ত এলাকাগুলোতে নজর দিলে দেখা যায় ডাক্তারদের প্রায় সবাই ভূস্বামী বা জমির মালিক ছিলেন। আলজেরিয়ার উপনিবেশ বসতি স্থাপনের মত যথেষ্ট আকর্ষনীয় ছিল। এ কারণে অভিবাসীরা সহজেই আকৃষ্ট হতেন। চাষাবাদ করে না বা জমি-জমার সাথে সম্পর্ক নাই এমন কোন ডাক্তার আলজেরিয়াতে ছিলেন না। ডাক্তাররা উত্তরাধিকারসূত্রে পরিবারের কাছ থেকে জমির মালিকানা পেতেন। অথবা অভিবাসী হলে নিজেই কিনতেন। প্রত্যেক ডাক্তারের নিজস্ব আঙ্গুর খেত ছিল। সামাজিকভাবেও ডাক্তার বলতে শুধুমাত্র ডাক্তারি করাকেই বুঝানো হত না। বরং তাদেরকে কারখানা, মদের ভান্ডার বা কমলা বাগানের মালিকের মতই গণ্য করা হত। ডাক্তারিকে তারা আয়ের সম্পূরক উৎস হিসাবেই উল্লেখ করতেন। ভূসম্পত্তি থেকে প্রচুর আয়ের সুবাদে জীবিকার জন্য ডাক্তারকে পেশাগত চর্চার উপর নির্ভর করতে হত না। এ কারণে তাদের মধ্যে ডাক্তারি চর্চার পেশাগত নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সম্পর্কে নিজস্ব মত তৈরী হয়। তারা বলত, ‘জীবিকার জন্য আমাকে খদ্দেরের অপেক্ষায় বসে থাকতে হয় না’। এই বক্তব্যের মাধ্যমে অসহায়ের প্রতি সেই একই উপনিবেশি ঔদ্ধত্য, গ্রাহকদের প্রতি ঘৃণা এবং নিন্দনীয় বর্বর আচরণই ফুটে উঠে।

বেসাঙ্কন, লিয়েজ বা বাসেলের ডাক্তাররা তাদের নিজ বসত-ভিটা ছেড়ে পেশাগতভাবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি লাভ করা যায় এমন এলাকায় স্থানান্তরিত হতেন। অসহায় মানবতা এবং দুস্থ ও রোগাক্রান্তের সংস্পর্শে থাকার কারণে ডাক্তারদের মধ্যে কিছু চিরায়ত মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের জন্ম নিত। ফলে তিনি কোন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের সদস্যপদ গ্রহণ করতেন। তার চিন্তা-চেতনা-বিশ্বাস উপনিবেশ বিরোধী বলে তিনি প্রচার করতেন। কিন্তু প্রকৃত অর্থে উপনিবেশগুলোতে ডাক্তাররা উপনিবেশায়ন, কর্তৃত্বপরায়নতা ও শোষণের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন। আলজেরিয়াতেও উপনিবেশবাদী আন্দোলনের নেতৃত্বে ডাক্তার এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের অধ্যাপকরাই ছিলেন। এতে অবশ্য খুব একটা অবাক হওয়ার কিছু নাই। অর্থনৈতিক স্বার্থেই ডাক্তাররা আলজেরিয়াতে উপনিবেশি জুলুম কায়েম রাখার পক্ষপাতি ছিলেন। তাদের কাছে এটা ইনসাফ বা মূল্যবোধের প্রশ্ন ছিল না। উপনিবেশি পরিস্থিতির কৃপায় তাদের জীবনযাত্রার মান অনেক উন্নত ছিল। এটা টিকিয়ে রাখার জন্যই তারা উপনিবেশবাদের পক্ষে ভূমিকা রাখত। তাদেরকে প্রায়ই মিলিশিয়া বাহিনীর প্রধান কিংবা সন্ত্রাস বিরোধী অভিযানের সংগঠক বলে মনে হত।

আলজেরিয়াকে রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দেয়া যুদ্ধের প্রতিটি ঘটনাবলিকেই পূঙ্খানুপূঙ্খভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করা উচিত। কেননা নিরপেক্ষভাবে বিবেচনা করলে ঐ সময়ের অনেক ঘটনাকেই পীড়াদায়ক বলে মনে হবে। আলজেরিয়াতে ঐ সময়ে বেশ কজন ডাক্তারকে হত্যা করা হয়। দুনিয়ার মানুষজনের কাছে এসব হত্যার প্রকৃত কারণ কখনোই বোধগম্য ছিল না। ঐতিহ্যগতভাবে যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর চিকিৎসা বিভাগের সদস্যদের গায়ে কোন আঁচড়ও দেয়া হত না। ইতিহাসের নির্মম যুদ্ধগুলোতেও এই নীতির হেরফের হয় নাই। আলজেরিয়ার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যুদ্ধের নিয়ম-নীতি সম্পর্কে ভালোভাবে ওয়াকেবহাল ছিলেন। তারা সমস্যার পরিণতি, জটিলতা এবং ইউরোপীয় জনগণের হাল-হাকিকত সম্পর্কেও সম্পূর্ণ অবহিত ছিলেন। এরপরও তারা কিভাবে ডাক্তারের জীবন নাশের মত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন? এটা কি আসলেই কোন যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব?

চিকিৎসা পেশার সুবাধে ডাক্তারের চারপাশে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের একটি প্রতিরক্ষা বৃত্ত গড়ে উঠে। কিন্তু নিজেদের আচরণের কারণেই কিছু কিছু ডাক্তার সেই বৃত্ত ভেঙ্গে বেরিয়ে পড়েন। এই কারণেই ডাক্তার হত্যার মত ঘটনা ঘটেছিল। বিচ্ছিন্ন ঘটনায় যে কয়জন ডাক্তারকে হত্যা করা হয় তারা সবাই কোন না কোনভাবে যুদ্ধাপরাধী ছিলেন। উপনিবেশি সমাজে এর বিশেষ বাস্তবতাও ছিল। নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় ডাক্তারকে উপনিবেশবাদীদের মধ্যে সব চাইতে নির্মম ও রক্তাক্ত পরিণতি বরণ করতে হয়েছে। ডাক্তার হলেও তিনি যেহেতু সম্পত্তির মালিক, অতএব তিনি জালেম। পেশাগত কারণে তার শুধু ডাক্তারিতেই মনোনিবেশ করা উচিত ছিল। কিন্তু তিনি তা করেন নাই বলে তার চিকিৎসক পরিচয়কে বিবেচনায় আনা হয় নাই। এসব ঘটনার কারণে ক্ষমতাসীন প্রশাসন ডাক্তারদের সামগ্রিক আচার-আচরণকে সুশৃঙ্খল করার উদ্যোগ নেয়। কারণ এর সাথে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিষয়টি জড়িত ছিল। এসব ঘটনার পর থেকে আলজেরিয়দের চিকিৎসা করতে আসা কোন ডাক্তার যদি জখমের অবস্থা আশঙ্কাজনক দেখত তবে আইনি শাস্তি এড়ানোর জন্য রোগীর নাম-ঠিকানা টুকে রাখত। এমনকি রোগীর সাথে আসা লোকজনেরও বিস্তারিত নাম-পরিচয় জেনে নিত। তারপর এসব তথ্য প্রশাসনের কাছে পৌঁছে দিত।৫

ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া পেনিসিলিন, স্ট্রেপটোমাইসিন, সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যালকোহল, বিশোষক তুলা, ধনুষ্টংকার প্রতিরোধী সেরাম (অ্যান্টি-টিটেনাস সেরাম) ইত্যাদি না দেয়ার জন্য ওষুধের দোকানদারদের নির্দেশ দেয়া হত। এছাড়া রোগীর বিশদ পরিচয় ও ঠিকানা টুকে রাখার জন্য তাদের উপরও কঠোর নির্দেশনা ছিল। জনগণের সাথে তাদের চেনা-জানা বাড়ার সাথে সাথে এটা স্পষ্ট হয়ে যেত যে, উপনিবেশবাদীরা জনগণের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবার পক্ষে একমত। প্রশাসনের এসব পদক্ষেপ তাদের ধারণাকে আরো মজবুত করত। তারা নিশ্চিত থাকত যে ইউরোপীয় ডাক্তার এবং ওষুধ দোকানদাররাও এসব সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানাবে। যেসব এলাকায় আলজেরিয়দের পরিচালিত ওষুধের দোকান বেশি ছিল সেখানে ফরাসি প্রশাসন সাদা পোশাকের পুলিশ বা গুপ্তচর নিয়োগ দিত। বেশ কিছু এলাকায় ওষুধ সরবরাহ করা কঠিন ও পীড়াদায়ক কাজে পরিণত হল। সেখানে অ্যালকোহল, সালফা ড্রাগ ও সিরিঞ্জ সরবরাহে নিষেধাজ্ঞা ছিল। ১৯৫৫ সালে আলজেরিয়দের মৃত্যুর তালিকায় ফরাসি সামরিক নেতৃত্ব শুধুমাত্র নির্দিষ্ট সংখ্যক আহতদের নাম যুক্ত করত। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তাদের মৃত্যুর কারণ হিসাবে ‘যথাযথ চিকিৎসার অভাব’-কেই উল্লেখ করা হত।

উপনিবেশি ডাক্তারের আচরণের মধ্যেই কর্তৃত্বশীল সমাজের অভিজাত শ্রেণীতে তার সদস্যপদ প্রাপ্তির বিষয়টি ফুটে উঠত। পুলিশি জেরার সময় মৃত্যুবরণ করে নাই এমন আলজেরিয়দের ব্যাপারে বিচার বিভাগীয় তদন্তের সিদ্ধান্ত হত। বাদীপক্ষ তখন আইনগত ডাক্তারি পরীক্ষার আবেদন জানাত। মাঝে মাঝে এই দাবী মেনে নেয়া হত। অভিযুক্ত ব্যক্তির দেহে নির্যাতনের কোন আলামত পাওয়া যায় নাই বলেই দায়িত্বপ্রাপ্ত ইউরোপীয় ডাক্তার জানাতেন। ১৯৫৫ সালের শুরুর দিকে বারকয়েক আলজেরিয় ডাক্তারকে বিশেষজ্ঞ হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কয়েকদিন পরেই এটা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে কঠোর নির্দেশনা জারি করা হয়। অন্যদিকে ঘটনাক্রমে যদি কোন ইউরোপীয় ডাক্তার লিখতেন যে, অভিযুক্ত ব্যক্তির দেহে আঘাত ও নির্যাতনের আলামত মিলেছে, তবে সাথে সাথেই তার বিরোধিতা করার মত কাউকে হাজির করা হত। আর ঐ ডাক্তারকে অতি অবশ্যই দ্বিতীয়বার আর ডাকা হত না। যেকোন আলজেরিয় ব্যক্তির মৃত্যুকে স্বাভাবিক মৃত্যু উল্লেখ করে ইউরোপীয় ডাক্তাররা বিচারিক আদালতে মৃত্যু সনদ পেশ করতেন। অথচ সে ব্যক্তিকে হয় চরম নির্যাতন করে কিংবা ঠা-া মাথায় ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছে। একইভাবে বাদীপক্ষের দাবী অনুযায়ী ময়নাতদন্ত করা হলেও সুরতহাল প্রতিবেদন সব সময়ই তাদের বিপক্ষে যেত।

উপনিবেশি শক্তির সাথে সক্রিয় আঁতাতের মাধ্যমেই ইউরোপীয় ডাক্তাররা যাবতীয় ভয়াবহ অপকর্মগুলো সম্পন্ন করতেন। আমরা এখানে ইউরোপীয় ডাক্তার বাহিনীর বেশ কিছু কর্মকান্ডের উপর আলো ফেলব। আশা করি এর মাধ্যমে ডাক্তারদের হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যাবে।

প্রথমত, ‘সত্য সেরাম’ এর বিষয়টা বলব। এই ওষুধের মূলনীতি সবাই জানে। এটা শিরাপথে প্রয়োগযোগ্য এমন একটি রাসায়নিক দ্রব্য যার সম্মোহন ক্ষমতা আছে। অপারেশনের সময় এটা প্রয়োগ করলে রোগী ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ হারায় এবং তার অনুভূতিশক্তি লোপ পায়। চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করলে এটা অবশ্যই বিপদজনক প্রক্রিয়া হিসাবে বিবেচিত। কারণ এর প্রয়োগে ব্যক্তিত্বহানি বা মানসিক বৈকল্য হতে পারে। পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণের পর উপকারের চাইতে অপকারের মাত্রা বেশি প্রমাণিত হওয়ায় বহুকাল আগেই মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা একে বর্জন করেছেন।

সারা দুনিয়ায় চিকিৎসাবিদ্যার সব প্রতিষ্ঠান আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে আইনগতভাবে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করছে। এই আদেশ অমান্যকারী ডাক্তারকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রাথমিক মূলনীতি লঙ্ঘনকারী হিসাবে বিবেচনা করা হয়। নিজ দেশের জনগণের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইকারী ডাক্তারকেও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পেশাগত মানদন্ড ও মূলনীতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা উচিত। সারা দুনিয়ার সব দেশে অপরাধ করলে ডাক্তারকেও মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। নাৎসীদের মানবিক পর্যবেক্ষণ শিবিরগুলোর ডাক্তারদের উদাহরণ এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়।

আলজেরিয়াতে ইউরোপীয় ডাক্তাররা আশ্চর্যজনকভাবে ‘সত্য সেরাম’-কে ঘন ঘন ব্যবহার করতেন। এক্ষেত্রে আমরা হেনরি আলেগ রচিত ‘দি কুয়েশ্চেন’ বইয়ের কথা স্মরণ করতে পারি।৬

দিনের পর দিন জুলুমের শিকার নারী ও পুরুষদের চিকিৎসা দেয়ার সুযোগ হয়েছিল আমাদের। আমরা দেখেছি, মাসব্যাপী নির্যাতনের পরও কয়েদিরা তাদের নাম ও জন্মস্থান জানাতে সংকোচ বোধ করত। জেরার সময়, প্রত্যেকটা প্রশ্নের মধ্য দিয়ে জালেম ও মজলুমের মধ্যকার সম্পর্কের পুনরাবৃত্তিই হাজির হত। বিভিন্ন নির্যাতন কেন্দ্রের ডাক্তাররা প্রতিবার জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব শেষ হওয়ার সাথে সাথেই সেখানে হস্তক্ষেপ করতেন। তারা অভিযুক্তকে আবার আগের জায়গায় নিয়ে যেতেন এবং একই প্রক্রিয়ায় নির্যাতন করে তাকে পরবর্তী জিজ্ঞাসাবাদ পর্বের জন্য প্রস্তুত করতেন। জেরার মুখে কোন তথ্য যাতে মুখ ফসকে বের না হয়ে যায় সে ব্যাপারে অভিযুক্ত ব্যক্তি খুব সচেষ্ট থাকত। এই পরিস্থিতিতে এটাই তার কাছে সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। অন্যকথায় তার কাছে এটাই ছিল বেঁচে থাকার প্রকৃত অর্থ। আলজেরিয় ব্যক্তিকে জেরা করার আগে, পরে এবং জেরার সময়ও হৃদক্রিয়া উত্তেজক ওষুধ ও উচ্চমাত্রার ভিটামিন ওষুধ প্রয়োগ করা হত। উদ্দেশ্য ছিল তাকে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ঝুলিয়ে রাখা। জিজ্ঞাসাবাদ প্রক্রিয়ায় ডাক্তার যতবার হস্তক্ষেপ করতেন ততবারই অভিযুক্তদের উপর জুলুমের খড়গ নেমে আসত।

আলজেরিয়ার ইউরোপীয় চিকিৎসা বিভাগ, বিশেষ করে সামরিক চিকিৎসা বিভাগগুলোতে এই চিত্র হামেশাই দেখা যেত। চরম অসভ্য, নিকৃষ্ট এবং বিকৃত আচরণের ধারাবাহিকতায় পেশাগত নৈতিকতা, চিকিৎসা নীতিশাস্ত্র, আত্মমর্যাদাবোধ এবং অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের মত বিষয়গুলো বিসর্জন দেয়া হয়েছিল। পুলিশকে সহায়তা করার জন্য বেশ কজন মনোবিদের নিয়মিত বিমানে চড়ার প্রবণতার বিষয়টাও মাথায় রাখা দরকার। আলজিয়ার্সে এমন কিছু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ছিলেন যারা অভিযুক্তদের চিকিৎসার নামে বৈদ্যুতিক শক দিতেন। অধিকাংশ কয়েদি তাদের ভালো করে চিনতেন। শক দেয়ার পর শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ত। এই অবস্থা থেকে জেগে উঠার মূহুর্তে যখন শরীর শিথিল অবস্থায় থাকে তখন অভিযুক্তদের জেরা করা হত। কারো পক্ষেই এ সময় আত্মপক্ষ সমর্থনের খুব একটা সুযোগ থাকে না। এমন বর্বর নির্যাতনের পরও যদি ডাক্তাররা কোন তথ্য আদায় করতে না পারতেন তবেই হয়ত অভিযুক্তকে ছেড়ে দেয়া হত। কিন্তু ততক্ষণে তাকে বিকারগ্রস্থ করার প্রক্রিয়াটা আমাদের কাছে খোলাসা হয়ে যায়। এসব ব্যক্তিদের পুনর্বাসন করাটা খুব কঠিন ছিল। আলজেরিয়ার ফরাসি উপনিবেশকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য অনেক পাপকাজের হদিস মিলে। তার মধ্যে এটাকে অন্যতম গুরুতর হিসাবে ধরা যায়।৭

আলজেরিয় জনগণ, চিকিৎসা পদ্ধতি এবং স্বাধীনতার লড়াই

আলজেরিয়দের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন ধরনের বিপ্লবী চরিত্রের আবির্ভাব ও বিন্যাস চিহ্নিত করার মত বেশ কিছু ঘটনা আমাদের জানা আছে। উপনিবেশবাদের শৃঙ্খল ভেঙ্গে ফেলার কারণে একরোখা আচরণ সংযত হয়েছে, চরমপন্থা কমেছে এবং সুনির্দিষ্ট কিছু স্বেচ্ছাচারী ধ্যান-ধারণা বাতিল হয়ে গিয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক ভাবনা-চিন্তা দখলদার শক্তির মাধ্যমেই আরোপ করা হত। কিংবা বলা যায় তারাই ছিল এই ব্যবস্থার প্রকৃত প্রস্তাবক। উপনিবেশকালে ডাক্তার দেখাতে যাওয়া আর প্রশাসনিক কর্মকর্তা, পুলিশ কনস্টেবল বা মেয়রের সাথে দেখা করা একই কথা ছিল। উপনিবেশি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রবণতা ও উপনিবেশবাদীদের প্রশাসনিক প্রতিনিধিদের উপর অনাস্থার বিষয়টি অনেকটা যান্ত্রিক রূপ ধারণ করে। ফলে জনগণের জন্য কল্যাণকর ও লাভজনক বিষয়েও সেই একই ধরনের নির্লিপ্ততা ও অনাস্থাই প্রকাশ পেতে থাকে।

আমরা দেখেছি, আন্দোলনের একেবারে প্রথম মাসেই ফরাসি প্রশাসন অ্যান্টিবায়োটিকস, ইথার, অ্যালকোহল ও ধনুষ্টংকার প্রতিরোধী ভ্যাকসিন (অ্যান্টি টিটেনাস ভ্যাকসিন)-এর উপর অবরোধ আরোপের সিদ্ধান্ত নেয়। এগুলো কিনতে গেলে যেকোন আলজেরিয় নাগরিককে ওষুধের দোকনদারের কাছে তার নিজের এবং সংশ্লিষ্ট রোগীর বিশদ পরিচয় দিতে হত। আলজেরিয়ার জনগণ যদি অন্য কারো চিকিৎসার উপর নির্ভর করবে না বলে সিদ্ধান্ত নিত তবে উপনিবেশি শক্তি ওষুধ ও সার্জারির সরঞ্জাম বেচা-বিক্রি নিষিদ্ধ করে দিত। যখনই কোন আলজেরিয় নাগরিক বেঁচে যেত এবং নিজেই নিজের যতœ-আত্তি করা শুরু করত, তখনই দখলদারদের অত্যাচারে তার জীবন অতিস্ট হয়ে উঠত। বহু পরিবার তাদের নিজ বাড়িতে আশ্রয় নেয়া আহত মুজাহিদকে ধনুষ্টংকারে আক্রান্ত হয়ে মরতে দেখেছে। চোখের সামনে এমন বর্বরতা দেখেও অন্তরে তীব্র ঘৃণা নিয়ে অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া তাদের আর কিছুই করার থাকত না। বিপ্লবের শুরুর মাসগুলোতে ন্যাশনাল ফ্রন্টের প্রতি নির্দেশনা ছিল এমন যে, জখম যত মৃদুই হোক না কেন আহতকে সাথে সাথেই ধনুষ্টংকার প্রতিরোধী ভ্যাকসিন দিতে হবে। এটা জনগণ জানত। খারাপ ধরনের জখম হলে চিকিৎসার স্বার্থে প্রথমে ক্ষতস্থান ভালোমত পরিষ্কার করে ময়লা দূর করা হত। এরপর হঠাৎ করেই হয়ত আক্রান্ত ব্যক্তির সহযোগীদের আশঙ্কা হত যে তার ধনুষ্টংকারের সংক্রমন হতে পারে। কিন্তু ওষুধের দোকানদার তা বেচবে না। সে এ ব্যাপারে অনড় কেননা এই ভ্যাকসিন বেচা নিষিদ্ধ। ডজন ডজন আলজেরিয় নাগরিক এর প্রত্যক্ষ সাক্ষী। তারা সবাই জখমি ব্যক্তির ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার ভয়াবহ বর্ণনা দিতে পারবে। টিটেনাস বা ধনুষ্টংকারের বিষ কিভাবে আক্রান্ত ব্যক্তির সারা শরীরকে অসাঢ় করে দিত, তারপর সারা শরীর পেঁচিয়ে জখমি ব্যক্তি কিভাবে আবার পক্ষাঘাতগ্রস্থের মত পড়ে থাকত তা এখনও আলজেরিয়দের স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে।

আলজেরিয়রা যখন কোন ইউরোপীয় নাগরিকের মাধ্যমে তাদের কেনাকাটা করতো, তখন দেখত ইউরোপীয়রা কোন বাধা-বিপত্তি ছাড়াই ওষুধসহ সব ধরনের দ্রব্যাদি কিনে নিয়ে এসেছে। অথচ আলজেরিয়রা এলাকার সব ওষুধের দোকানে গিয়ে মিনতি করলেও কেউ ওষুধ দিত না। বরং ওষুধের দোকানদারদের কঠোর চোখ রাঙানি ও জেরার মুখে সে ফিরে আসত। অথচ ইউরোপীয়রা নিরীহ ব্যক্তির মত নির্ভাবনায় দোকান থেকে ওষুধের টাল নিয়ে ফিরত। এইসব অভিজ্ঞতার কারণে আলজেরিয়রদের তরফে ইউরোপীয় সংখ্যলঘুদের প্রতি সুষম আচরণ করা সহজ ছিল না। রাজনীতিমুক্ত বিজ্ঞান বা মানবসেবার বিজ্ঞান উপনিবেশগুলোতে খুঁজে পাওয়া যেত না। মাত্র একশ গ্রাম জীবাণুমুক্ত তুলার জন্য আলজেরিয়দের ঘন্টার পর ঘন্টা কাকুতি-মিনতি করে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে হত। অথচ উপনিবেশবাদীরা পুরা একখন্ড তুলা নিয়ে ঘরে ফিরত। একইভাবে অ্যালকোহলও নিষিদ্ধ ছিল। অ্যালকোহলের অভাবে কুসুম গরম পানি দিয়ে জখমের পরিচর্যা বা ড্রেসিং করা হত এবং ইথারের অভাবে অবশ না করেই অঙ্গচ্ছেদ করা হত।

বিরোধীদের কর্তৃক ওষুধ ও অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় রসদসামগ্রী প্রত্যাহার করে নেয়ায় স্থানীয়দের তরফে এগুলোকে নতুনভাবে মূল্যায়ন করা শুরু হয়। মুক্তিসংগ্রামের আগে ওষুধকে চিকিৎসাসামগ্রী স্বীকৃতি দেয়া হলেও এহেন পরিস্তিতিতে তাকে অস্ত্র হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ফলে ওষুধ সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা বিপ্লবী বাহিনীর নগর শাখার গুরুত্ব বেড়ে যায়। এ শাখার যে কাউকে বিরোধী শক্তির পরিকল্পনা ও গতিবিধির উপর নজরদারির দায়িত্বপ্রাপ্তদের সমান মর্যাদা দেয়া হত। আলজেরিয় ব্যবসায়ীরা নাগরিকদের রেডিও সরবরাহের পথ খুঁজে বের করত। ঠিক একইভাবে আলজেরিয় ওষুধের দোকানদার, নার্স ও ডাক্তাররা স্বদেশি আহত ব্যক্তিদের অ্যান্টিবায়োটিক ও ড্রেসিং সামগ্রীর জোগান দিতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাত। সুদূর তিউনিসিয়া থেকে মরক্কো পর্যন্ত এই প্রচেষ্টা অব্যহত ছিল। চিকিৎসা সামগ্রীর নিরবচ্ছিন্ন জোগানের কারণে ১৯৫৬ ও ১৯৫৭ সালের সংকটকালীন সময়ে অসংখ্য মানুষের জীবন বেঁচেছে।

মুক্তি সংগ্রামের সময় পুরো আলজেরিয়াকে ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মির কয়েকটি ঘাঁটিতে ভাগ করা হয়। যুদ্ধের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে ঘাঁটিগুলোতে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও এ সম্পর্কিত সমস্যাগুলো মারাত্মক আকার ধারণ করে। বিরোধী হামলার ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বাড়ার কারণে প্রাত্যহিক ও নিয়মিত কর্মকান্ড বিঘিœত হচ্ছিল। রোগীর ডাক্তার দেখাতে আসা কার্যক্রমও এর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত ছিল। ফলে তারা স্থানান্তর করা সম্ভব এমন কোন নিজস্ব জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা স্থাপণের তাগিদ অনুভব করে। যেখানে অন্তত নিয়মিত পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণের জন্য ডাক্তারের কাছে আসার বিষয়টাকে প্রতিস্থাপন করা যাবে। এর মাধ্যমে স্থানীয় এলাকার স্বাস্থ্যবিষয়ক দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি বিপ্লবী ব্যবস্থার জরুরি সদস্যে পরিণত হন। কিন্তু সমস্যাগুলো অচিরেই আরো বেশি জটিল হয়ে পড়ে। সাধারণ নাগরিকদের উপর বোমাবর্ষণ ও হামলাও তখন অসুস্থতা বা বালাই হিসাবে হাজির হয়। প্রত্যেক আলজেরিয় সৈনিককে আঘাতের বিপরীতে কমপক্ষে দশজন সাধারণ নাগরিককে হত্যা করা হত বা জখম হতে হত। এই পরিস্থিতিতে চিকিৎসা সামগ্রীর জোগান এবং ডাক্তারের উপস্থিতি অপরিহার্য হয়ে পড়ত। এটাই সেই সময় যখন চিকিৎসা বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী, নার্স এবং ডাক্তারদের যুদ্ধে যোগ দেয়ার হুকুম দেয়া হয়েছিল। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় চিকিৎসাবিদ ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দদের নিয়ে বৈঠকের আয়োজন করা হয়। অল্প সময়ের মধ্যেই জনস্বাস্থ্য সমস্যা চিহ্নিত ও সমাধান করতে নাগরিকদের একটি প্রতিনিধিদলকে দায়িত্ব দেয়া হয়। বিপ্লবের প্রতি গভীর সংহতি ও তেজোদ্দীপ্ত চেতনা সহকারেই তারা প্রত্যেকটা ঘাঁটিতে নিয়োগপ্রাপ্ত হিসাবে এই দায়িত্ব পালন করেন।

এখানে খবরদারি বা ভীরুতা বলে কিছু ছিল না। বরং এর বিপরীতে স্বাস্থ্য বিষয়ক পরিকল্পণাগুলো সফলভাবে বাস্তবায়নে সম্মিলিত প্রয়াস ছিল। অনুন্নত জনগোষ্ঠীর উপর বিজয় লাভের উদ্দেশ্যে চিকিৎসাবিদরা কোন ‘বিশেষ মানসিক প্রকল্প’ আরম্ভ করেন নাই। তবে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের অধীনে থেকে জনগণের স্বাস্থ্যের তত্ত্বাবধান এবং নারী, শিশু ও যোদ্ধাদের জীবন রক্ষা করাটা কঠিন ছিল। আমাদের এই বাস্তবতা মেনে নিতে হবে যে ১৯৫৪ সাল থেকে আলজেরিয়াতে জাতিগত ক্ষমতার উত্থান ঘটে। এই জাতীয় সরকার জনগণের স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়। জনগণও তাদের পুরানো স্বভাব বা নিষ্ক্রিয়তা পরিত্যাগ করতে থাকে। এমনকি মৃত্যুর সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত লোকজনও নির্দেশ পালনের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী বুদ্ধি-বিবেচনা ও উদ্দীপনা দেখাতে থাকে।

আমরা দেখেছি, জাতীয় যুদ্ধের আগে আলজেরিয় ডাক্তার বা স্থানীয় ডাক্তারকে দখলদারদের প্রতিনিধি হিসাবে বিবেচনা করা হত। কিন্তু এ সময় তাকেও দলভুক্ত করে নেয়া হয়। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মাটির বিছানায় নোংরা পরিবেশে একসাথে ঘুমিয়ে বা জনগণের জীবনকে আরো নাটকীয় ও প্রাণবন্ত করে তোলার মাধ্যমে আলজেরিয় ডাক্তার আবার মাতৃভূমি আলজেরিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হন। মুখ বুঝে নিপীড়ণ সওয়ার সময়কার চিরন্তন চাপাস্বভাব তখন আর থাকে না। তখন তিনি ‘ঐ ডাক্তার’- এর  স্থলে ‘আমাদের ডাক্তার’ বা ‘আমাদের চিকিৎসক’-এ পরিণত হন।

অতঃপর জনগণ বিদেশি বৈশিষ্ট্য বাদ দেয়া চিকিৎসা পদ্ধতির দাবী করত এবং সে অনুসারেই নিজেরা চর্চা করত। মুক্তি সংগ্রামের কারণে আলজেরিয়ার অসংখ্য অঞ্চলে চিকিৎসা পদ্ধতির সূত্রপাত হয় ও সাধারণ জনগণের সাথে স্থানীয় ডাক্তারের পরিচয় ঘটে। এর আগে হয়ত লোকেরা মাসে একবার বা বছরে দুইবার ইউরোপীয় ডাক্তারের কাছে যেত। কিন্তু এখন তারা দেখল আলজেরিয় ডাক্তার তাদের গ্রামে স্থায়ীভাবে বসত গড়ছে। বিপ্লব এবং চিকিৎসা সমানতালে তাদের উপস্থিতিকে আরো দৃশ্যমান করে তুলল।

স্বভাবগত পরিবর্তন ও তার সাথে গতিশীলতার অনুপম সমন্বয়ের পিছনে যে এই ঘটনাগুলোই ভিত্তি হিসাবে কাজ করেছে তা সহজেই বুঝা যায়। পরিচ্ছন্নতা ও রোগ প্রতিরোধ সম্পর্কিত সমস্যাগুলো মানুষের কাছে তুলে ধরার জন্য যথেষ্ট সৃষ্টিশীল পরিবেশের উদয় হয়েছিল। উপনিবেশি প্রশাসন গ্রামে গ্রামে শৌচাগার স্থাপনের সুপারিশ করলেও তা শোনা হয় নাই। কিন্তু এখন প্রচুর সংখ্যক শৌচাগার স্থাপন করা হল। আন্ত্রিক পরজীবির সংক্রমন সংক্রান্ত ধারণা লোকজন সাথে সাথেই গ্রহণ করল। নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর জলাশয়গুলো বর্জনের উদ্যোগ নেয়া হল। নবজাতকদের প্রসব পরবর্তী চোখের প্রদাহজনিত রোগ মোকাবেলায় দৃশ্যমান সাফল্য অর্জিত হল। মায়ের অবহেলার কারণে বাচ্চার রোগ-বালাই হওয়ার সম্ভাবনা কমতে থাকে। বরং সময়মত অরিওমাইসিন না পাওয়াটাই তখন সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। লোকজন সুস্থ হতে চাইত, যতœ-আত্তি প্রত্যাশা করত এবং তার রোগ সম্পর্কে ডাক্তার ও নার্সদের পেশ করা ব্যাখ্যা বুঝার চেষ্টায় চিন্তিত থাকত।৮ নার্সদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হল। দেখা গেল মাত্র অল্প ক’দিনেই অশিক্ষিতরা শিরাপথে ইনজেকশন দেয়ার যোগ্যতা অর্জন করে ফেলল।

একইসাথে পুরনো কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসে ফাটল ধরতে শুরু করে। জাদুবিদ্যা, ম্যারাব্যুটিজম (যদিও বুদ্ধিজীবিদের অব্যহত প্রচারণায় ম্যারাব্যুটিজমের যথেষ্ট সুনামহানি হয়েছিল) ও জ্বিনে বিশ্বাস আলজেরিয়দের যাপিত জীবনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে ছিল। কিন্তু বিপ্লবের কারণে সূচিত নতুন কর্মপন্থা ও রীতি-নীতির প্রভাবে এগুলো সব ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হয়।৯ এমনকি প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত সমাজব্যবস্থাতেও কঠিন বলে বিবেচিত নির্দেশাবলি আলজেরিয়রা সহজেই মেনে নেয়। আমরা এখানে এ সম্পর্কিত দু’টি গুরুত্বপূর্ণ নজির পেশ করব।

প্রথমত, একটা নিয়ম ছিল এমন যে পেটে জখম হলে কাউকে পানি পান করতে দেয়া যাবে না। এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছিল এবং জনগণকে বক্তব্য-বিবৃতির মাধ্যমে তা জানানো হত। এ নিয়মের অধীনে কারোই এ বিষয়ে অনবহিত থাকাকে মেনে নেয়া হত না। নিয়মটা হচ্ছে, ‘পেটে জখম হওয়া সৈনিককে পানি দেয়া যাবে না, এমনকি কেবল এক ফোঁটা হলেও’। একটি যুদ্ধের পর সবাই আহত ব্যক্তিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করছিল। এসময় তারা দুর্বলতা প্রদর্শন না করে আহত যোদ্ধার অনুরোধ শুনছিল। আহত যোদ্ধা পানির জন্য আকুতি করলেও অন্তত কয়েক ঘন্টা তাকে পানি দেয়া যাবে না বলে সেখানে উপস্থিত নারীরা জানিয়ে দিল। তারা এ বিষয়ে খুব কঠোরতা দেখাত। এমনকি আহত মুজাহিদের সন্তানও তাকে পানি দিতে অস্বীকৃতি জানাত। সে বরং বলত, ‘এই নাও তোমার অস্ত্র। আমাকে তুমি মেরে ফেল। তারপরও আমি তোমাকে পানি এনে দিতে পারব না’। ডাক্তার আসার পর জরুরি ভিত্তিতে অপারেশন করা হত। এরপর হয়ত ঐ মুজাহিদ যোদ্ধা আস্তে আস্তে পুরোপুরি সেরে উঠত।

দ্বিতীয় উদাহরণটি টাইফাস সংক্রমণের সময় খাবার গ্রহণে কঠোর নিয়মানুবর্তিতা অনুসরণ করার সাথে সম্পর্কিত। রোগী দেখতে পারিবারিক সদস্যদের হাসপাতালে যাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ছিল। হাসপাতালের নিয়ম-নীতি কঠোরভাবে পালন করা হত। কেননা অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, যখনই কোন পারিবারিক সদস্য টাইফাস আক্রান্ত রোগীকে দেখতে যেত সে রোগীর ক্ষুধার যন্ত্রণা দেখে গলে যেত এবং কোন না কোন ভাবে রোগীর জন্য কিছু পিঠা ও মুরগীর তরকারি রেখে আসত। ফলশ্রুতিতে রোগীর অন্ত্রনালী ফুটা হয়ে যেত।

উপনিবেশি পরিস্থিতিতে এই ঘটনা বিশেষ তাৎপর্য বহন করত। উপনিবেশভুক্ত জনগণ এই ধরনের ডাক্তারি অনুশাসনকে নিপীড়ণ ও দুর্ভিক্ষের নতুন ধরন বলে মনে করত। তাদের কাছে এটা ছিল দখলদারদের অমানবিক আচরণ প্রকাশের নয়া মাধ্যম। টাইফাস আক্রান্ত রোগীটি যদি শিশু হয় তবে তার মায়ের অনুভূতি কেমন হত তা সহজেই অনুমেয়। অন্যদিকে আলজেরিয় নার্স ও ডাক্তাররা রোগীর পরিবারের সদস্যদের এ বিষয়টি বোঝাতে সক্ষম হন। তারা স্বাস্থ্য সতর্কতা, ওষুধ গ্রহণের নিয়ম-কানুন, হাসপাতালে রোগীর সাথে দেখা করার উপর নিষেধাজ্ঞা, পৃথকীকরণ এবং অন্তত কয়েকদিন খাবার গ্রহণে কঠোর নিয়ম মেনে চলা- এসব বিষয়ে তাদের কাছ থেকে পূর্ণ সহযোগিতা আদায় করে নেন। যে আলজেরিয় মা জীবনে কখনো ডাক্তার দেখে নাই, সেও চিকিৎসকের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করা শুরু করলো।

জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সময় আলজেরিয়ার অনুন্নত জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে নতুন ধরনের পরিস্থিতির আবির্ভাব ঘটেছিল তাতে গভীরভাবে নজর দেয়া উচিত। স্বাস্থ্য শিক্ষার মৌলিক বিষয়াদি নিয়ে যারা কাজ করেন বা এ বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের এগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-গবেষণা করা উচিত। দেখা গেল, দেহ যখন আবার আগের মত সংহত ও গতিশীল প্রক্রিয়ায় বাঁচার প্রয়াস পেল তখনই সব কিছু সম্ভব হয়ে উঠল। ‘স্থানীয় মানসিকতা’ বা ‘বুনিয়াদি ব্যক্তিত্ব’-এ বিষয়গুলো নিরর্থক বলে গণ্য হল। যারা নিজ হাতে নিজেদের ভাগ্য গড়ার দায়িত্ব নিল তারা অচিরেই অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তিকে অসাধারণ প্রতিভায় ব্যবহার করা শুরু করল।

টীকা ও প্রাসঙ্গিক তথ্য:

১. ফরাসি সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত হাসপাতালগুলোতে আলজেরিয় নাগরিক ও দক্ষিণ সাহারার পদাতিক সেনাদের উপর পরীক্ষামূলকভাবে মৃগীরোগজনিত জ্ঞান হারানোর মাত্রা দেখা হত। মৃগী রোগের কারণে বিভিন্ন জাতি-গোত্র নির্বিশেষে জ্ঞান হারানোর সুনির্দিষ্ট সীমা ও মাত্রা জানার জন্য এই গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হত। হাসপাতালের মানসিক বিভাগে ভর্তি থাকা ফরাসি সেনাদের বরাতেই এই তথ্য জানা গেছে। বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে গবেষণা কাজ চালানোর নামে একই ব্যক্তিকে বারবার হাসপাতালে আনা হত। নিজ জন্মভূমি থেকে এই কুকীর্তি উৎখাতের জন্য লড়াই করা ছাড়া আলজেরিয় সমাজ বা আলজেরিয়ার জনগণের আর কোন পথ খোলা ছিল না। অবশ্য তারা ব্যতিত এই দায়িত্ব নেয়ার মত আর কেউই ছিল না।

২. এই সুনির্দিষ্ট পর্যবেক্ষণ থেকেই উপনিবেশভুক্তদের সার্বিক মনোভাব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তারা খুব কম সময়ই সত্য কথা বলত। তারা কখনোই উপনিবেশবাদীদের বশ্যতা স্বীকার করত না বা তাদের হাতে নিজেকে সমর্পন করত না। এ সম্পর্কে ১৯৫৫ সালে অনুষ্ঠিত ফরাসি ভাষাভাষি মনোবিদ ও মস্তিষ্করোগ বিশেষজ্ঞদের সম্মেলনের আগের বার্তাটি পাঠক পড়ে দেখতে পারেন। এর শিরোনাম ছিল, “ঞযব অষমবৎরধহ ধহফ আড়ধিষ রহ গবফরপড়-খবমধষ চৎধপঃরপব.”

৩. অবশ্যই সেখানে ভালো ডাক্তারও ছিলেন। তারা রোগীর সাথে স্বাভাবিক ও মানবিক আচরণ করতেন। তবে তাদের সম্পর্কে বলা হত, ‘তারা ঠিক অন্যদের মত নয়’।

৪. উপনিবেশগুলোতে ডাক্তারি চর্চাকে নিয়মতান্ত্রিক জোচ্চুরি বলে মনে করা হত। জোচ্চুরির বহু নজির রয়েছে। বিশুদ্ধ পানি সিরিঞ্জে ভরে পরপর দুইবার ইনজেকশন দেয়ার পর পেনিসিলিন বা ভিটামিন বি-১২ এর রসিদ কাটা হত। আবার তেজস্ক্রিয় বিকিরণে সক্ষম কোন ধরনের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ছাড়াই ডাক্তররা বুকের এক্স-রে করতেন। কিংবা ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণের জন্য রেডিওথেরাপি দিতেন। রোগীদের একটা ধাতুর তৈরী পাতের পিছনে দাঁড় করানো হত। পনের থেকে বিশ মিনিট ঠায় দাঁড় করিয়ে রাখার পর প্রক্রিয়াটি শেষ হয়েছে বলে তাদের জানানো হত। এমনকি গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে ডাক্তাররা ভ্যাকুয়াম ক্লিনার দিয়ে এক্স-রে করার মত দুঃসাহসও দেখিয়েছেন। পুরো আলজেরিয়া জুড়ে এই ধরনের আরো অনেক নজির খুঁজে পাওয়া যাবে। এখানে অরল্যান্সভিলের একটি অঞ্চল রাবেলাইস-এর এক ইউরোপীয় ডাক্তারের কথা উল্লেখ করা যায়। শুধুমাত্র হাটের দিন সকালেই তিনি ত্রিশ হাজার ফ্রাঙ্ক কামাই করতেন। তার নিজের বয়ানেই গল্পটা শোনা যাক, ‘আমি ভিন্ন ভিন্ন মাপের তিনটি সিরিঞ্জ নিয়ে তাতে লবণ-পানি ভরলাম। তারপর যথাক্রমে ৫০০, ১০০০ ও ১৫০০ ফ্রাঙ্ক মূল্য নির্ধারণ করে রোগীকে জিগেশ করলাম, সে কোনটি নিবে?’ ডাক্তারের ভাষ্যমতে, ‘রোগীরা সবসময় সবচাইতে দামী ইনজেকশনটাই বেছে নিত।’

৫. এসব পদক্ষেপের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেই ফ্রান্সের ‘ডাক্তারি অনুশাসন পরিষদ’ ফরাসি ঐতিহ্যের সাথে সঙ্গতি রেখে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে।

এই পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক পাইডেলিয়েভ্রে আলজিয়ার্স, কন্সটান্টিন ও ওরানের ডাক্তারি অনুশাসন পরিষদের প্রতি একটি আনুষ্ঠানিক চিঠি লিখেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘আমি আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই কোন অবস্থাতে, কোন কিছুর দোহাই দিয়ে পেশাগত গোপনীয়তার লঙ্ঘন করা যাবে না। আমি নির্দিষ্ট করে বলতে চাই, ধর্ম-বর্ণ, বন্ধু-শত্রু নির্বিশেষে সবাইকে নিষ্ঠার সাথে চিকিৎসা প্রদান করতে ডাক্তাররা দায়বদ্ধ। সবশেষে আমি নীতিশাস্ত্রের আইনি বিধান সম্পর্কে আপনাদের মনযোগ আকর্ষণ করতে চাই। এই বিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলা আছে, ‘ডাক্তারকে অবশ্যই নিষ্ঠার সাথে সব রোগীকে চিকিৎসা প্রদান করতে হবে। তাদের সামাজিক অবস্থা, জাতীয়তা, ধর্ম, ব্যক্তিগত সুনাম-সুখ্যাতি বা তাদের সম্পর্কে ডাক্তারের ব্যক্তিগত অনুভূতি কোন কিছুই এক্ষেত্রে বিবেচনায় আনা যাবে না’।” আমরা আরো যোগ করতে পারি যে, বহু ইউরোপীয় ডাক্তার আলজেরিয়ায় ফরাসি প্রশাসন কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ প্রয়োগে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল।

৬. H. AlJeg, La Question, Editions de Minuit, 1958

৭. যুদ্ধাহত কোন আলজেরিয় সৈনিকের চিকিৎসার জন্য সামরিক বাহিনীর ডাক্তারদের ডাকা হলে তারা চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানাতেন। আনুষ্ঠানিক অজুহাত হিসাবে তারা বলতেন জখম খুব মারাত্মক। একে বাঁচানোর মত আর কোন উপায় অবশিষ্ট নাই। ঐ সৈনিকের মৃত্যু হলে ডাক্তার মেনে নিতেন যে এর চাইতে জেলে থাকাই তার জন্য ভালো ছিল। কারণ সেখানে ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামীকেও নিয়মিত খাবার প্রদান করা হয়। কিছু কিছু হাসপাতালের পরিচালক হাসপাতালের করিডোরে পড়ে থাকা যুদ্ধাহত সৈনিকদের রক্তাক্ত বুকে পা দিয়ে আঘাত করতেন। বিল্ডা এলাকার আলজেরিয়রা এমন বেশ কজন পরিচালকেকে চিনতেন।

৮. দখলদারদের হাসপাতাল কেন্দ্রগুলোর প্রতি আলজেরিয়দের মনোভাব বদলের বিষয়টি একইভাবে নজর দেয়া দরকার। মাকুইস অঞ্চলে বেশ কিছু ওষুধ পাওয়া যেত না এবং কিছু কিছু জটিল অপারেশন করাও সম্ভব হত না। এই ওষুধের প্রয়োজনে বা সার্জারি করানোর দরকার হলে ডাক্তার রোগীকে ফরাসিদের পরিচালিত হাসপাতালে বদলি করতেন। বিপ্লবের আগে যে দ্বিধা ও অস্বীকৃতি ছিল তা আর তখন চোখে পড়ত না। লোকজন মাকুইসবাসী ডাক্তারের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করত। ১৯৫৬-৫৭ সালের দিকে এই মনোভাবের পরিবর্তন বিশেষভাবে লক্ষণীয় ছিল। ঐ সময়ে আমার নিজের বেশ কয়েকটি হাসপাতাল পরিদর্শনের সুযোগ হয়েছিল। এই অবস্থা দেখে ইউরোপীয় ডাক্তাররা পর্যন্ত আমার কাছে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তাদের বরাতে আমি জানতে পারি, যুদ্ধের পরে মুসলমানদের হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার হার বেড়েছে। তখন প্রতি পাঁচজন মুসলমানের একজন হাসপাতালে এসে চিকিৎসা নিত। আগের বছরগুলোর তুলনায় এটা অনেক বেশি। অবশ্য এটাও বলতে হয় যে এর পিছনে মাকুইস-এর হাসপাতাল প্রশাসনের কৌশলগত স্বার্থও ছিল। তারা চাইত ফরাসিরা যেন সাধারণ নাগরিকদের খাতির করে চলে এবং অপসারণ অযোগ্য সৈনিকদের জন্য পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ রাখে।

৯. মুসলিম সূফিসাধকদের ম্যারাব্যুট বলা হত। তাদের চর্চিত চিকিৎসা পদ্ধতিকে ম্যারাব্যুটিজম বলা হত- [ইংরেজি অনুবাদক]।

শাহ মোহাম্মদ ফাহিম : চিকিৎসক, গদ্যকার ও অনুবাদক। fahim.ccc@gmail.com