চীন-ভারত দ্বন্দ্ব : বাংলাদেশ সুবিধা পাবে না জটিলতায় পড়বে

0
643

চীন-ভারত দ্বন্দ্ব : বাংলাদেশ সুবিধা পাবে না জটিলতায় পড়বে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:  দ্রুত বদলে যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার ভূকৌশলগত সর্ম্পক। এ অঞ্চলের বাড়ছে চীনের প্রভাব। চীন ও ভারতের বৈরিতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে দর কষাকষিতে সুবিধা পেতে দুটি বৃহৎ দেশের সঙ্গেই ভারসাম্যমহৃলক সর্ম্পক রাখতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আয়তনে ছোট হলেও বাংলাদেশের গুরুত্ব ব্যাপক। উদীয়মান অর্থনীতির কারনে বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের তীরে কৌশলগতভাবে গুরুপূর্ণ অবস্থানে একটি আকর্ষণীয় বাজার।

চীন ও ভারতের মধ্যে চলমান সংঘাত যদি শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে গড়ায় তাহলে সরাসরি কোনো একটি দেশের পক্ষে অংশ নিতে বাংলাদেশকে চাপে পড়তে হতে পারে বলে মন্তব্য করেছে বিবিসি । বাংলাদেশের সঙ্গে চীন এবং ভারত, উভয় দেশেরই সুসম্পর্ক আছে। বিবিসি বলছে, এক ধরনের চাপ গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের ওপর আছে। তবে যুদ্ধ শুরু হলে বাংলাদেশের জন্য পরিস্থিতি যে বেশ জটিল হয়ে পড়বে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের রয়েছে ঐতিহাসিক সর্ম্পক। চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেন কম হলেও গত দুই দশকে এই চিত্র পাল্টে গেছে। ২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো চীন ভারতকে টপকিয়ে বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদারে পরিণত হয়। বাংলাদেশ বর্তমানে মোট আমদানির ৩৪ ভাগই আসে চীন থেকে। বর্তমানে চীন থেকে বাংলাদেশ আমদানি করে ১৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আর রফতানি করে ১ বিলিয়ন ডলারের কম। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমরাস্ত্র সরবরাহকারী দেশ চীন। চীন যত সমরাস্ত্র রফতানি করে তার ২০ ভাগই কেনে বাংলাদেশ। বাংলাদেশি সেনা অফিসাররা চীন থেকে প্রশিক্ষণও পায়।

২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় এদেশে ২৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের চুক্তি হয়। এটা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগের পরিমাণ দাড়াবে ৩৮ বিলিয়ন ডলারে। এটা একক কোনো দেশের বাংলাদেশে বৃহত্তম বিনিয়োগের অঙ্গীকার।

অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন চীনের কাছ থেকেই বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে বেশি লাভবান হতে পারে। লাদাখে চীনা সেনাদের হামলায় ভারতের শতাধিক সেনা হতাহত হওয়ার পরপরই চীন বাংলাদেশে তিন হাজারের বেশি বাংলাদেশি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে। করোনারভাইরাস মহামারির এই কঠিন সময়ে বাংলাদেশের জন্য চীন হাত বাড়িছে । বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজারে এখন সব মিলিয়ে ৮২৫৬টি পণ্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে বাংলাদেশ।

তাছাড়া চীনে শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে চীনা কোম্পানির বাংলাদেশে স্থানান্তরের সুযোগ তৈরি হয়েছে। ফলে চীনা উদ্যোক্তারা এখন অন্য দেশে কারখানা স্থাপনের চেষ্টা করছে। তাদের অগ্রাধিকার তালিকায় আছে বাংলাদেশ, যেখান থেকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় চীনসহ বিভিন্ন দেশে পন্য রফতানি করা যায়। বিশেষজ্ঞার বলছেন, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ কাজ দ্রুত শেষ করতে পারলে চীনাদের বিনিয়োগ পেতে সহজ হবে । পোশাক রফতানি নির্ভরতা কাটিয়ে অন্যান্য পণ্য বহুমুখীকরণ করতে পারলে চীনের শুল্কমুক্ত সুবিধা কাজে লাগানো যাবে।

অপর দিকে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে, কিন্তু সেটা রাজনৈতিক সম্পর্ক, সামরিক নয়। স্বাধীনতার পর থেকে টানা ৪০ বছর বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার ছিল ভারত। বাংলাদেশ এখনো পর্যন্ত ভারত থেকে কোন সমরাস্ত্র কেনেনি। সম্প্রতি বাংলাদেশে অস্ত্র বিক্রিতে ভারত বেশ তৎপর । চীনের ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগে কোণঠাসা হয়ে পড়ার আশংকায় ২০১৭ সালে ভারত বাংলাদদেশে ৫ বিলিয়ন ঋণ দেওয়ার ঘোষণা দেয়। বাংলাদেশে এটাই ভারতের বৃহত্তম অর্থলগ্নী । কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ভারতের বিনিয়োগ প্রকল্পগুলোতে এতো বেশি শর্তারোপ করা হয় অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এ অর্থ ব্যবহার করতে পারে না। তাছাড়া, ভারতের সাথে বাংলাদেশের  সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু নেতিবাচক দিকও আছে। যারকারনে সরকার অনেক সময় বিব্রতকর অবস্থায় থাকে । জনগনও সহজভা্বে বন্ধুদেশের আচরনে বিরক্ত। যেমন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এসে ‘সবার অগে প্রতিবেশী’ স্লোগান দিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন ঘটেনি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের সমর্থন না থাকা, অব্যাহত সীমান্ত হত্যা, অভিন্ন নদীর ন্যায় সঙ্গত হিস্যা না হওয়া, এনআরসি ইস্যু এবং তথাকথিত অবৈধ অভিবাসীদের বাংলাদেশি বলে চালিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা। এছাড়া আরও অনেকগুলি বিষয় ।

ভারত ও চীনের মধ্যে সাম্প্রতিক উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনীতি, রাজনীতি, কূটনীতি-সব দিক দিয়ে দুই দেশের সঙ্গেই বেশ জটিল একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে সন্দেহ নেই। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ভারত-চীনের এই উত্তেজনা ও সংঘর্ষ সহজে থামবে না। সুতরাং, চীন ও ভারতের মধ্যে বৈরিতা বাড়ার ফলে দুটি দেশ চাইবে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশকে তাদের বলয়ের মধ্যে রাখতে।ভারত ও চীন উভয় দেশই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অংশীদার। তাই চীন-ভারত কারো পক্ষ নেওয়া বাংলাদেশের জন্য সঠিক হবে না। দুইটি দেশই বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে অনেক অর্থ বিনিয়োগ করে থাকে। বাংলাদেশের চেষ্টা থাকা উচিত হবে এই দুই বলয়ের বাইরে থাকা। নিরপেক্ষতা বজায় রেখে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চেষ্টায় থাকা, যেন কারও মুখোমুখি হতে না হয়, বাংলাদেশকে মনে রাখতে হবে যে দুই দেশই তাদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করবে। তাই বাংলাদেশকে কারও প্রতি বিশেষ দুর্বলতা না দেখিয়ে কৌশলে এগুতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশ কি পারবে দুই দেশের প্রতিই ভারসাম্যপূর্ন সর্ম্পক বজায় রেখে চলতে ? দুটি দেশই চাচ্ছে বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রভাব বাড়াতে। যা বাংলাদেশের জন্য যেমন জটিল তেমনি একটি সুযোগও বটে।

বাংলাদেশের জন্য বড় শিক্ষা হচ্ছে মিয়ানমার ইস্যুতে চীন-ভারতের কেউই বাংলাদেশের পাশে থাকেনি। প্রকৃতপক্ষে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে চীনা ভেটো মিয়ানমারের পরিকল্পিত গণহত্যাকে আরও উস্কে দিয়েছে। সুসম্পর্ক সত্ত্বেও কিছু বিষয়ে দুই দেশই বাংলাদেশকে হতাশ করেছে।

দেশ দুটি বেশ কিছুদিন ধরে সীমান্তে ভারী অস্ত্র মজুত করেছে। পূর্ব লাদাখের সীমান্ত অঞ্চলে ধীরে ধীরে এসব অস্ত্র নিয়েছে দুই দেশ। ভারী অস্ত্রের মধ্যে কামান এবং যুদ্ধের গাড়িও রয়েছে। তবে চীন ও ভারতের মধ্যে চলমান সংঘাত নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী । তিনি বলেছেন, “ভারত ও চীন উভয়ে বাংলাদেশের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সে জন্য আমরা এ দুই দেশের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চাই”। পররাষ্ট্রমন্ত্রী অবিলম্বে উত্তেজনা প্রশমনের জন্য বাংলাদেশ তার বড় দুই প্রতিবেশীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
ভারতে যতই আলোড়ন হোক না কেন, চীনের সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষ নিয়ে আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় তেমন কোনও আলেচনা নেই।ভারত-চীন সীমান্ত সংঘর্ষের পর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। সাধারণত, বড় কোনও সংঘাতের ঘটনা ঘটলে, এর মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিক্রিয়া চলে আসে। কে কার পাশে আছে তা অনেকটাই পরিস্কার হয়ে যায়। কিন্তু ভারত-চীন সংঘাতের পর সেই চেনা ছকে প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। চীন ও ভারতের পাশে দাঁড়ানোর কথা অন্তত খোলাখুলিভাবে কেউ জানায়নি।