ফেনী নদী উৎপত্তি এবং এর প্রবাহ

0
1367

ফেনী নদী উৎপত্তি এবং এর প্রবাহ

ফেনী নদীর উৎপত্তি নিয়ে একাধিক তথ্য রয়েছে। সরকারি ওয়েব সাইটে ফেনী নদীর উৎপত্তিস্থল সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এর উৎপত্তিস্থল খাগড়াছড়ি জেলার পার্বত্য এলাকা। তবে ফেনী নদীর উৎপত্তিস্থল নিয়ে ভিন্ন তথ্য দেয়া হয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়াতে। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে অবস্থিত পর্বত শ্রেণিতে ২৩°২০´ উত্তর অক্ষাংশ ও ৯১°৪৭´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে উৎপন্ন হয়েছে।

বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ফেনী নদী। বাংলাদেশ সরকারের ওয়েব সাইটে দেয়া তথ্য বলছে, ফেনী নদীটি ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া, সোনাগাজী, খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা এবং চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া এটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যেও প্রবাহিত হয়েছে। বাংলাপিডিয়ার তথ্য মতে, ত্রিপুরার পূর্বাঞ্চলীয় পর্বত থেকে উৎপন্ন হয়ে খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলার বেলছড়ি নামক স্থান দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশে প্রবেশের পর নদীটি খাগড়াছড়ি জেলার রামগড়, চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি ও মিরসরাই এবং ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া, ফেনী সদর ও সোনাগাজী উপজেলার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। প্রবাহ পথের অনেকটুকু জুড়েই নদীটি চট্টগ্রাম ও ফেনী জেলার সীমান্ত বরাবর প্রবাহিত হয়েছে। নদীটির মোট দৈর্ঘ্য ১১৬ কিমি। এতে আরো বলা হয়, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মধ্যে সীমানা চিহ্নিতকারী ফেনী নদী বাংলাদেশের অন্তর্গত।

ব্রিটিশ শাসন আমলে তখনকার বাংলা প্রদেশে ছিল পাঁচটি বিভাগ। এর মধ্যে একটি ছিল চট্টগ্রাম বিভাগ। চট্টগ্রাম বিভাগের জেলা- চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, ত্রিপুরা ও নোয়াখালী। যাকে বলা হতো ত্রিপুরা, তার জেলা শহর ছিল কুমিল্লা। এখন যাকে বলা হচ্ছে ভারতের অঙ্গরাজ্য ত্রিপুরা, ব্রিটিশ শাসন আমলে তাকে বলা হত পার্বত্য ত্রিপুরা।

অন্যদিকে ভারত পার্বত্য ত্রিপুরা দখল করে ১৫ অক্টোবর ১৯৪৯ সালে। পাবর্ত্য ত্রিপুরা ভারতে যোগ দিতে চায়নি, তাই ভারত রাজ্যটি  দখল করে। এ সময় থেকে পার্বত্য ত্রিপুরার নাম থেকে পার্বত্য কথাটা বাদ পড়ে। প্রথমে ত্রিপুরা হয় ভারতের একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। পরে তা স্বীকৃতি পায় একটা অঙ্গরাজ্যের। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার পর, সাবেক কুমিল্লা ও নোয়াখালী জেলা থেকে বহু বাঙ্গালী হিন্দু ত্রিপুরায় যেয়ে বসতি স্থাপন করে। এখন ত্রিপুরার মোট জনসংখ্যার শতকরা ৬৫ ভাগ দাঁড়িয়েছে বাংলাভাষী। ত্রিপুরী যাদের মাতৃভাষা, তাদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে শতকরা ২৫ ভাগ। আর বাদবাকি হলো ভারতের অন্য ভাষার মানুষ।

ফেনী নদীর পানির উৎস বাংলাদেশের বৃষ্টির পানি। ফেনী নদী কোন বরফ গলা পানি বহন করে না। বহন করে কেবলই বৃষ্টির পানি। আর এই বৃষ্টির পানি ভারতের মাটি থেকে চুঁইয়ে আসেনি। নদীর পানি পরিমাপের দুটি একক রয়েছে। একটি কিউসেক এবং অপরটি কিউমেক। অর্থাৎ একটি হিসাব করা হয় প্রতি সেকেন্ডে কত ঘনফুট পানি যাচ্ছে কোন একটা জায়গায় সেটার উপর। আর অপরটি হচ্ছে প্রতি সেকেন্ডে কত ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয় সে অনুযায়ী। বাংলাদেশের সাথে ভারতের নতুন চুক্তি অনুযায়ী, ফেনী নদী থেকে ১.৮২ কিউসেক পানি ভারত তুলে নিতে পারবে।

পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় অনুযায়ী, শুকনা মৌসুমে ফেনী নদীর পানির গড় পরিমাণ ৭৯৪ কিউসেক এবং বার্ষিক পানির গড় পরিমাণ প্রায় ১৮৭৮ কিউসেক। এতে বলা হয়, ফেনী নদীর ১.৮২ কিউসেক করে পানি প্রত্যাহার শুষ্ক মৌসুমের গড় পানি প্রবাহের মাত্র ০.২৩ শতাংশ। তবে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২০০৫ সালে প্রথম প্রকাশিত “বাংলাদেশের নদ-নদী” বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে, শুকনো মৌসুম অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত ফেনী নদীতে ১.৩৫ কিউবিক মিটার বা ৪৭ কিউসেক পানি থাকে।

 নদীর দু’পাশে বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল এবং সমতলে ফেনী নদীর প্রবাহ পথের দুই পাড়ের মানুষদের জীবনের উপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে ফেনী নদীর।পার্বত্য এলাকা ও খাগড়াছড়ি থেকে বেশ কয়েকটি উপনদী এসে ফেনী নদীর উপর এসে পড়েছে। এরমধ্যে মুহুরি নদী উল্লেখযোগ্য।

পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা (ওয়ারপো)’র সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, “এটি আসলে অনেকগুলো নদীর একটি অববাহিকা। যেটা ফেনী জেলাকে এবং উজানে খাগড়াছড়ি জেলার মানুষ এর দ্বারা উপকৃত।” “ফেনী নদীর পানি কমে গেলে এই উপনদীগুলোতেও পানি প্রবাহ কমে যাবে। যার কারণে ফেনী নদীর সাথে সাথে হুমকির মুখে পড়বে এসব নদীর জীব-বৈচিত্র্য এবং এর স্থানীয় বাসিন্দারাও।,” তিনি বলেন। ফেনী নদীর বন্যায় আক্রান্ত হয় এর দুই পাড় বসবাসকারী মানুষরা

ফেনী নদী থেকে শুষ্ক মৌসুমে ভারত পানি প্রত্যাহার করলে তা ওই এলাকা এবং পরিবেশের উপর কি ধরণের প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে মিশ্র মতামত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক ইনামুল হক বলেন, “ভারত যদি বেশি পরিমাণে পানি তুলে নেয় তাহলে মুহুরি সেচ প্রকল্প ও পরিবেশগত যে প্রকল্প আছে সেটার উপর একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ”।

পানি সম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাতের মতে, দুই দেশের মধ্যে অভিন্ন নদীর সমন্বিত ব্যবস্থাপনা দরকার। যাতে খাবার পানি, নৌ-চলাচল, সেচ এবং নদীর স্বাস্থ্য বিবেচনা করে প্রতিবেশের জন্য পানি, মাছের জন্য পানি যাতে নিশ্চিত করা যায়, সে লক্ষ্যে দুই দেশ আরো ৬টি নদীকে একটা যৌথ ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে চাইছে।

মানবিক কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্রিপুরাকে ফেনী নদীর পানি প্রদানে সম্মত হয়েছেন। তিনি বলেছেন, তিনি এটা দিতে রাজি হয়েছেন কেবল ত্রিপুরা ফেনী নদী থেকে পানি নেবে পরিশুদ্ধ করে পান করার জন্য, সেচের কাজে ব্যবহার করবার জন্য নয়।

ত্রিপুরার সাবরুম মূলত একটি স্থলবেষ্টিত শহর। পানীয় জল হিসেবে সাবরুমে ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহার করা হয়। যাতে আয়রনের পরিমাণ অনেক বেশি। এসব কারণ মিলিয়ে ওই অঞ্চলটিতে দীর্ঘদিন ধরেই পানি সংকট চলছিল। এই চুক্তির পর ওই অঞ্চলটির পানীয় জলের অভাব অনেকাংশেই পূরণ হবে বলে জানাচ্ছেন স্থানীয়রা। এদিকে, ফেনী নদীর পানি উত্তোলন ছাড়াও আরেকটি বড় ইস্যু হচ্ছে এর পরিবেশ বিপর্যয়। গবেষক মি রায়বর্ধন বলেন, ফেনী নদীর উৎসস্থল অর্থাৎ ত্রিপুরার পার্বত্য এলাকায় গাছ কেটে বন-নিধন শুরু হওয়ার কারণে সেখানকার মাটিতে জলধারণ ক্ষমতা কমে গেছে। যার কারণে কমেছে নদীর নাব্যতাও।

এসব কারণে নদীর গভীরতা কমে যাওয়া এমনকি এই অবস্থা চলতে থাকলে এক সময় মানচিত্র থেকে ফেনী নদী মুছে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি। এ অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি পেতে হলে উভয় দেশের সরকারকেই নদীর নাব্যতা বাড়াতে পদক্ষেপ নিতে হবে বলে উল্লেখ করেন মি. রায়বর্ধন।