আফগানিস্তানে বিজয়ী কে ?

0
285

আফগানিস্তানে  বিজয়ী কে ?

ইসলামপন্থী তালেবান নামের এই দলটি ২০০১ সালে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল – যখন মার্কিন-নেতৃত্বাধীন বাহিনী আফগানিস্তানে অভিযান চালায়। এর পর দেশটিতে গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়, এবং একটি নতুন সংবিধান গৃহীত হয়। কিন্তু তালেবান এর পর এক দীর্ঘ বিদ্রোহী তৎপরতা শুরু করে। ক্রমান্বয়ে তারা আবার শক্তি সঞ্চয় করে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও নেটো বাহিনীকে আরো বেশি করে সংঘাতে জড়িয়ে ফেলে।

যুক্তরাষ্ট্র ও নেটোর সৈন্যরা ২০ বছরের যুদ্ধের পর অবশেষে আফগানিস্তান ত্যাগ করছে। বলা যায় প্রায় ২০ বছর পর আফগানিস্তানে যুদ্ধ শেষ হতে যাচ্ছে৷ আর ঠিক এ সময়টিতেই ঝড়ের গতিতে একের পর এক অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছে তালেবান। এবং সেখানে শরিয়া আইন পুনরায় বলবৎ করছে। যে তালেবানকে পরাজিত করতে তারা এদেশে এসেছিল – সেই তালেবানই এখন দ্রুতগতিতে দেশটির বিভিন্ন এলাকা দখল করে নিচ্ছে।জুনের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বিভাগগুলোর এক বিশ্লেষণ রিপোর্ট সংবাদমাধ্যমে ফাঁস হয়, তাতে বলা হয়েছে যে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের ছয় মাসের মধ্যেই কাবুলের বর্তমান সরকারের পতন হতে পারে।

 ২০০১ সালের পর থেকে গত ২০ বছরের লড়াইয়ে কখনো তালেবানের আক্রমণে, কখনো কোয়ালিশন বাহিনীর বিমান হামলায় আফগানিস্তানে এবং সীমান্তের ওপারে প্রতিবেশী পাকিস্তানে উভয় পক্ষেই হাজার হাজার সৈনিক ও বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে ।যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ও ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয় এই সময়ে কোন পক্ষের কতজন প্রাণ হারিয়েছেন, খরচ কত হয়েছে তার একটি তথ্য প্রকাশ করেছে মার্কিন সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস(এপি)৷

১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিক আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট সরকারকে রক্ষা করতে সেদেশে ঢুকে পড়লো সোভিয়েত সেনাবাহিনী। মস্কো তখন বলেছিল, সোভিয়েত সৈন্যরা ৬ মাস থাকবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেদেশে সোভিয়েত সৈন্যরা ছিল দীর্ঘ ১০ বছর, এবং আফগানিস্তান পরিণত হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিয়েতনামে।আফগানিস্তানের সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়া্ইয়ের ভেতর দিয়েই জন্ম হয়েছিল তালেবান এবং আল-কায়েদার মতো জিহাদি বাহিনীগুলোর।

সোভিয়েত ইউনিয়নে ১৯৮৫ সাল নাগাদ নতুন নেতা হলেন মিখাইল গরবাচেভ। তিনি বুঝতে পারছিলেন, এ যুদ্ধে কোনদিনই জয় আসবে না। যুদ্ধে নিহত সোভিয়েত সৈন্যদের মৃতদেহ যেভাবে ব্যাগে ভরা অবস্থায় প্রতিনিয়ত দেশে ফিরে আসছিল তা আর মানুষের কাছে গোপন রাখা যাচ্ছিল না। ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহার শেষ হয়। আফগানিস্তানে ১৫ হাজার সোভিয়েত সৈন্য এবং ১০ লাখ আফগান মারা যায়। এর দু’ বছর পর সোভিয়েত ইউনিয়নই বিলুপ্ত হয়ে যায়।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯০ এর দশকে সোভিয়েত বাহিনী প্রত্যাহারের পর তালিবানের উত্থান ঘটে আফগানিস্তানে। ১৯৯৬ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর ‌ইসলামপন্থী তালেবান বাহিনী আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল দখল করে সাবেক আফগান প্রেসিডেন্ট ডঃ নজিবুল্লাহ ও তাঁর ভাই নিহত হন তালেবানের হাতে। প্রায় দুই বৎসর তীব্র লড়াইয়ের পর তালেবান বাহিনী দখল করে প্রেসিডেন্টের প্রাসাদসহ সরকারি ভবনগুলো।তালিবানরা ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত দেশটিকে শাসন করে এবং এসময় তারা শরিয়া আইন চালু করে।সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তান ত্যাগ করার পর ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে মুজাহেদিন আর তালেবানের মধ্যে চলছিল তিক্ত লড়াই আর চরম বিশৃঙ্খলা এরপর ক্ষমতা হাতে নিল তালেবান।

৯/১১ এর ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্র বাহিনী তাদের উৎখাত করে। ওয়াশিংটন তখন যুক্তরাষ্ট্রে হামলাকারী আল কায়েদাকে আশ্রয় দেয়ার অভিযোগ তোলে তালিবানের বিরুদ্ধে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে হামলার এক সপ্তাহ পর ১৮ সেপ্টেম্বর মার্কিন কংগ্রেস হামলাকারীদের বিরুদ্ধে লড়তে মার্কিন বাহিনীকে অনুমতি দিয়েছিল৷ যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত মারা গেছেন এক লাখ ৭২ হাজার ৩৯০ জন৷ যুদ্ধে মারা যাওয়া মার্কিন সামরিক বাহিনীর সদস্যের সংখ্যা দুই হাজার ৪৪৮ জন৷ এছাড়া মার্কিন কন্ট্রাক্টর মারা গেছেন তিন হাজার ৮৪৬ জন৷ যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া আফগানিস্তানে যুদ্ধ করা ন্যাটো ও অন্যান্য দেশের এক হাজার ১৪৪ জন ব্যক্তিও মারা গেছেন৷ যুদ্ধে আফগানিস্তানের সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর প্রায় ৬৬ হাজার সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন৷ সাধারণ নাগরিক মারা গেছেন ৪৭ হাজার ২৪৫ জন৷ তালেবান ও অন্যান্য বিরোধী যোদ্ধা মারা গেছেন ৫১ হাজার ১৯১ জন৷ ৪৪৪ জন ত্রাণকর্মী ও ৭২ জন সাংবাদিকও মারা গেছেন আফগান যুদ্ধে ৷

২০১৪ সালে বিদেশী বাহিনীর বড় অংশ আফগানিস্তান থেকে চলে গেলে তালিবান আবার সংঘটিত হতে শুরু করে। ২০২০ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তান ও ইরাকে যুদ্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্র আনুমানিক প্রায় দুই ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে৷ বাংলাদেশি মুদ্রায় এটি প্রায় ১৬৯ লাখ ৫৪ হাজার ৭০৪ কোটি টাকা৷যুদ্ধে খরচের জন্য দুই ট্রিলিয়ন ডলার জোগাড় করতে যে ঋণ নেয়া হয়েছে তার সুদ হিসেবে এখন পর্যন্ত আনুমানিক ৯২৫ বিলিয়ন ডলার দেয়া হয়েছে৷ ২০৩০ সালে সুদের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে দুই ট্রিলিয়ন ডলারে, যা যুদ্ধে খরচের সমপরিমাণ৷ খরচ সেখানেই থামবে না৷ ২০৫০ সাল নাগাদ সুদের পরিমাণ হতে পারে সাড়ে ছয় ট্রিলিয়ন ডলার৷ যুদ্ধ শেষ হলেও খরচ শেষ হবে না৷ আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধে অংশ নেয়া প্রায় ৪০ লাখ সেনাকে আজীবন দেখভাল করতে হবে৷ এতে প্রায় ১.৬ থেকে ১.৮ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ হতে পারে বলে জানিয়েছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লিন্ডা বিলমেস৷

যুক্তরাষ্ট্রের ‘সিনেট অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন্স ডিফেন্স সাবকমিটি’ ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় তার খরচ নিয়ে ৪২ বার আলোচনা করেছে৷ একই কমিটি আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধের খরচ নিয়ে আলোচনা করেছে মাত্র পাঁচবার৷ আর সিনেটের ফাইন্যান্স কমিটি আলোচনা করেছে মাত্র একবার৷