আবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংশোধনী প্রস্তাব

0
371

আবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংশোধনী প্রস্তাব

দখিনা: বেশকিছু পরিবর্তন নিয়ে সংশোধন হচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন। ইতোমধ্যে বিদ্যমান আইনের অনেক বিধিবিধান পরিবর্তনেরও সুপারিশ করা হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত এবং সময়ের প্রয়োজনের নিরিখে আইন হালনাগাদের উদ্যোগ শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ইউজিসি নিয়েছে । শিগগিরই খসড়া প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দেবে কমিটি। এরপর প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শেষে পাশের লক্ষ্যে সংসদে পাঠানো হবে।

আইন যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০২০ সালে ২৪ আগস্ট তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে। কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ। তিনি জানান, আইনের ওপর বিভিন্ন সুপারিশ প্রায় চূড়ান্তের পথে। আর দু-একটি বৈঠক শেষে প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।

১৯৯২ সালে দেশে প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংসদে পাশ হয় যা ১৯৯৮ সালে সংশোধন করা হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারনা না থাকায় সুশিল সমাজ প্রচার মাধ্যমে নেতিবাচক সংবাদ যত্রতত্র ক্যাম্পাস খোলা এবং কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়মের কারনে পূর্বের সকল আইন রহিত করে ২০১০ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংসদে পূনরায় পাশ হয়।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনটি যুগোপযোগী করার উদ্দেশ্যে সংশোধন, সংযোজন ও পরিমার্জনের সুপারিশ করতে ২০১৫ সালের শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এই আইন আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ লক্ষ্যে ওই বছর অক্টোবর মাসে ৫ সদস্যের কমিটির গঠন করা হয়। এতে স্থায়ী কমিটির কয়েকজন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ইউজিসির প্রতিনিধি সদস্য হিসেবে ছিলেন। ওই কমিটি বহু আগে প্রতিবেদন দাখিল করে। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিওটি সদস্যদের একটি বড় অংশের বিরোধিতার কারণে সংশোধনী ধামাচাপা পড়ে যায়। পরে ২০১৮ সালের ২৭ মে সংসদীয় কমিটির বৈঠকে সংশোধনীর ওপর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির প্রতিনিধিদের নিয়ে শুনানি হয়। বিভিন্ন ধারার ওপর অন্তত ১৫টি সংশোধনী তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। এতে সমিতির চার সদস্য যোগ দেন এবং প্রত্যেকেই বিভিন্ন ধারার ওপর আনা সংশোধনী প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন। এ কারণে কার্যক্রম আর এগোয়নি। নতুন করে আবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ৪ আগস্ট সর্বশেষ কমিটির বৈঠক হয়।

দীর্ঘ দিন থেকে অভিযোগ রয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ট্রাস্টি বোর্ডে বেশির ভাগ সদস্যই মনোনীত হন মালিক পক্ষের পরিবার বা মালিকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের মধ্য থেকে। তাই অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীদের স্বার্থপরিপন্থী অনেক সিদ্ধান্ত আসে। অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে টিউশন ফির টাকা শিক্ষার্থীদের কল্যাণে ব্যয় হওয়ার কথা থাকলেও অভিযোগ আছে তা উদ্যোক্তাদের ব্যবসার বিনিয়োগ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পুরো কার্যক্রম মালিক পক্ষের হাতে রাখতে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি-প্রোভিসি নিয়োগ দেয়া হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংগঠনিক কাঠামো থেকে শুরু করে সংবিধি, বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা, বাজেটসহ সবকিছুই অনুমোদন দেয় ট্রাস্টি বোর্ড। এ বোর্ডে নির্দিষ্ট শিক্ষাবিদরা থাকলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষা সম্ভব হবে। এতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যলয়গুলো ‘ব্যবসা প্রতিষ্ঠান’ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রূপান্তর হবে বলে মত দিয়েছেন ইউজিসি সংশ্লিষ্টরা।

আইনের যেসব ধারায় সংশোধনী আনা হচ্ছে তার একটি ৬ নম্বর ধারা। বিওটিতে বর্তমানে ন্যূনতম ৯ জন এবং সর্বোচ্চ ২১ সদস্য রাখার বিধান আছে। প্রস্তাবে ন্যূনতম সদস্য ১৫ এবং এক-তৃতীয়াংশ বা ৫ জন শিক্ষাবিদ রাখার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা সংশোধন করে শিক্ষক নিয়োগ ও অর্থ কমিটিসহ একাডেমিক উন্নয়নে বিভিন্ন কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব কমিটির প্রধান থাকবেন উপাচার্য।

৩১(৮) নম্বর ধারা সংশোধন করে উপাচার্যকে সিন্ডিকেটের কাছে দায়বদ্ধ থাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। বিদ্যমান ধারায় বিওটি বা মালিকদের কাছে দায়বদ্ধ হিসেবে প্রস্তাব আছে। খসড়া সংশোধনীতে ৩৫ নম্বর ধারায় ‘বোর্ড অব ট্রাস্টিজের দ্বন্দ্ব’ সৃষ্টি হলে করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা যুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া আইনের ৩৭ নম্বর ধারায় ‘কমিশন কর্তৃক প্রণয়নকৃত গাইডলাইন’, ৪৩ নম্বরে বেতন-ভাতা সংক্রান্ত গাইডলাইন তৈরি, ৪৪ নম্বরে সাধারণ তহবিল পরিচালনা সম্পর্কে নানা নির্দেশনা এবং ৪৮ ও ৪৯ নম্বর ধারায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ এবং শাস্তির ব্যাপারেও সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া অস্থায়ী ক্যাম্পাসের জায়গা ২৫ হাজার বর্গফুটের পরিবর্তে ৩৫ হাজার বর্গফুট করার প্রস্তাবও আছে বলে জানা গেছে।

কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, খসড়ায় বেশকিছু সংশোধনী আনা হচ্ছে। এগুলোর বেশির ভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতন্ত্রায়ন ও একাডেমিক উন্নয়নকে চিন্তা করে। এর মধ্যে আছে, বিভাগগুলোতে একাডেমিক উন্নয়ন, পরিকল্পনা ও সমন্বয় সংক্রান্ত তিনটি কমিটি থাকতে হবে। শিক্ষক নিয়োগে কমিটি থাকবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সরকার উপাচার্য নিয়োগ দেবে।

জানা যায়, সংশোধনী প্রস্তাবে আরও বেশকিছু দিক থাকছে। এর মধ্যে আছে-সিন্ডিকেটে ইউজিসি মনোনীত শিক্ষাবিদ সদস্য যুক্ত করা, প্রতি দুই মাসে অন্তত একটি করে সিন্ডিকেট সভার আয়োজন, টিউশন ফি নির্ধারণের তথ্য ইউজিসিকে অবহিতকরণ, যৌন হয়রানি রোধ ইত্যাদি।

এসব প্রস্তাবের ব্যাপারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সহসভাপতি বলেন, দেশে উচ্চশিক্ষা বিস্তারের জন্যই এই খাতে কাজ করতে এসেছেন ট্রাস্টিরা। পাবলিক আর প্রাইভেটের মধ্যে পার্থক্য কেবল অর্থায়নে। একটিতে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী আর অপরটিতে জনগণের পক্ষে সরকার অর্থায়ন করে। যেহেতু এছাড়া আর সবই একই, তাই পাবলিকের মতো প্রাইভেটেও এমফিল-পিএইচডি গবেষণার সুযোগ প্রস্তাবিত খসড়ায় রাখা যেতে পারে। এর সঙ্গে একাডেমিক উন্নয়ন, বৈষম্য নিরসন এবং সমতা প্রতিষ্ঠা যে কোনো প্রস্তাবকে স্বাগত জানাই। তবে অনিয়মের কথা বলে ইউজিসি বা অন্য কোনো সংস্থার নিয়ন্ত্রণ আরোপের বিধান যুক্ত করা হলে তা হবে অপ্রত্যাশিত। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আর হাইস্কুলের কোনো পার্থক্য থাকবে না। পাশাপাশি উপাচার্য নিয়োগসহ বিভিন্ন কাজ যদি সরকারই করে দেয় তাহলে এই দাবি তোলা অযৌক্তিক হবে না যে, সরকারকেও তাহলে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থ ব্যয়ের দায়িত্ব নিতে হবে।

উল্লেখ্য, বর্তমানে দেশে ১০৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে ৯৬টি।এতে প্রায় ৩,৮৫,০০০ শিক্ষর্থিী অধ্যয়নরত ।