সমুদ্র সম্পদ নির্ভর অর্থনীতি।

0
221

সুনীল অর্থনীতি:সমুদ্র সম্পদ নির্ভর অর্থনীতি। 

সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারত ও মিয়ানমারের সাথে বিরোধ মীমাংসার পর আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে ভারত বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়েছে। বঙ্গোপসাগরের বিশাল এলাকার মালিকানা পেয়েছে বাংলাদেশ। সরকার জানিয়েছিল, ”১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি টেরিটোরিয়াল সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশ অবস্থিত সব ধরণের প্রাণীজ ও অপ্রাণীজ সম্পদের উপর সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে।” এই এলাকায় মৎস্য আহরণ ও সমুদ্রের তলদেশে প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলনে বাংলাদেশের অধিকার নিশ্চিত হয়েছে।

ফলে সমুদ্রে ও তলদেশে থাকা বিপুল পরিমাণ সম্পদ আহরণের নীতি নিয়েছে বাংলাদেশ যাকে বলা হয় ‘ব্লু ইকোনমি’ বা সমুদ্র সম্পদ নির্ভর অর্থনীতি। বঙ্গোপসাগর থেকে বাংলাদেশ বিপুল পরিমাণ মাছ ও অন্যান্য সম্পদ আহরণ করে কিন্তু বিশাল এই সমুদ্র এলাকা থেকে বাংলাদেশ কতটা সম্পদ আহরণ করতে পারছে?

২০১৭-২০১৮ সালে বাংলাদেশে উৎপাদিত মোট ৪৩ লাখ ৩৪ হাজার টন মাছের মধ্যে সাড়ে ছয় লাখ টন মাছ এসেছে সমুদ্র থেকে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘সেভ আওয়ার সি’- তথ্য অনুসারে, প্রতিবছর বঙ্গোপসাগর থেকে আশি লাখ টন মাছ ধরা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের জেলেরা ধরতে পারছেন মাত্র ৭ লাখ টন মাছ। বিশেষজ্ঞদের মতে ”এখনো সমুদ্র থেকে আমরা মূলত মাছ এবং চিংড়ি বেশি ধরা হয়। কারণ খাবার হিসাবে বাংলাদেশিদের ভেতরে এগুলোর চাহিদাই বেশি রয়েছে। তবে ইদানীং অনেক জায়গায় অক্টোপাস, স্কুইড, ক্যাটলফিস, কাঁকড়া বা ঝিনুক খাওয়ার চল তৈরি হয়েছে।”অক্টোপাস, ক্যাটলফিস,বা কাঁকড়া, স্থানীয় বাজারে চাহিদা কম থাকলেও এগুলোও প্রচুর পরিমাণে ধরা হয়। কারণ এসব মাছ বিদেশে রপ্তানি হয়।

বাংলাদেশের সমুদ্র থেকে মূলক লাক্ষা, রূপচাঁদা ও কালোচাঁদা, টুনা, ম্যাকারেল, লইটা, চ্যাপা, সামুদ্রিক রিটা, শাপলা পাতা মাছ, তাইল্লা, পোয়া, সুরমা, ইলিশ, ছুরি, ফাইস্যা, সামুদ্রিক বাইন ও কই মিলিয়ে প্রায় ২০টির মতো বাণিজ্যিক আকারে মাছ ধরা হয়। কারণ এসব মাছের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা রয়েছে।

কিছু মাছ স্থানীয় বাজারে বিক্রি হয়ে যায়, কিছু আবার শুঁটকি হয়, রপ্তানি হয়।”সবমিলিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে খাদ্য হিসাবে দুইশ প্রজাতির মাছ ও চিংড়ি মিলিয়ে ৪০টির মতো মাছ নিয়মিত ধরে বাংলাদেশের জেলেরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন,  কিছু মাছের দেশের ভেতরে তেমন চাহিদা না থাকলেও বিদেশে চাহিদা থাকায় ধরা হয়। যেমন হাঙ্গর ধরা নিষিদ্ধ হলেও এটির পাখনার চাহিদা থাকায় গোপনে জেলেরা ধরে বিক্রি করে। কিন্তু ছোটবড় মিলিয়ে এতো বেশি হাঙ্গর ধরা হয়েছে যে, হাঙ্গরের সংখ্যা এখন ঝুঁকিতে পড়ে গেছে। বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন ধরনের মাছ  ধরা হয়। ইলিশ মৌসুমে যেমন ইলিশ বেশি ধরা হয়। বাংলাদেশের জেলেরা দক্ষিণে মিয়ানমারের সীমানা আর পশ্চিমে ভারতের সীমানা পর্যন্ত গিয়ে মাছ ধরে।

”বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে শামুক, ঝিনুকের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এছাড়া বিদেশেও এটা রপ্তানি হয়। ফলে বাংলাদেশে এটি প্রচলিত একটি খাবার না হলেও সমুদ্র থেকে এটাও আহরণ করা হয়।”

কিছুদিন আগে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রায় দুই বছর ধরে গবেষণা করে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় বিপুল পরিমাণ গ্যাস হাইড্রেট ছাড়াও ২২০ প্রজাতির সি-উইড, ৩৪৭ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৪৯৮ প্রজাতির ঝিনুক, ৫২ প্রজাতির চিংড়ি, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ৬ প্রজাতির কাঁকড়া এবং ৬১ প্রজাতির সি-গ্রাস চিহ্নিত করা হয়েছে।

বাংলাদেশের কিছু প্রজাতির সি উইডে প্রচুর প্রোটিন আছ যা ফিস ফিড হিসেবে আমদানি করা ফিস অয়েলের বিকল্প হতে পারে। আবার কিছু প্রজাতি অ্যানিমেল ফিডের মান বৃদ্ধিতে ব্যবহৃত হতে পারে। মাছের বাইরেও বঙ্গোপসাগরের কিছু উদ্ভিদ এবং শামুক-ঝিনুকের চাহিদা রয়েছে দেশে ও বিদেশে।বিশেষজ্ঞদের মতে, যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারলে সি-উইড বাংলাদেশের জন্য ব্যাপক বাণিজ্যিক সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। তিন ধরণের সি-উইডের মধ্যে সবুজটি সাধারণত খাবার বা সালাদ হিসেবে খাওয়া হয়। আর লালটি হাইড্রোকলয়েড উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। আর বাদামি সি-উইড খাবার ও হাইড্রোকলয়েড উৎপাদন দুই কাজেই ব্যবহার হয়। হাইড্রোকলয়েড উৎপাদন সাধারণত শিল্প উৎপাদনে জলীয় কাঁচামাল হিসেবে কাজে লাগে। কসমেটিকে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় এমন কিছু উপাদান পাওয়া যায় এমন সি উইডও অনেক পাওয়া গেছে সমুদ্রে।

বর্তমানে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ও সমুদ্র বিজ্ঞানী ড. মোঃ কাউসার আহম্মেদের মতে, ”৪০টির বেশি মাছ বা সামুদ্রিক প্রাণীর বাণিজ্যিক মূল্য নেই। যদিও ধরা হয় প্রায় দুইশর মতো প্রজাতি। বাকিগুলো সমুদ্রে ফেলে দেয়া হয়।” অনেক সময় জেলেদের জালে কচ্ছপ ধরা পড়তো। কখনো কখনো এসব কচ্ছপ গোপনে বিক্রিও করা হতো। বর্তমানে বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী হিসাবে কচ্ছপ নিধন শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

বাংলাদেশের জলসীমায় সমুদ্র থাকার বড় একটি সুবিধা হলো, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সমুদ্রের পানি ব্যবহার করে লবণ উৎপাদন। উপকূলে সমুদ্রের পানি ধরে, রৌদ্র বা সৌরশক্তি ব্যবহার করে শুকিয়ে অপরিশোধিত লবণ আহরণ করা হয়। বর্তমানে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের এক লাখ একরের বেশি জমিতে লবণ চাষ করা হয়। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ১৮ লাখের বেশি মানুষ।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের হিসাবে, বাংলাদেশে অপরিশোধিত লবণের চাহিদা ছিল ১৬.৫৭ লাখ মেট্রিকটন, তবে সারা দেশে উৎপাদন হয়েছে ১৩.২৫ লক্ষ মেট্রিকটন। অর্থাৎ দেশের লবণের চাহিদার বড় একটি অংশ সমুদ্র থেকে আহরণ করা হয়।

বাংলাদেশের কর্মকর্তারা সমুদ্রসীমায় অনুসন্ধান করে সমুদ্রে ও তলদেশে গ্যাস-হাইড্রেট বা মিথেন গ্যাসের জমাট স্তরের উপস্থিতি দেখতে পেয়েছেন। তাদের ধারণা, বাংলাদেশের একান্ত অর্থনৈতিক এলাকায় ০.১১ থেকে ০.৬৩ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট সম্ভাব্য প্রাকৃতিক গ্যাস হাইড্রেট জমার অনুমান পাওয়া গেছে যা ১৭-১০৩ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদের সমান। বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ অংশে গভীর ও অগভীর সমুদ্রসীমায় ২৬টি ব্লক রয়েছে। সেসব ব্লকে তেল ও গ্যাস রয়েছে কিনা, সেজন্যও বাংলাদেশের বাপেক্স ও কয়েকটি বিদেশি কোম্পানি অনুসন্ধান কার্যক্রম চালাচ্ছে। ১৯৯৬ সালে সমুদ্রের নয় নম্বর ব্লকে সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে গ্যাস উত্তোলন শুরু করেছিল কেয়ার্নস এনার্জি। তবে গ্যাস ফুরিয়ে যাওয়ায় ২০১৩ সালে সেটি পরিত্যক্ত হয়েছে।

বর্তমানে চার নম্বর ব্লকে ভারতীয় একটি কোম্পানি অনুসন্ধান চালাচ্ছে। এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাস নাগাদ আরও তিনটি ব্লক ইজারা দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করবে পেট্রোবাংলা।সমুদ্রে তেল ও গ্যাস রয়েছে বলে আশা করা হচ্ছে। নতুন গ্যাসক্ষেত্রে আবিষ্কার হলে সেটা দেশের জন্য ব্লু ইকোনমির আরেকটি বড় শক্তি হয়ে উঠবে। তেল গ্যাস ছাড়াও বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ অংশে সালফার, মেটালিক মডিউল, কোবাল্ট পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

সূত্র:বিবিসি