শ্রীলংকা নজিরবিহীন সংকট কি হঠাৎ ? নাকি কয়েক দশক আগে থেকেই !

0
213
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: শতভাগ শিক্ষিত মানুষের  দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলংকা । স্থিতিশীল অর্থনীতি  এবং পর্যটন থেকে আসা আয়  আর বিদেশে কর্মরত ব্যক্তিদের পাঠানো অর্থই এর মূল ভিত্তি ছিলো । চরম দুর্দশায় পড়েছে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি। এখন নজিরবিহীন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটে পড়েছে দেশটি। বৈদেশিক ঋণের কিস্তি দিতে না পারায় ঋণখেলাপিতে পরিণত হয়েছে দেশটি।জনগণের ভোগের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি আমদানি করার অর্থও নেই তাদের। অর্থনৈতিক সংকট এখন রাজনৈতিক সংকটেও রূপ নিয়েছে।  অনেকের মতে সর্বত্র দুর্নীতি অর্থণৈতিক অব্যবস্থাপনায় দেশটিকে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায় ।
 একটা সময় ছিল, যখন এশিয়ায় অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে শ্রীলঙ্কা ছিল রোল মডেল। কলম্বোকে মনে হতো দক্ষিণ এশিয়া অনেকটা ইউরোপের মতো । রাতের বিনোদন , সংস্কৃতি, মানুষজনের জীবনযাত্রা, সাথে ধর্মীয় বৈচিত্র্য । জীবনকে উপভোগ করার মত সব কিছুই ছিল ।আর সেই শ্রীলংকা এখন ধুঁকছে অর্থনৈতিক সংকট আর রাজনৈতিক সহিংসতায় এবং টিকে থাকার জন্য  লড়ছে দেশটির অর্থনীতি। যার জন্য দায়ী করা হচ্ছে বর্তমান সরকারের একের পর এক ভুল নীতি, দুর্নীতি আর আর্থিক অব্যবস্থাপনাকে।
সূত্রপাত: দাতা দেশ ও সংস্থা গুলোর ঋণ পরিশোধে নিজের অক্ষমতা প্রকাশের পাশাপাশি শ্রীলংকার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় খালি হয়ে যায় । খাদ্যপণ্য, জ্বালানি ও ঔষধ সংকট ছাড়াও বিদ্যুৎহীনতার মধ্যেই কাটছে দিনের বেশিরভাগ সময়।পরিস্থিতি এমন যে, বলা হচ্ছে ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে এমন সংকটে দেশটি আর কখনো পড়েনি।
২৬ বছরব্যাপী গৃহযুদ্ধ শেষ হয় ২০০৯ সালে নির্মম সামরিক অভিযান ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের মধ্য দিয়ে। গৃহযুদ্ধ শেষে দেশটি খুব দ্রুতই প্রাণ ফিরে এসেছিলো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে, জমজমাট হয়ে উঠছিলো পর্যটনসহ সেবা খাত। তাহলে মাত্র দু বছরের কোভিড মহামারির পর এভাবে ভেঙে পড়লো কেন দেশটি?
কলম্বোয় সিলন চেম্বার অফ কমার্স এ নিয়ে একটি ওয়েবিনারের আয়োজনে করেছিলো। সেখানে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ইন্দ্রজিত কুমারস্বামী বলেছেন, শ্রীলংকার এ সংকট হুট করে জন্ম হয়নি বরং এ সংকটের উৎসের দিকে তাকাতে হলে অনেক আগে ফিরে যেতে হবে সেই পঞ্চাশের দশকে। তার মতে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার কারণে দেশটির অর্থনীতি কখনোই নিরাপদ থাকার মতো স্থিতিশীলতা পায়নি। গত কয়েক বছরে এর সাথে যোগ হয়েছে সরকারের একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত। তাঁর মতে ” কখনোই শৃঙ্খলাপূর্ণ আর্থিক ব্যবস্থাপনা ছিলো না। এটাই অস্থিতিশীলতার ধারাবাহিক একটা উৎস ছিলো। এটা ছিলো জনতুষ্টিবাদী সস্তা রাজনীতি আর ভাগ বাটোয়ারা সংস্কৃতির একটা দূষিত সমন্বয়, যা এই দেশকে পেছনে ঠেলেছে। তবে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পর কিছুটা পরিবর্তন আসতে শুরু করেছিলো। যদি একইসাথে তখন  বাজারের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে”।
তিনি বলেন এর সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য ডিসিপ্লিনড হওয়ার দরকার ছিলো। কিন্তু যা হয়েছে তা হলো নিয়মিত বার্ষিক বাজেট ঘাটতির কারণে রাজস্ব কমেছে নাটকীয়ভাবে। কমেছে রপ্তানি আর বেড়েছে ঘাটতি। তবে সমস্যাটা ব্যাপক বেড়েছে গত ১০-২০ বছরে”।
শ্রীলংকায় চীনের কিছু প্রকল্পই দেশটির সরকারকে ঋণ ভারে জর্জরিত করেছে এমন অভিযোগ আছে। বিশেষ করে হাম্বানটোটায় গভীর সমুদ্র বন্দর, বিলিয়ন ডলারের বিমানবন্দর বা পোর্ট সিটির মতো প্রকল্পগুলো নিয়ে আগেই প্রশ্ন উঠেছিলো। এর সাথে যোগ হয়েছিলো গোটাভায়া রাজাপাকশার সস্তা জনপ্রিয়তার স্মারক – হুট করে কর কমানোর নীতি- যার ভার পরবর্তীতে করোনার সময়ে আর সইতে পারেনি ৮১ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির দেশ শ্রীলংকা। যার সাথে যোগ হয়েছে করোনাকালীন বাস্তবতা। পরে ইউক্রেন যুদ্ধ সেই সংকটকে আরও বাড়িয়ে তোলে। প্রতি বছর কেবলমাত্র পর্যটন থেকেই শ্রীলঙ্কার পাঁচ থেকে সাত বিলিয়ন ডলার আয় ছিলো। দুই বছরের কোভিডকালে সেটি কার্যত শূন্যতে গিয়ে ঠেকেছে। ২০১৯ সালে কলম্বোয় যে হামলায় ব্যাপক মুসলিম নিগ্রহের ঘটনাও পর্যটন ধ্বসে ভূমিকা রেখেছে।করোনার দু বছরে রেমিটেন্স থেকে আয়ও কমে গেছে ব্যাপকভাবে।
তবে এসব কিছুকে ছাপিয়ে সর্বগ্রাসী দুর্নীতিকেই শ্রীলংকার বর্তমান পরিণতির মুল কারণ হিসেবে বলছেন অনেকেই । যুগের পর যুগ ধরে চলে আসা দুর্নীতিকে রাজাপাকশা পরিবার চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার কারণেই দেশটির এই দশা। কলম্বো পোর্ট থেকে আরম্ভ করে হাম্বানটোটা বন্দর, এয়ারপোর্ট- এগুলো ছিলো অর্থের অপচয়। বেশিরভাগ ঋণ এসেছে চীন থেকে। তারাই নির্মাণ করছে। এবং এখন তারা এগুলো করে যাচ্ছে।”
২০০৯ সালে তামিল বিদ্রোহ দমনের সাফল্যে মহানায়ক হয়ে উঠছিলো তখনকার প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকশা। তখন প্রতিরক্ষা সচিব ছিলেন তার ভাই গোটাভায়া রাজাপাকশা। ২০১৯ সালের নির্বাচনে পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার পর তারা দুই ভাই রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। পরিবার থেকেই আরও মন্ত্রী ও এমপিও রয়েছে। রাজাপাকশা পরিবার প্রবল ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছিলেন শুধু যুদ্ধের কারণেই নয়, বরং সত্যিকার অর্থেই তাদের ওপর ভরসা করেছিলো জনগণ। তবে এ ভরসায় আস্থা না রেখে নিজের ক্ষমতা সুসংহত করে কর্তৃত্বপরায়নতার দিকেই যাচ্ছিলেন মাহিন্দা রাজাপাকশা।
শাসনব্যবস্থাকে সংসদীয় ধরণ থেকে পরিবর্তন করে রাষ্ট্রপতি ধাঁচের করে নিয়েছিলেন। সাথে দেখা দেয় ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন আর ইচ্ছেমতো সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রবণতা।  নিয়মিত নির্বাচন হচ্ছিলো এবং যথাযথ শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়াও ছিলো। ভোটের মাধ্যমেই বারবার ক্ষমতা পরিবর্তন হয়েছে সেখানে রাজাপাকশা পরিবারকে ক্ষমতা থেকে সরাতে গণঅভ্যুত্থানের দরকার হলো । এটাই বড় প্রশ্ন?
অনেকে মনে করেন দুর্নীতি দীর্ঘকাল ধরেই বড় সমস্যা। যে কারণে কোন প্রতিষ্ঠান আসলে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি, যার মাধ্যমে দুর্নীতি দূর হতে পারে। যারফলে এর পরিণতি। আর এ জন্য মানুষ রাজপাকশা ভাইদের পরিবারতন্ত্রকে  এভাবেই বিদায় চাইছে। এছাড়া প্রভাবশালী দেশগুলোর শক্তি নিয়েও অনেক রাজনীতিক দেশ পরিচালনায় থাকেন যে কারণেই তাদের অনেক সিদ্ধান্ত দেশের স্বার্থ নষ্ট করে। সরকারের কর্তৃত্বপরায়নতার কারণে দেশটিতে সিভিল সোসাইটি ও গণমাধ্যম খুব একটা বিকশিত হতে পারেনি।আবার কিছু মিডিয়ার ক্ষেত্রেও রাজাপাকশা পরিবারের মালিকানাও রয়েছে। সরকারের বিরুদ্ধে সিভিল সোসাইটিকে রাজাপাকশা সরকারের বিরুদ্ধে কখনোই তেমন কোন ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়নি।
দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের পর তামিলদের বিরুদ্ধে শ্রীলংকা সরকারের বিজয়কে দেশে সিংহলিরা শান্তি হিসেবে বিবেচনা করলেও অনেকে মনে করেন এর মাধ্যমে আসলে দেশটিতে উগ্র সিংহলি জাতীয়তাবাদ তৈরি হয়েছিলো, যার ফলে হিন্দু, মুসলিমসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ক্রমশ আক্রমণের টার্গেট হয়েছে। আবার সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ সিংহলিরা এখন ক্ষুব্ধ হলেও তাদের একটি অংশের সমর্থনও আছে রাজাপাকশাদের দিকেই।