গবেষণা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য গ্রহণযোগ্য বাজেট
ড. ইসরাত জাহান
- ১৩ মে ২০১৯
-
- ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট। বাজেটকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে পরামর্শধর্মী আলোচনা। টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলের টকশোতে আমন্ত্রিত বিশেষজ্ঞ অতিথিরা কর, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানবান্ধব বাজেট প্রণয়নের যে তাগিদ প্রতিবার দিয়ে থাকেন, এবারো তা গুরুত্বের সাথে দিচ্ছেন। সরকার ও অর্থমন্ত্রীকে এসব খাতে গুরুত্ব দিতে পরামর্শ ও অনুরোধ জানাচ্ছেন তারা। সরকারও আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি দেবে। এ দিকে বিভিন্ন ব্যবসায়িক সংগঠন বাজেটের সম্ভাব্য আয়তন, কর, ভর্তুকি, বিনিয়োগ, অর্থায়ন, দ্রব্যমূল্যের ওপর প্রভাব এবং গতিপ্রকৃতি নিয়ে মিডিয়াতে আলোচনা এবং প্রচারণা চালাচ্ছেন। আমরা সব সময় দেখে আসছি, বাজেট পাসের পর পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। একটি দেশের অগ্রগতির মূলে রয়েছে শিক্ষা, গবেষণা ও স্বাস্থ্য। তাই এসব খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সাধারণ মানুষের চাহিদা বিবেচনায় রেখে সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে বাজেটের খাত নির্ধারণ হলে তবেই গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করবে। আর একটি গ্রহণযোগ্য বাজেটে বদলে যেতে পারে দেশের সামগ্রিক চিত্র।
-
- বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক শাসনামলের ইতিহাসে দীর্ঘ অনেক বছর পর এই প্রথম একজন ব্যবসায়ী দেশের একাদশ অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন আ ফ ম মোস্তফা কামাল। তিনি ১৯৭০ সালে তদানীন্তন পাকিস্তানের চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাণিজ্যে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি ও হিসাববিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এ ছাড়াও আইনশাস্ত্রে তার স্নাতক ডিগ্রি রয়েছে। তাই সব কিছু বিবেচনা করে সবাই আশাবাদী বর্তমান অর্থমন্ত্রীর ওপর। মন্ত্রী যতই গুণী হোন না কেন, আর্থিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা, সততা, স্বচ্ছতা, রাজস্ব আহরণে পরিকল্পনা প্রণয়ন, বিনিয়োগের গতিশীলতা আনতে না পারলে তিনিও ব্যর্থ হবেন এবং মানুষ আশাহত হবে। কারণ রাজস্ব আহরণ, ব্যয় নিয়ন্ত্রণ ও ব্যয়মান বাড়ানো ও অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা আমাদের মতো জনবহুল দেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক যে নীতি-কৌশল বাজেটে ঘোষণা করা হয়, সে সম্পর্কে একটি ঐকমত্যের বাজেট হলে অনেক ফলপ্রসূ হতো। আমাদের কর্মকর্তা, পরিকল্পনাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বিশ্বের কত দেশে সফর করেন। বিদেশে বাজেটের কোন খাতকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় এমন অর্জিত অভিজ্ঞতা যদি আমাদের প্রস্তাবিত বাজেটে যোগ করা যায়; তাহলে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। গতানুগতিকভাবে বাজেট হলে একপক্ষ দেশের মানুষকে ক্ষমতাসীন দল অবাস্তব স্বপ্ন দেখানো ও তাদের পকেট কাটার একটা দলিল বলে মনে করবে, আর অন্য পক্ষ অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার লক্ষ্যে বাস্তবভিত্তিক দিকদর্শনমূলক উন্নয়ন বাজেট বলে প্রচারণা চালাবে। এটাই এখন আমাদের সংস্কৃতির অংশ।
-
- এবারো সরকার লক্ষ কোটি টাকার বাজেট দেবে। তার মধ্যে কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেটও থাকবে। এ কথা সত্য, বাজেটের আকারের প্রবৃদ্ধি আমাদের জাতীয় প্রবৃদ্ধিরই প্রকাশ। ফলে বড় বাজেট বড় স্বপ্নেরই প্রকাশ ঘটায়। এই স্বপ্নময় বড় বাজেট বাস্তবায়নের কঠিন বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের প্রতিটি খাতের কর্তাব্যক্তিরা মনে করেন, তাদের খাত দেশের সেবা প্রদানকারী খাত, সুতরাং এই খাতের কর রেয়াত বা প্রণোদনা দেয়া উচিত। মূল্য সংযোজন কর এবং আয়কর নিয়ে অনেকের মধ্যে বিভ্রান্তি আছে। পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রমোশনাল কার্যক্রম বছরব্যাপী নিলে এই ধোঁয়াশা ভাবটা কেটে যেত। এখন কর দেয়ার সময় ছাড়া অন্য সময় প্রচারণা খুব একটা দেখা যায় না। আর কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানে নীতিবাক্যের পোস্টার দেখা যায়। জনগণকে বুঝাতে হবে, রাষ্ট্র চলে করের টাকায়।
-
- আমাদের দেশে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মান নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা আছে। সবার মুখে শুধু একই কথা, হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নেই, ডাক্তাররা ভালো করে রোগী দেখেন না, ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে ভুল রিপোর্ট প্রদান, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার গুণগত মান নেই, গবেষণাধর্মী কাজ হচ্ছে না, শিক্ষকদের যোগ্যতার অভাব, সময়োপযোগী দক্ষ শ্রমশক্তি সৃষ্টির উদ্যোগ নেই। হাজার আলোচনা-সমালোচনা হলেও মান বাড়ানোর জন্য বাজেট বাড়ে না। দেশে দক্ষ শ্রমশক্তি সৃষ্টি না হওয়ার কারণে বিদেশীরা এখন বাংলাদেশের শ্রমবাজার দখল করে নিচ্ছে। অথচ দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টিতে তেমন কার্যকর উদ্যোগ নেই বললে চলে। স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত গবেষণা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থায় উন্নয়ন না হলে দেশের জনগোষ্ঠীর একটি বিশাল অংশ বিদেশের দিকে ঝুঁকে পড়বে। কাঙ্খিত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিতে প্রতি বছর বিদেশগামী হবে অসংখ্যা মানুষ। আর এসবের কারণে দেশ থেকে পাচার হয়ে যাবে হাজার কোটি টাকা।
-
- আমাদের মূল সমস্যা হচ্ছেÑ সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা করার জন্য উৎসাহিত করা হয় না। প্রতি বছর গতানুগতিক ডিগ্রি নিয়ে বের হচ্ছে অসংখ্যা শিক্ষার্থী। কিন্তু দক্ষতা ও গুণগত শিক্ষার অভাবে শিক্ষিত শ্রেণীর একটি বিশাল অংশ কর্মসংস্থানের সুযোগ না পেয়ে বেকার থেকে যাচ্ছে। বাংলাদেশে এখন শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৪০টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে বেশ কিছু বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় এবং আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়। প্রশ্ন হচ্ছে, সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কি ভালো মানের শিক্ষা দেয়া হচ্ছে? সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগে কি অধ্যাপক আছে? অধ্যাপক তো রাতারাতি সৃষ্টি হয় না, বরং একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করে শিক্ষকরা অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। আর সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলোÑ অধ্যাপক হওয়ার জন্য যেসব যোগ্যতা প্রয়োজন, সেসব বিষয়ে শিক্ষকদের কাউন্সেলিং বা তাগাদার মতো কোনো উদ্যোগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চোখে পড়ে না। কিছু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পিএইচডি করার সুযোগ দিলেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে ভর্তি হতে বেগ পেতে হয়। অথচ কলেজ থেকে পাস করা যে কেউ পিএইচডিতে ভর্তি হতে পারে। এ এক চরম বৈষম্য। অথচ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও সরকার অনুমোদিত। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা তিন বছরের পিএইচডি সাত-আট-নয় বছরে বের হচ্ছে, সার্বিক বিবেচনায় তার কয়টি মানসম্পন্ন? কেবল ঢালাওভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈরাজ্যের কথা শুনি। তাদের কথা কেউ বলে না। তাই মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিদেশে পড়াশোনা করতে গিয়ে আর দেশে ফিরছেন না। আমাদের সমস্যা আমাদেরই সামাধান করতে হবে। আমাদের গবেষণায় প্রতি জোর দিতে হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও সত্যিকার অর্থে গবেষণার কাজ করতে হবে। সরকারিভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কোনো আর্থিক সহযোগিতা দেয়া হয় না, বরং এসব বিশ্ববিদ্যালয় সম্পূর্ণভাবে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির ওপর নির্ভরশীল। গবেষণাহীন শিক্ষা কোনো দিন কাক্সিক্ষত ফল উপহার দিতে পারে না। বরং গবেষণাহীন শিক্ষায় প্রায়োগিক ক্ষেত্রে বিপরিত ফলের আশঙ্কা থাকে। উন্নয়ন যদি টেকসই করতে হয়, তাহলে সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে গবেষণায়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে।
-
- স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়নের জন্য আমাদের বিদেশপ্রবণতা রোধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সংসদ সদস্য, মন্ত্রী এবং উচ্চপদস্থদের দেশের চিকিৎসার প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনার সব ব্যবস্থা নিতে হবে। উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ হতে হলে দক্ষ শ্রমশক্তি নিশ্চিত করার জন্য গবেষণা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে যথাযথ বাজেট প্রয়োজন। বর্তমানে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৫২টি দেশের দ্বিতীয় সর্বনি¤œ শিক্ষা বাজেট বাংলাদেশের। বাংলাদেশের চেয়ে শিক্ষা খাতে কম ব্যয় করে শুধু কম্বোডিয়া। আর স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের মতো আর কোনো দেশ এত কম হারে ব্যয় করে না। এ চিত্রটি উঠে এসেছে জাতিসঙ্ঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোস্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিকের (এসকাপ) অর্থনৈতিক ও সামাজিক জরিপে। ২০১৮ সালের প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
-
- গতানুগতিক বাজেট না দিয়ে বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন খাতে কর কমিয়ে করের পরিধি সম্প্রসারণ হলে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে অনেকে। প্রথম বছরে রাজস্ব আদায়ে হয়তো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে কর আদায় বাড়বে, যা দেশের উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট না হওয়ার কারণে দেশে বাজেটের সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। মাঝপথে সংশোধিত বাজেট দেয়া হয়, তাও বাস্তবায়ন হয় না। আমাদের দেশে বাজেট ঘোষণা হয়, কিছু বাস্তবায়ন হয়, বাকিটা হয় না বা কতটুকু হয় তাও বিশ্লেষণ করা হয় না। তবে বিভিন্ন আলোচনা-সমালোচনায় তা কিছুটা বের হয়ে আসে। বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট প্রয়োগ না হওয়ার মূল কারণ হচ্ছেÑ সর্বত্র পেশাদারিত্বের অভাব এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অপেশাদারি ও অপরিপক্বতা দেখা যায়। অনেকাংশে পেশাজীবীরাই অপেশাদারির পরিচয় দেন। আবার এই অপেশাদারির কারণ নীতি-নৈতিকতার অধঃপতন।
-
- মৌলিক চাহিদার ওপর কর আরোপের ফলে মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষের ওপর এর তীব্র প্রভাব পড়ে, মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষেরই কষ্ট সব সময় বেশি। যার ফলে সার্বিকভাবে সমাজে আয়বৈষম্য হয় ও অনৈতিকতার দিকে সমাজ ধাবিত হয় এবং দুর্নীতি প্রসারিত হয়।
-
- বাজেট আসে, বাজেট যায়, প্রতি বছরের মতো এবারো অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করা হবে। লক্ষ কোটি টাকার সুবিশাল বাজেট হবে। বিশাল আকার আর আয়তনের জন্য বাজেট বিভিন্ন মহলে বেশ আলোচিত কিংবা সমালোচিত হবে। যাদের জন্য দেশ, সেই সাধারণ জনগণ সরকারের এই বাজেট নিয়ে কতটুকু মাথা ঘামান! তবে কেউ দেশের উন্নয়ন, বিদেশের সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, জিডিপি ইত্যাদি কঠিন কঠিন কিছু শব্দ সহকারে বক্তব্য দেবেন। কেউ আবার এমন করুণ ও বিরক্তিকর বর্ণনা শুনিয়ে দেবেন। আসলে বাস্তবতার আলোকে, আমজনতার ভাগ্যের উন্নয়নের জন্য হওয়া উচিত। সমস্যার আবর্তেই থেকে যাই আমরা। দিনের পর দিন। যুগের পর যুগ। সরকারের পর সরকার। কারণ বাজেটে যা কিছু কল্যাণকর, সে শুধু উচ্চ শ্রেণীর মানুষ কিংবা বিশেষ এক শ্রেণীর জন্যই। আশা করি, ২০১৯-২০ সালের বাজেট গবেষণা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে যথাযথ বাজেট দিয়ে দেশে দক্ষ মানসম্পন্ন সুস্বাস্থ্য জনশক্তি সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
-
- লেখক : অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ, সাদার্ন ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম
