চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর চুক্তির ফলে সরসরি ভারত মহাসগারে প্রবেশের সুযোগ পেতে যাচ্ছে চীন। চীন-মিয়ানমারের মধ্যে সাম্প্রতিক কয়েকটি চুক্তিতে বিপত্তিতে পড়েছে ভারত। কারন দুই দেশের মধ্যে এসব চুক্তির ফলে গভীর প্রভাব পড়তে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে। বঙ্গোপসাগরের নীল জলরাশিতে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দির্ঘদিন ধরে ভারত, চীনসহ আরো কয়েকটি দেশের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের লড়াই চলছে। এবার এ লড়াইয়ে বিজীয় হতে চলেছে চীন।
মিয়ানমারের সাথে চীনের অর্থনৈতিক করিডোর চুক্তি আর বেল্ড অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের মাধ্যমে গোটা দক্ষিন এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতি আর নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় ধরনের rdvhAkb পরির্বতন ঘটতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা । একই সাথে চীনের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পে মিয়ানমারসহ দক্ষিন এশিয়ার প্রায় সব দেশ যুক্ত হওয়ায় ভারত খুব বাজেভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েবে বলেও মন্তব্য করেছেন কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ।
মিয়ানমার ঘিরে চীন, ভারত আর রাশিয়ার রয়েছে বিশেষ স্বার্থ। মিয়ানমারের সাথে চীনের সম্পর্ক শুধু অর্থনৈতিক নয় বরং বহুমাত্রিক। এ অঞ্চলে ভারতকে মোকাবেলায় বঙ্গোপসাগর কেন্দ্রিক ভূরাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় মিয়ানমার চীনের কাছে খুবই গুররুত্বপূর্ণ একটি রাষ্ট্র। মিয়ানমারের রাখাইন থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে চীন ২০১৩ সাল থেকে গ্যাস নিয়ে যাচ্ছে। রাখাইন থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনে তেল সরবরাহ শুরু হয় ২০১৪ সালে। সর্বশেষ ১৭ ও ১৮ জানুয়ারি চীনের প্রেসিডেন্ট মিয়ানমার সফরে দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক করিডোর চুক্তি করে। এর মাধ্যমে চীন রাখাইনে গভীর সমুদ্র বন্দর ও বিশেষ অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠা করবে। প্রেসিডেন্ট শি”র সফর আর দুই দেশের গভীর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মাধ্যমে আঞ্চলিক রাজনীতিতে বিজয়ী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে চীন।
অপর দিকে মিয়ানমার কেন্দ্রিক ভারতের যেসব স্বার্থ রয়েছে তার মধ্যে রয়েছে রাখাইন থেকে ভারতের সেভেন সিস্টারস রাজ্যে গ্যাস বিদ্যুৎ সরবরাহ, ট্রানজিট ও বিশেষ অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠা রাখাইনে। মিয়ানমার রাশিয়া থেকে হেলিকপ্টার গানশিপ, মিগ ২৯সহ অনেক সমরাস্ত্র কিনছে। রাশিয়া ইয়াঙ্গুনে মিগ কোম্পানির অফিস খুলেছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ২০১৩ সালে রাশিয়ার সাথে চুক্তি করেছে মায়ানমার। তেল গ্যাস আবিষ্কারের কারণে ইয়াঙ্গুনে রাশিয়ার কোম্পানি গ্যাজপ্রম অফিস খুলেছে।
২০১৭ সাল রোহিঙ্গা নিধন শুরুর পর থেকে বিভিন্ন দেশের স্বার্থের বিষয়গুলো সামনে আসে। মিয়ানমারকেন্দ্রিক স্বার্থ বজায় রাখতে প্রভাবশালী দেশগুলো দেশ নিরব ভূমিকা পালন করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মিয়ানমার সফর করেন। কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে ছিলেন নীরব। শেষ পর্যন্ত চীন-মিয়ানমার চুক্তি আর গভীর বন্ধনের ফলে মিয়ানমার কেন্দ্রিক ভারতের স্বার্থ আর আঞ্চলিক আধিপত্যের লড়াই ভন্ডুল হয়ে গেছে বলে মনে করেন অনেকে।
চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মিয়ানমার সফর শেষে যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে- ‘ব্যাপক কৌশলগত অংশীদারিত’¡ পারষ্পরিক সুবিধা, সমতা এবং সমান লাভের সহযোগিতার লক্ষ্যের ভিত্তিতে চীন মিয়ানমার এগিয়ে চলছে। রাষ্ট্রীয় ভোজ সভার বক্তব্যে শি জিনপিং বলেন, দুই দেশের ভ্রাতৃত্বপূর্ণ বন্ধুত্ব হাজার বছর স্থায়ী হতে পারে। এর কারণ দুই দেশে একে অপরের ভাল মন্দে পাশে দাড়িয়েছে । এ ছাড়া উভয় দেশ পারষ্পরিক শ্রদ্ধা ও সুবিধার নীতি মেনে চলে। শি বলেন, চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর বা সিএমইসি বাস্তবে রুপ দিতে উভয় দেশের জোর দেয়া উচিত এবং ভাই হিসেবে আমাদের সম্পর্ক প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম নিয়ে যাওয়া উচিত।
চীন -মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোরের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরে প্রবেশের সুযোগ পাবে চীন। এর ফলে পারস্য উপসাগর থেকে তেল গ্যাস আমদানির রুট হিসাবে ব্যবহৃত হবে। তুলনামূলক পিছিয়ে থাকা চীনের দক্ষিনাঞ্চল বিশ্ববাজারের সাথে যুক্ত হতে পারবে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা উপেক্ষা করে চীনা কৌশলগত পরিকল্পনার একটি বড় লক্ষ্য বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ অঞ্চলে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পসমূহের বিরুদ্ধে ভারতের যে কৌশলগত পদক্ষেপ তাও বড় ধরনের বিপত্তির মুখে পড়েছে।
ভারত মহাসাগরে প্রবেশাধিকারের ফলে খুব স্বাভাবিকভাবে এখানে চীনের বড় ধরনের নৌবাহিনীর উপস্থিতি ঘটবে। আর নিকট ভবিষ্যতের চীনা নৌবাহিনী এ অঞ্চলের সমুদ্র বন্দর ব্যবহারেরও অনুমতি চাইবে।
চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোরের সবচেয়ে বেশি ভূরাজনৈতিক তাৎপর্যপূর্ণ বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে। মালাক্কা প্রণালী যদি হয় ভারত চীনের ভবিষ্যত নৌ শক্তির ভারসাম্যের মাপকাঠি। তাহলে বলা যায় এ পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। কারণ ভারত মহাসগারে চীনের উপস্থিতি ঠেকাতে ভারত মালাক্কা প্রণালীর পশ্চিম মুখে অবস্থান শক্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু চীন পাকিস্তান ও চীন – মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর এ ক্ষেত্রে ভারসাম্য সৃষ্টি করছে। অর্থনৈতিকম কূটনৈতিক এবং সামরিকভাবে এগিয়ে থাকার কারনে চীন ভারতের ওপরে থাকবে এবং ভারত মহাসাগরে চীনই আধিপত্য বিস্তার করবে। মার্কিন বিশ্লেষক জেমস হোমস সম্প্রতি বলেছেন, আন্দামানে চীন-ভারত একটি বড় খেলা সামনে রয়েছে। এ খেলায় কে বিজয়ী হবে তা যুগ বা বছরের হিসেবে ওপর নির্ভর করছে না। একজন দক্ষ খেলোয়াড় এ খেলায় বিজয় নির্ধরণ করবে।
মিয়ানমারের অন্যতম ভূকৌশলগত এলাকা কিয়াউকপিউতে বিশেষ অর্থনৈতিক জোন, চীন-মিয়ানমার সীমান্ত অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোন গঠনে সম্মত হয়েছে উভয় দেশ। এ সীমান্ত জোনে সড়ক, রেল, বিদ্যুৎ অবকাঠামো নির্মান করা হবে। বঙ্গোপসাগরে গভীর সমুদ্রবন্দর আর ১ হাজার ৬শ কিলোমিটার দীর্ঘ বিশেষ অর্থনৈতিক জোন রাখাইন রাজ্যে গড়ে তোলা হবে। চীনের প্রেসিডেন্টের সফরের মাধ্যমে চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর পরিকল্পনা পর্যায় থেকে বাস্তবায়নের পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। মিয়ানমার সেনা প্রধান মিন অং হলাইং জোর দিয়ে বলেছেন, মিয়ানমার চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পে দৃঢ়ভাবে সহযোগিতা করবে।
মিয়ানমার ঘিরে চীন ভারত ও রাশিয়া স্বার্থ মূলত রাখাইন রাজ্যে। ২০০৪ সালে রাখাইনের বঙ্গোপসাগর এলাকায় তিনটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়। এতে বিশ্ব গ্যাস মানচিত্রে নতুনভাবে পরিচিতি পায় রাখাইন সমুদ্র এলাকা। দক্ষিণ কোরিয়া এবং ভারতের রাষ্ট্রীয় কোম্পানি ওএনজিসি এই গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে। ২০১২ সালে বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তির পর ব্যাপকভাবে তেল গ্যাস অনুসন্ধান শুরু হয় রাখাইন সমুদ্র এলাকায়। ২০১৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার তেল কোম্পানি দ্বিতীয় গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে রাখাইন সমুদ্রে। একই সাথে যুক্তরাজ্যের শেল অয়েল, যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন, জাপানের মায়েকো, ফ্রান্সের টোটাল অয়েল সেখানে তেল গ্যাস অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে।
রাখাইন থেকে তেল গ্যাস চীনে নিয়ে যাওয়ার জন্য সিনো-মিয়ানমার তেল গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণে ২০০৫ সালে মিয়ানমারের সাথে চুক্তি করে চীন। ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তি অনুযায়ী পাইপলাইনের মাধ্যমে সঞ্চালিত গ্যাসের ২০ ভাগ পাবে মিয়ানমার। বাকিটা যাবে চীনে। ২০০৯ সালের অক্টোববরে পাইপলাইন নির্মাণ কাজ শুরু হয় । ২০১৩ সালের অক্টোবরে চীনে গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়। পাইপলাইন দিয়ে বছরে ১২ বিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাস সঞ্চালিত হচ্ছে।
আকিয়াব বন্দর থেকে কুনমিং পর্যন্ত তেল ও গ্যাস পাইপলাইন বসাতে চীনকে বিনিয়োগ করতে হয়েছে ২ দশমিক ৫৪ মিলিয়ন ডলার। রাখাইনের সিউ গ্যাসফিল্ড থেকে এ গ্যাস নেয়া হচ্ছে চীনের কুনমিং পর্যন্ত। তেল পাইপ নির্মাণের কাজ শেষ হয় ২০১৪ সালের আগস্টে। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পরীক্ষামূলকভাবে তেল সরবরাহ শুরু হয়। দিনে চার লাখ ৪০ হাজার ব্যারেল তেল সঞ্চালনের ক্ষমতা রয়েছে এ পাইপলাইনের।
রাখাইন হয়ে মান্দালয়, লাশিয়ো, মুজে দিয়ে এ তেল গ্যাস পাইপলাইন চীনের ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিং পর্যন্ত পৌঁছে। আকিয়াব থেকে কুনমিং পর্যন্ত গ্যাস পাইপলাইনের দৈর্ঘ্য ৭৭১ কিলোমিটার। আর তেল পাইপ লাইন আকিয়াব থেকে কুনমিং হয়ে চীনের গুইজু এবং গুয়াঞ্জি পর্যন্ত পৌঁছার কথা। এর দৈর্ঘ্য দুই হাজার ৮০৬ কিলোমিটার। গ্যাস সঞ্চালনের জন্য চীন রাখাইনে গ্যাস টার্মিনাল নির্মাণ করেছে।
রাখাইনে চীনা অবস্থানের বিপরীতে ভারতের অন্যতম বৃহত্তম প্রকল্পের নাম হলো ‘কালাদান মাল্টি মোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট’। এটি বাস্তবায়নে মোদি সরকার ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ৫০ কোটি ডলার ছাড় দিয়েছে। কালাদান প্রকল্প অনুযায়ী ভারতের মিজোরাম থেকে রাখাইনের রাজধানী সিটওয়ে হয়ে কলকাতা পযন্ত বিশাল এক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক হবে।
ভারতের এই প্রকল্পের মাধ্যমে মিজোরামের সাথে বঙ্গোপসাগরের যোগাযোগ স্থাপিত হবে। প্রথমে রাখাইনের রাজধানী সিটওয়ে সমুদ্রবন্দর থেকে কালাদান নদীর মাধ্যমে মিয়ানমারের সিন রাজ্যের পালেটওয়া বন্দরের সাথে নৌ যোগাযোগ স্থাপন হবে। যার দৈর্ঘ্য ১৫৮ কিলোমিটার। এরপর পালেটওয়া বন্দর থেকে সড়ক পথে যোগাযোগ স্থাপন করা হবে মিজোরামের রাজধানী আইজলের সাথে। অপর দিকে সিটওয়ে সমুদ্রবন্দর থেকে সোজা বঙ্গোপসাগর হয়ে যোগাযোগ হবে কলকাতা বন্দরের সাথে। কালাদান প্রকল্পের অধীনে ভারত রাখাইনে সমুদ্র বন্দর নির্মাণেরও উদ্যোগ নিয়েছে।
ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্টান ওএনজিসি রাখাইনে আবিষ্কৃত গ্যাস সিটওয়ে থেকে মিজোরাম, আসাম ও শিলিগুঁড়ি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার জন্য দীর্ঘ পাইপলাইন স্থাপনেরও পরিকল্পনা করে। ২০১৬ সালে ভারত পরিকল্পনা করে রাখাইনের কালাদান নদীর উজানে এক হাজার একর জমির ওপর বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার। রাখাইনের পাহাড়ি চীনদুইন নদীর ওপর দু’টি বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে ভারতের ১৮ শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে। এ বিদ্যুৎ যাবে মনিপুর রাজ্যে। ভারতের আরো বেশ কিছু বিনিয়োগ পরিকল্পনা রয়েছে রাখাইনসহ মিয়ানমারে। মিয়ানমারও ২০১১ সালে রাখাইনে বৃহত্তর অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের ঘোষণা দেয়। মিয়ানমার বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য ‘এশিয়া ফাইনাল ফ্রন্টিয়ার’ কর্মসূচি ঘোষণা করে যার মাধ্যমে রাখাইনে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের নামমাত্র মূল্যে দীর্ঘ মেয়াদে জমি লিজ দেয়া হবে।