রাজনৈতিক সংগঠনের সহযোগী ভুঁইফোঁড় সংগঠন:নকলের কাছে আসল কোণঠাসা?
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগঠনের নামে-বেনামে সহযোগী সংগঠনের নাম ব্যবহার করে গড়ে ওঠা ভুঁইফোঁড় সংগঠনগুলোকে নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা র্দীঘদিনের । সংগত কারনে ক্ষমতাসীন সংগঠনের এই সংগঠনগুলির কর্মকান্ডে সংবাদে শিরোনাম হয়।
সম্প্রতি ফেসবুকে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ’ নামের একটি সংগঠনের পোস্টার ভাইরাল হয়৷ ‘আওয়ামী চাকরিজীবী লীগের’ মাধ্যমে ভুঁইফোঁড় সংগঠন আবার আলোচনায় আসে৷ এতে লেখা ছিল ‘জেলা, উপজেলা ও বিদেশী শাখায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে’৷ পোস্টারে সংগঠনের সভাপতি হিসেবে হেলেনা জাহাঙ্গীরের নাম ও ছবি প্রকাশিত হয়৷ এরপর সমালোচনা শুরু হলে আওয়ামী লীগের উপকমিটির সদস্যপদ হারান হেলেনা জাহাঙ্গীর৷ ২৯ জুলাই ২০২১ বৃহস্পতিবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়৷
২০০৯ সাল থেকে টানা ক্ষমতায় থাকায় আওয়ামী লীগের নামে অনেক ভুঁইফোঁড় সংগঠন গড়ে উঠেছে৷ ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে অনেকেই অনেক সুবিধা নিতে এইসব ভুঁইফোঁড় সংগঠন তৈরি করেন৷এই সংখ্যা কয়েকশতরও বেশি হবে৷ অনেকের মতে তারা মূল দলেও ঢুকে পড়েছে৷ হেলেনা জাহাঙ্গীর কীভাকে আওয়ামী লীগের উপ-কমিটির সদস্য হয়েছিলেন সেটাই একটা বিস্ময়৷ রিজেন্ট শাহেদও আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য ছিল৷ অনুমোদন নাথাকলেও সংগঠনের মধ্যেই তাদের পৃষ্ঠপোষক আছে৷ আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও তাদের নিবৃত্ত করা যায় নাই৷ এসব সংগঠনের অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের নেতা ও মন্ত্রী-এমপিদের দেখা যায়৷
সংগঠনের নামের আগে-পরে শুধু আওয়ামী বা লীগ শব্দ জুড়ে দিয়েই শেষ নয়, বঙ্গবন্ধু, শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, শেখ হাসিনা, সজীব ওয়াজেদ জয়ের নাম বসিয়েও ভুঁইফোঁড় সংগঠন তৈরি হয়েছে৷ একটি সংগঠনের নাম ‘সজীব ওয়াজেদ জয় পরিষদ’৷ সজীব ওয়াজেদ জয় নিজেই ক্ষোভ প্রকাশ করে ফেসবুকে এক পোস্ট দেন এই সংগঠনের ব্যাপারে৷
২০১৯ সালে আওয়ামী ওলামা লীগ যেসব এনজিও বাল্যবিবাহ বন্ধের জন্য কাজ করছে তাদের নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছিল৷ ওলামা লীগ বিপিএলের নামে জুয়া খেলা হচ্ছে দাবি করে বিপিএল বন্ধেরও দাবি করেছিল৷ পহেলা বৈশাখে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালানো, উলুধ্বনি দেওয়া বিধর্মীদের কাজ৷ সেই সময় ‘আওয়ামী ওলামা লীগ’ নামে আওয়ামী লীগের কোনো সহযোগী সংগঠন নেই বলে বিবৃতি দেয়ার পরও তারা সক্রিয়৷
২০১৮ সালে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে ‘বঙ্গবন্ধু প্রজন্ম লীগ, নেতা মোদের শেখ মুজিব’ স্লোগান শুনে মঞ্চে থাকা আওয়ামী লীগ নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাৎক্ষণিকভাবে বিষ্ময় প্রকাশ করেন।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে আটটি সহযোগী ও তিনটি ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন রয়েছে৷ এগুলো হলো যুবলীগ, যুব মহিলা লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, তাঁতী লীগ ও আওয়ামী মৎস্যজীবী লীগ৷ এর বাইরে ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ ও মহিলা শ্রমিক লীগ ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন হিসেবে স্বীকৃত৷
রাজনৈতিক অঙ্গনে এ সংগঠনগুলোকে ‘দোকান’ বলা হয়। এসব সংগঠনের কর্মসূচিতে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা প্রধান অতিথি হয়ে থাকেন। যেকারনে, সংগঠনগুলোর খবর গণমাধ্যমে আসে। যার ফলে নামসর্বস্ব এসব সংগঠনের সভাপতি বা সেক্রেটারি সরকারের কাছ থেকে নানা সুবিধা নেন এবং প্রভাব দেখান। সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে সরকারি দলটি বারবারই বলে এসেছে, তাদের গঠনতন্ত্রে উল্লেখ করা সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাড়া বাকি কোনো সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক নেই।যদিও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে সংগঠনটির বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। এ ধরনের সংগঠনের জন্ম নেওয়াও থেমে থাকেনি।
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সূত্র বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে গজিয়ে ওঠা, নানা নামে একম শতাধিক ভুঁইফোঁড় সংগঠন আছে৷ সংগঠনতন্ত্রে না থাকলেও চিকিৎসকদের পেশাজীবী সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসা পরিষদের কর্মকাণ্ডে ক্ষমতাসীনদের ‘সায়’ দেখা যায়। তা ছাড়া বঙ্গবন্ধু পরিষদ ও শেখ রাসেল শিশু-কিশোর পরিষদের মতো কিছু সংগঠনের কর্মকাণ্ডে রাজনৈতিক স্বীকৃতি দেয় আওয়ামী লীগ। দলটির এক নেতা জানান, বঙ্গবন্ধু পরিষদ ও শেখ রাসেল শিশু-কিশোর পরিষদের মতো কিছু সংগঠন পঁচাত্তরের পর বৈরী পরিবেশে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রচার করেছে। এ কারণে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এছাড়াও বাহারি নামের আরো অনেক সংগঠন যেগুলোর কথা আওয়ামী লীগের জানা নেই। ৷
আর বঙ্গবন্ধু বা তার পরিবারের সদস্যদের নামে কোনো সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান করতে হলে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের’ অনুমোদন নেয়ার নিয়ম আছে৷
বিএনপিতেও কম নেই বিএনপির নামে ভুঁইফোঁড় সংগঠন ।তবে দল ক্ষমতায় নেই বলে তাদের নিয়ে আলোচনাও নেই৷ মূলত দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ শব্দ ঘিরে গড়ে উঠেছিল সংগঠনগুলো।
দলের ওয়েবসাইটে অঙ্গ সংগঠন হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা দল, যুবদল, কৃষক দল, স্বেচ্ছাসেবক দল, তাঁতী দল, ওলামা দল ও মৎস্যজীবী দলের নাম রয়েছে৷ আর সহযোগী সংগঠন হিসেবে আছে ছাত্রদল ও শ্রমিক দলের নাম৷২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপির নামে অনেক ভুঁইফোঁড় সংগঠন গড়ে উঠেছিল৷ বিভিন্ন সংবাদ মিডিয়ার মাধ্যমে জানা যায়, বিএনপি ২০১২ সালে প্রায় ৪০টি সংগঠনের নাম উল্লেখ করে তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে দলীয় কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে৷ অবশ্য ২০১৪ নির্বাচনের পর এসব সংগঠনের তৎপরতা কমেছে৷ সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বিএনপি জানিয়েছে, ‘শহীদ জিয়া ছাত্র পরিষদ’ নামের সংগঠনের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই৷
বিএনপির একজন নেতা বলেন, দল ক্ষমতায় থাকার সময় বিএনপিতে অনেক ভুঁইফোঁড় সংগঠন ছিল৷ তখন তাদের দাপটে আমরা ছিলাম কোণঠাসা৷ দল ক্ষমতার বাইরে থাকায় এখন তারা তেমন আর সক্রিয় নয়৷ কেউ কেউ ব্যানার পরিবর্তন করে আবার আওয়মী লীগের নামের সাথে মিলিয়ে ভুঁইফোঁড় সংগঠন তৈরি করেছে৷ এরা এরকমই, যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলের কাছে থাকতে চায়৷ শুধু তাই নয়, বিএনপির অনেক সুসময়ের নেতা এখন আওয়ামী লীগে ভিড়েছেন৷ তারা বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময়ও সুবিধা নিয়েছেন এখন আওয়ামী লীগের কাছ থেকেও সুবিধা নিচ্ছেন৷
বিএনপির দপ্তর সম্পাদক বলেন, “এই সব সংগঠনের কোনো অনুমোদন দেয়নি বিএনপি৷ তবে সব সংগঠনই যে খারাপ তা নয়৷ এরমধ্যে ভালো সংগঠনও আছে৷ আর সংগঠন করা নাগরিকদের অধিকার৷ যারা নানা সংগঠন করে বেআইনি কাজ করেন সেটা দেখার দায়িত্ব আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর৷ আমরা দলের পক্ষ থেকে বারবার বিবৃতি দিয়ে বিষয়টি জানিয়েছি৷” কিছু সংগঠন এখনও চেষ্টা করছে সক্রিয় থাকার। বিভিন্ন ইস্যুতে জাতীয় প্রেস ক্লাব এলাকায় এসব সংগঠন তৎপর। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দলের ‘কোণঠাসা’ নেতাকে অতিথি করে আলোচনায় রাখার কৌশল নিত এসব সংগঠন। চাঁদাবাজির অভিযোগও রয়েছে অনেক সংগঠনের বিরুদ্ধে।
‘জি-নাইন (গ্রুপ-২০০৯)’ ও ‘শত নাগরিক কমিটি’ নামে দুটি সংগঠনকে দলের ‘থিঙ্কট্যাঙ্ক’ হিসেবে মর্যাদা দেয় বিএনপি। নব্বই দশকের ছাত্রনেতাদের করা সংগঠনের পাশাপাশি ‘নারী ও শিশু অধিকার ফোরাম’ নামের সংগঠনকেও গুরুত্ব দেয় বিএনপি।
বিএনপির নির্বাহী কমিটির এক সদস্য বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে অনেক সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। যেগুলোর এখন আর অস্তিত্ব নেই। দলের দুঃসময় এলে সুযোগ বুঝে তারা কেটে পড়েন। জাতীয় রাজনীতিতে এসব সংগঠন ভূমিকা না রাখলেও জনমত তৈরিতে তারা ভূমিকা পালন করে। অপর এক সদস্য বলেন, দলের মধ্যে কিছু লোক আছেন যারা সুযোগসন্ধানী। তারা রাজনীতিতে আসে হালুয়া-রুটির ভাগের জন্য। ক্ষমতায় এলেই তারা সক্রিয় হয়ে ওঠে। ক্ষমতা চলে গেলে তাদের দেখা যায় না। কিন্তু তার সংগঠন নতুন প্রজন্মের সামনে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে কাজ করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের তৃতীয় বিরোধী রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি । সরকার গঠনে প্রাং সময় এই দল গুরুত্বর্পূণ ভুমিকায় থাকে ।দলের ওয়েবসাইটে অঙ্গ সংগঠন হিসেবে জাতীয় যুব সংহতি, মহিলা পার্টি, কৃষক পার্টি, স্বেচ্ছাসেবক পার্টি, ওলামা পার্টি, সাংস্কৃতিক পার্টি, জাতীয় প্রাক্তন সৈনিক পার্টি ও জাতীয় তরুণ পার্টির নাম রয়েছে৷ এছাড়া সহযোগী সংগঠন আছে সাতটি৷ এগুলো হলো শ্রমিক পার্টি, আউনজীবী ফেডারেশন, ছাত্র সমাজ, মৎস্যজীবী পার্টি, তাঁতী পার্টি, মটর শ্রমিক পার্টি ও হকার্স পার্টি৷