চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে কার্যকর অনলাইন শিক্ষা জরুরি
করোনা মহামারির উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। তবে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সরকার অনলাইন ক্লাসে জোর দেয়। বেসরকারি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাস নেওয়ার সক্ষমতা থাকায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও অনুমতি দেয় যাতে শিক্ষার্থীরা সেশনজটে পড়ে পড়াশোনা থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়। প্রথম প্রথম নানা কারণে ও শঙ্কায় শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাস ও পরীক্ষার বিরোধিতা করলেও পরবর্তীতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। উপস্থাপনা, বাড়ির কাজ এবং পরীক্ষা সবই অনলাইনে হয়েছে। যদিওবা বিভিন্ন কারণে অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি কম ছিল। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর সরকারি নির্দেশনায় যখন স্ব-শরীরে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় তখন কিছু কিছু শিক্ষার্থী অনলাইনে পরীক্ষার অযৌক্তিক দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে জ্ঞান অর্জন, যেনতেনভাবে সনদ অর্জনকে জ্ঞান অর্জন বলা যায় না। নামমাত্র শিক্ষা নয়, বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রয়োজন কার্যকর অনলাইন শিক্ষা।
অনলাইন শিক্ষা ও অনলাইন পাঠ্যক্রম পরিচালনার মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। সাধারণত অনলাইন ক্লাস বলতে বুঝায় বিভিন্ন ফ্রি ওয়েব অ্যাপস ব্যবহার করে সরাসরি ক্লাস পরিচালনা। এই অ্যাপসগুলো ফ্রি হলেও ব্যবহার ব্যয়বহুল। এমনকি বিনা মূল্যে ৪০ মিনিট ব্যবহারের যে সুযোগ থাকে তাও ব্যয়বহুল। আর এই অ্যাপসগুলো ব্যবহারে যে নিরবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট গতি দরকার তা কেবল বড় শহরেই আছে ।
গত দুই দশকে, ইউরোপ-আমেরিকাতে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অনলাইন শিক্ষায় অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। উন্নত দেশে শিক্ষার্থীদের জন্য প্রযুক্তি নির্ভর ই-লার্নিং ব্যবস্থা চালু আছে। নিজেদের পছন্দের বিশেষ সফটওয়ারের মাধ্যমে অনলাইন পরীক্ষা নিচ্ছে এবং ডিগ্রিও প্রদান করছে। যা অত্যন্ত কার্যকর ব্যবস্থা। কিন্তু আমাদের দেশে অনলাইন শিক্ষা সম্পূর্ণ নতুন। অনলাইন সরাসরি ক্লাস করার জন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত ডিভাইসে উচ্চ ইন্টারনেট গতিসম্পন্ন সংযোগ থাকা যেমন প্রয়োজন তেমনি সঠিক প্রযুক্তি ছাড়া এ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের টিমওয়ার্ক গঠন করে ব্রেইন স্টর্মিং করে মান যাচাই করা খুবই কঠিন। কোনো সন্দেহ নেই যে অনলাইন শিক্ষা বিশ্বব্যাপী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেগুলোকে শিক্ষাপ্রদান, শেখার আচরণ এবং অনলাইন শিক্ষার উপর বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রভাবিত করছে। তবে কিছু প্রতিষ্ঠান যারা কয়েক দশক ধরে অত্যাধুনিক ডিজিটাল অবকাঠামোর মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান করছে, তাদের মানের উপর খুব কম প্রভাবই পড়েছে। আমাদের দেশে যে পদ্ধতিতে অনলাইন শিক্ষা চলছে তা শিক্ষার্থীদের জন্য কতটা কার্যকর সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের কোনো মতামতের প্রয়োজন নেই। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের জন্য এই নতুন ডিজিটাল শিক্ষা পদ্বতি একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
করোনাকালীন অনলাইন শিক্ষার সঠিক সমন্বয় করতে না পারার ভয়ে আমরা শিক্ষা ব্যবস্থাকে এক রকম হিমায়িত করে রেখেছি। প্রযুক্তি নির্ভর অবকাঠামো দিয়ে সঠিক মান নিয়ন্ত্রণ ও গ্রহণযোগ্য উপায়ে শিক্ষার মান নিশ্চিত করে উন্নত বিশ্বের মত অনলাইন এবং স্ব-শরীরে উভয় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। তার জন্য নিশ্চিত করতে হবে শিক্ষার্থী-শিক্ষকের মধ্যে সততা এবং নৈতিকতা। সঠিকভাবে প্রশ্ন করতে জানলেই শ্রেণি কক্ষে খোলা বই নিয়েও পরীক্ষা বা সফটওয়্যার ভিত্তিক পূর্ণ প্রযুক্তিতে অনলাইন পরীক্ষার মূল্যায়ন সম্ভব। প্রযুক্তিগত যে অবকাঠামো প্রয়োজন তা আমাদের দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানের যেমন নেই তেমনি অনেক শিক্ষার্থীদের সামর্থও নেই। যে পদ্ধতিতে আমাদের দেশে অনলাইন শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, তাতে শিক্ষার্থীদের প্রতারণা করার যথেষ্ট সুযোগ আছে এবং অনেকে উৎসাহিত হচ্ছে। অনলাইন শিক্ষা প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর উপর নির্ভর করে। প্রচুর নিরাপত্তা বেষ্টিত প্রযুক্তির সাথে শিক্ষা প্রদান পদ্ধতি, শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করার পদ্ধতি জরুরি। সেই সক্ষমতা কয়টি প্রতিষ্ঠানের আছে বা আমাদের কতজন শিক্ষক তা করতে প্রস্তুত? প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সাথে সাথে প্রতারণা যেমন সহজ হয়েছে, তেমনি প্রতারণা বন্ধেরও প্রচুর প্রযুক্তি বাজারে আছে। যার স্বক্ষমতা আমাদের দেশে অনেক উন্নত প্রতিষ্ঠানের নেই। অনেক প্রতিষ্ঠানে এখনো নিজেদের অফিস পরিচালনার জন্য সফটওয়্যারই নেই, থাকলেও সমন্বিত সফটওয়্যারের অভাব রয়েছে। আমরা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে পদার্পণ করেছি। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রচলিত উৎপাদন এবং শিল্প ব্যবস্থার স্বয়ংক্রিয়করণের একটি চলমান প্রক্রিয়া। সেখানে প্রযুক্তি প্লাটফর্ম ছাড়া অনলাইন শিক্ষা কতটুকু বাস্তব সম্মত!
দেশে মেধা যাচাইয়ের সহজ এবং সঠিক কোনো উপায় আছে কিনা আমার জানা নেই। তবে ভুল হলেও অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলতে পারা, এসএসসি ও এইচএসসিতে এ+ পাওয়া, যাকে আমরা অনেকে গোল্ডেন বলতে স্বাছন্দবোধ করি । নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়া। অনার্স ও মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া। বিসিএস গাইড মুখস্থ করে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ক্যাডার সার্ভিসে চাকরি করা। পেশা হিসাবে নামের সাথে অধ্যাপক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা ব্যারিস্টার ইত্যাদি থাকা; পিএইচডি থাকলেতো কথাই নেই! এরাই আমাদের সমাজে মেধাবী হিসেবে গণ্য। আর কেউ এই ক্যাটাগরির বাইরে হলে আর যাই হোক সমাজের চোখে মেধাবী নন। অতি সাধারণ কম মূল্যায়িত শিক্ষিত একজন মানুষ। কারণ আমরা অনেকেই মেধা ও প্রতিভা বলতে কি বুঝায়, তাই জানিনা। একজন মেধাবী মানুষ বিশেষ কিছু গুণাবলী ও দক্ষতা সম্পন্ন; অপর দিকে প্রতিভা হলো একজন মানুষের সৃজনশীল মানসিকতা ও অনেক দূরুহ কোনো কাজে হাত দেওয়া বা আবিষ্কার করা। যা আগে কেউ করেনি, অথবা করলেও পুরোপুরি সফল হতে পারেনি। তবে মেধা ও প্রতিভার মধ্যে সূক্ষ্ম কিছু পার্থক্য থাকলেও এদু’টির সমন্বয়ে মানুষের চিন্তা শক্তির বিকাশ ঘটে, নতুন নতুন আবিষ্কারের পথ সুগম হয় এবং অর্জিত শিক্ষা থেকে মানুষের উপলব্ধি হয়। যে পক্রিয়ায় অনলাইন শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে তাতে জ্ঞানী চিন্তাশীল ও যুক্তি নির্ভর সুনাগরিক পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। জ্ঞানী চিন্তাশীল ও যুক্তি নির্ভর মানুষ অন্যের যুক্তি পূর্ণ মতামতকে মর্যাদা দেন, তারা স্বেচ্ছাচারী হন না। যুক্তির মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগায়; প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় অর্জিত সনদ; প্রতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি মাত্র। এগুলো অর্জনের পাশাপাশি মেধা, প্রতিভা, বোধশক্তি, চিন্তাশক্তি, আচরণ, সততা, সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং রাষ্ট্রীয় আইন মেনে চলার সমন্বয় ঘটাতে হয়।
ইউজিসি মিশ্র শিক্ষার (Blended Learning) জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। অনেক দেশেই তা প্রচলিত। দেশের অনেক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান এই পদ্ধতির জন্য সাধুবাদও জানিয়েছে। যেদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে সৎ সন্তানের মত দেখা হয়। যেখানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে পাশ করে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য বা চাকরির বাজারে যে অপদস্থ হতে হয় তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন। সেখানে প্রযুক্তিগত প্লাটফর্ম ছাড়া অনলাইন শিক্ষায় শিক্ষিতদেরকে যথাযত মূল্যায়িত করবে তো? বর্তমান পদ্ধতিতে অনলাইন শিক্ষা প্রতারণায় কারো কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। যার ফলে অনলাইন শিক্ষা এবং প্রচলিত শ্রেণি কক্ষে স্ব-শরীরে উপস্থিত শিক্ষায় গুণগত পার্থক্য বিদ্যমান।
এক সময় দেশের পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে নকলের মহা-উৎসব চলতো; এখন প্রথাগত নকল কম হলেও শুরু হয়েছে নতুন উপদ্রব! ডিজিটাল পদ্ধতিতে বিভিন্নভাবে প্রতারণা। এটা কোনো আশ্চর্য্যের বিষয় নয় যে শিক্ষার্থীরা অনলাইনে প্রতারণা করার উপায় খুঁজবে না। যদিও প্রতিটি প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রতারণা মোকাবেলার জন্য তাদের নিজস্ব ব্যবস্থা প্রয়োগ করে, যখন সমস্ত ক্লাস অনলাইনে থাকে এবং শিক্ষার্থীরা এক জায়গায় থাকে না তখন তা নিয়ন্ত্রণ ও নিরীক্ষণ করা কঠিন। সঠিক পরীক্ষা পদ্ধতি, পর্যাপ্ত সুরক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় অনলাইন প্রতারণা নিয়ন্ত্রণ আরও কঠিন। শিক্ষকরা মনে করেন, শিক্ষার্থীদের অনলাইনে প্রতারণা করার সুযোগ বেশি, ইন্টারনেট এবং সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তির সাহায্যে, বর্তমান শিক্ষার্থীরা আগের প্রজন্মের চেয়ে অনেক বেশি সুযোগ-সন্ধানী। যে কারণে দেশে বর্তমানে শিক্ষার্থীরা স্ব-শরীরে শ্রেণিকক্ষে পরীক্ষার চেয়ে অনলাইনেই পরীক্ষা দিতে বেশি আগ্রহী। যা মানসম্পন্ন শিক্ষায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে।
মানুষ যত জ্ঞানী হয় ততো বিনয়ী হয়; যত বড় আসনে বসে ততো মনোযোগী হয়; ভাবুক হয়; যুক্তি নির্ভর হয়; মানবিক হয়; বিবেকবান হয়। প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান অর্জন করে শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণ করলে তাকে জ্ঞানী বলা যায় না, তিনি জ্ঞান পাপী। একজন মেধাবীর আত্ম উপলব্ধির স্তর যত উপরে উঠবে তার জ্ঞানের পরিধি ততো বাড়বে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে অনেক কথা আছে। আর সঠিক প্রযুক্তি এবং শিক্ষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ছাড়া বর্তমানের অনলাইন শিক্ষিতরা আমাদেরকে কতটা আলোর পথ দেখাবে এটাই প্রশ্ন!
লেখক: অধ্যাপক, উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা, সাদার্ন ইউনিভার্সিটি ও টেকসই উন্নয়নকর্মী