দেশে প্রতিদিন গড়ে ৩৫ জন মানুষ আত্মহত্যা করছে৷ আত্মহত্যার মধ্যে বিত্তবান, শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার নারী-পুরুষ রয়েছে।ফেসবুক লাইভে ঘোষণা দিয়ে আত্মহত্যার প্রবণতাও বাড়ছে৷ সম্প্রতি ঢাকায় ফেসবুক লাইভে এসে আবু মহসিন খান নামের এক ব্যবসায়ী নিজের পিস্তল দিয়ে আত্মহত্যার ঘটনা দেশের মানুষকে ব্যাপক নাড়া দিয়েছে৷ উঠে এসেছে নগর জীবনের নিঃসঙ্গতার কথা৷ তিনি চিত্রনায়কের শ্বশুর হওয়ায় আলোচনাটা হয়তো একটু বেশি হয়েছে৷দেশে পারিবারিক ও সামাজিক নীতি-নৈতিকতা, ধর্মীয় মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের কারনে এর ফলস্বরূপ আত্মহত্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।
আত্মহত্যা একাকীত্ব থেকে গভীর বিষন্নতার ফল৷ বিশেষজ্ঞদের মতে মানসিক স্বাস্থ্যও শারীরিক স্বাস্থ্যের মতই গুরুত্বপূর্ণ তা অনেকেই বুঝতে পারে না৷ পৃথিবীতে নগরেই আত্মহত্যা বেশি ঘটে৷ বাংলাদেশেও তার প্রভাব পড়ছে৷ প্রযুক্তি মানুষকে যেমন সচেতন করে তেমনি আত্মহত্যাপ্রবণ করে৷
২০২১ সালের জুনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এক প্রতিবেদনে জানায়, সারা বিশ্বে বছরে অন্তত সাত লাখ তিন হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে৷ প্রতিবেদনে বলা হয়, সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা হয় নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশে৷ বিশ্বের মাত্র পাঁচটি দেশে পুরুষদের চেয়ে নারীরা বেশি আত্মহত্যা করেন বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷ এর মধ্যে বাংলাদেশ একটি৷ বাকিগুলো হচ্ছে মিয়ানমার, চীন, মরক্কো ও লেসোথা৷বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী প্রতিবছর বিশ্বে আট লাখ লোক আত্মহত্যা করেন৷ দৈনিক আত্মহত্যা করেন ২,১৯১ জন৷ প্রতি লাখে ১৬ জন৷ডাব্লিউএইচও-র প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি চল্লিশ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যা করে৷
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো(বিবিএস)-এর জরিপ অনুযায়ী দেশে বছরে প্রায় ১৩ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে ৷ গড়ে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে ৩৫ জন৷ বিবিএস-এর তথ্য অনুযায়ী, করোনার প্রথম বছর আত্মহত্যা বেড়েছে ১৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ৷ মোট আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ১৪ হাজার ৪৩৬টি৷
তরুণদের সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের ২০২১ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে যে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন আত্মহত্যা করেছেন, তাদের মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি৷ মোট আত্মহত্যার ৫৭ শতাংশ, অর্থাৎ ৮ হাজার ২২৮জনই ছিলেন নারী৷প্রতিবেদনে জানায়, করোনাকালে এক বছরে সারা বাংলাদেশে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন আত্মহত্যা করেছেন৷ ২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩টি জাতীয় পত্রিকা, ১৯টি স্থানীয় পত্রিকা, হাসপাতাল ও থানা থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়৷ আঁচল ফাউন্ডেশনের সেই প্রতিবেদনে আত্মহত্যাপ্রবণ বয়সের ধারণাও উঠে আ্সে৷ এতে আত্মঘাতী হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সি ছিলেন ৪৯ শতাংশ, ৫ থেকে ১৯ বছর বয়সি ৩৫ শতাংশ এবং ৩৬ থেকে ৪৫ বছর বয়সি ১১ শতাংশ। সেই সময় সবচেয়ে কম আত্মহত্যা করেছিলেন ৪৬ থেকে ৮০ বছর বয়সিরা- ৫ শতাংশ। ২০২০ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা হয়েছে পারিবারিক সমস্যার কারণে৷ ওই সময়ে মোট আত্মহত্যার ৩৫ শতাংশই ছিল পারিবারিক সমস্যাজনিত কারণে৷ এর বাইরে ২৪ শতাংশ সম্পর্কে টানাপোড়েনের কারণে এবং যথাক্রমে ৪ ও ১ শতাংশ আর্থিক সংকট ও লেখাপড়া নিয়ে দুর্ভাবনা বা পরীক্ষায় ব্যর্থতার কারণে কারণে আত্মহত্যা করেছিল। তবে ৩২ শতাংশ মানুষের আত্মহত্যার কারণ থেকে যায় অজ্ঞাত৷
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাবে বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ১০ হাজার মানুষ শুধু ফাঁসিতে ও বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে৷ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তথ্যমতে, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের ৩১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় আত্মহত্যাজনিত অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে দুই হাজার ১৬৬টি৷ আর আত্মহত্যার হার দিন দিন বাড়ছে৷ বিশেষ করে করোনার সময় এই প্রবণতা আারও বেড়েছে৷
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) বলছে, কোভিড অতিমারির সময় বাংলাদেশে পরিচালিত কয়েকটি গবেষণায় ৪৬ শতাংশের মধ্যে বিষন্নতা, ৩৩ শতাংশের মধ্যে দুশ্চিন্তার লক্ষণ পাওয়া গেছে৷
সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নেহাল করিম মনে করেন আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্য মানুষকে হতাশায় ফেলে দিচ্ছে৷ আর এই হতাশা থেকে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে৷ এটা শুধু বাংলাদেশে নয় সারাবিশ্বের চিত্র৷ এর বাইরে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণেও মানুষ আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হচ্ছে৷ নিজেকে যখন কেউ অপ্রয়োজনীয় মনে করেন, জীবন অর্থহীন মনে করেন তখেই আত্মঘাতী হয়৷
সমাজে মানুষের সংকট বেড়েছে৷ বিচ্ছিন্নতা বেড়েছে৷জীবন নিয়ে সংশয় বেড়েছে৷ বেড়েছে দারিদ্র, হতাশা, শূন্যতা৷বেড়েছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এটা দূর করার কার্যকর ব্যবস্থা পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্র যেভাবে নেওয়ার দরকার তা নেওয়া হচ্ছে না৷ যার ফল আত্মহত্যা বেড়েই চলছে ৷ পরিবার রাষ্ট্র ও সমাজকে দায়িত্ব নিতে হবে৷ দেশে মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিতে হবে৷ কাউন্সেলিং-এর সুবিধা বাড়াতে হবে৷ সমাজ থেকে বৈষম্য দূর করতে হবে৷’’
হতাশাসহ নানাবিধ কারণে মানুষের মধ্যে রয়েছে দারিদ্র্য, সম্মানহানি, সংসারের টানাপোড়েন, বেকারত্ব, মাদকাসক্তি, পারিবারিক কলহ, প্রেম, বিয়ে বিচ্ছেদ, একাকিত্ব। তবে এসব কারণ ছাড়াও বন্ধু, আত্মীয়, পরিবারের সদস্যদের অবিবেচকের মত ব্যবহার, পরিবারের প্রত্যাশা মেটাতে না পারার হতাশা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষের অর্জনের খবরের সাথে নিজেদের অর্জনের তুলনা করার কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিষণ্ণতা ও হতাশার হার বাড়ছে – যেই বিষণ্ণতা ও হতাশা এক সময় তাদের আত্মহত্যাপ্রবণ করে তুলে।
গত বছর বাংলাদেশে ১০১ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে৷ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থীদের হার বেশি। তরুণদের সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন-এর জরিপ থেকে এই তথ্য পাওয়া যায় ৷ করোনার সময় তরুণদের মধ্যে বিচ্ছন্নতা বেড়েছে৷ ক্যারিয়ার নিয়ে অনিশ্চয়তা বেড়েছে৷ আর পরিবারগুলো যারা আর্থিক চাপে পড়েছে তাদের চাপ পড়েছে পরিবারের তরুণ সদস্যদের ওপর৷ একাকিত্বে প্রযুক্তির অপব্যবহার তাদের চরম হতাশার মধ্যে ফেলেছে৷ যার নির্মম পরিণতি আত্মহনন ৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কউন্সেলিং ব্যবস্থা বাড়াতে হবে৷ আর তাদের হতাশার জায়গাগুলো দূর করে তাদের সাহসী এবং আত্মবিশ্বাসী করতে হবে৷ তাদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য বা অবহেলা করা যাবে না৷ আামাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এখনো সেকেলে পরিক্ষার খাতায় নম্বর র্নিভর। প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা সর্বস্তরে শিক্ষকদের মানষিক পরির্তন আাসেনি । ধমক তুচ্ছ-তাচ্ছিল্ল অবহেলা করে কথা বলার অভ্যাস ছাড়তে পারেননি। দুই একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল দুই একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাউন্সিলিং-এর ব্যবস্থা নাই।অথচ প্রতিটি স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাউন্সিলিং-এর ব্যবস্থা রাখা খুবই গুরত্বর্পূণ।
“আমাদের সমাজের একটা ধারা আছে – কম প্রশংসা করা এবং বেশি দোষ খোঁজার চেষ্টা করা। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই এই ধারা প্রচলিত রয়েছে।” আর সোশ্যাল মিডিয়া ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নতির ফলে মানুষজন আগের চেয়ে অনেক বেশি ‘সেলফ স্ক্রিনিং’ বা আত্ম-পর্যালোচনা করার কারণে মানুষের মধ্যে বিষণ্ণতার মাত্রা বাড়ছে। জরিপেও উঠে আসে যে, যারা দিনে তিন থেকে সাত ঘণ্টা ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকেন তাদের ৮৮ ভাগই বিষণ্ণতায় আক্রান্ত।
মানুষ আত্মহত্যার আগে বুঝে না তার চলে যাওয়ার পর তার পরিবার-পরিজন বা সহকর্মীদের সামাজিক অবস্থা।কি দুর্বিষহ জীবননিয়ে তাঁদেরকে বাঁচতে হয়।
সব ধর্মেই আত্মহত্যাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে৷ ধর্মমতে আত্মহনন করা মহাপাপ৷ সামাজিক দিক আত্মহত্যা অত্যন্ত ঘৃনীত এবং দণ্ডনীয় অপরাধ আইনও আত্মহত্যাকে নিরুৎসাহিত করে৷ আত্মহত্যায় সহায়তা বা প্ররোচিত করা বাংলাদেশের আইনেও শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷ দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ৩০৬ ধারা অনুযায়ী, কোনো প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষকে আত্মহত্যায় সহায়তা করা ব্যাক্তির ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং জরিমানা হতে পারে৷