ভারতে এনআরসি বিল পাস: বিক্ষোভে উত্তাল আসাম

0
863

সাত ঘণ্টার তীব্র বিতর্কের মুখে গতকাল সোমবার মধ্যরাতে ভারতের লোকসভায় পাস করা হয় বহুল আলোচিত-সমালোচিত নাগরিকত্ব বিল। কংগ্রেসহ বিরোধী দলগুলোর তীব্র সমালোচনা উপেক্ষা করে এদিন বিলটি পাস করে ক্ষমতাসীন মোদি সরকার।

বিলটি পাসের একদিন পরই মঙ্গলবার পশ্চিবঙ্গসহ ভারতের আসামে আন্দোলনের ডাক দিয়েছে বিরোধীরা।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর দেয়া তথ্যানুযায়ী, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের প্রতিবাদে তোলপাড় দেশটির আসাম প্রদেশ। বিক্ষোভ উত্তরপূর্বের অন্যান্য রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ ইতিমধ্যেই মঙ্গলবার বিলটি পাসের বিরুদ্ধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ডাক দিয়েছে নর্থ ইস্ট স্টুডেন্টস অরগানাইজেশন-এনইএসও।

উত্তেজনার কথা মাথায় রেখে আসামের লখিমপুর ও সোনিতপুর জেলায় জারি করা হয়েছে ১৪৪ ধারা। খোলা হয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ হেল্পলাইন।

এর আগে সোমবার রাতে লোকসভায় পাস হয় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল। রাজ্যসভায় বিলটি পাস হয়ে গেলে আফগানিস্থান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে আসা সে দেশের সংখ্যালঘুরা এদেশে ৫ বছর থাকলেই নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন। এনিয়েই প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছে উত্তরপূর্বের রাজ্যগুলো।

মঙ্গলবার আসামের ডিব্রুগড়, জোড়হাটে বিক্ষোভ দেখাতে রাস্তায় নেমেছে মানুষজন। সকাল থেকেই জোরহাট, বঙ্গাইগাঁওয়ে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে প্রতিবাদ করছেন করতে দেখা গেছে। উত্তেজনার কথা মাথায় রেখে বাতিল করা হয়েছে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা।

নর্থ ইস্ট স্টুডেন্টস ওরগানাইজেশনের ডাকা আন্দোলনের আজ গুয়াহাটির বহু জায়গায় দোকানপাট বন্ধ রাখা হয়েছে। রাস্তায় মানুষজনের দেখা নেই। উত্তরপূর্বের রাজ্যের আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছে এসএফআই, ডিওয়াইএফআইসহ একাধিক বাম ছাত্র সংগঠন।

বিলটি পাসের আগেই সোমবার আসামে বন্ধের ডাক দিয়েছিল অল কোচ রাজবংশী স্টুডেন্টস ইউনিয়ন, অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন। আজও সেখান আন্দোলন অব্যহত আছে।

এদিকে, ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ যখন লোকসভায় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল বাস্তবায়নের চিন্তা করছেন, ঠিক সেই সময় এনআরসির বিরুদ্ধে আবারও সরব হলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

খড়্গপুরের সভা থেকে এনআরসির বিরুদ্ধে জোট বাঁধার আহ্বান জানালেন তিনি। রেলশহরে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষকে ‘ভারতমাতার সন্তান’ বলে উল্লেখ করে আহ্বান জানালেন, ‘আসুন জোট বাঁধি। এক জনকেও দেশ থেকে তাড়ানো চলবে না। নো এনআরসি, নো ডিভাইড অ্যান্ড রুল। মনে রাখবেন, দেশের থেকে বড় কিছুই নয়।’

এ দিন মমতা খড়্গপুরে এসেছিলেন বিধানসভা উপনির্বাচনে জয়ের পরে শহরবাসীকে ধন্যবাদ জানাতে। রাবণপোড়া ময়দানে ছিল প্রশাসনিক পরিষেবা প্রদানের জনসভার আয়োজন। শহরবাসীকে ধন্যবাদ জানানোর পর আগাগোড়া মমতার বক্তব্য জুড়ে ছিল জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) ও নাগরিকত্ব বিল (সিএবি)-এর বিরোধিতা।

মমতা বলেন, ‘সিএবি আর এনআরসি কয়েনের এপিঠ-ওপিঠ। আমরা সবাই নাগরিক, ভোট দিই, সবার রেশন কার্ড রয়েছে। কারও স্কুল শংসাপত্র, কাজ করার শংসাপত্র, জমির পাট্টা কিছু না কিছু রয়েছে। এরপরে নাগরিকত্ব নিয়ে কী প্রশ্ন রয়েছে!’

নাগরিকত্ব বিলের প্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বলেন, ‘ভয় পাবেন না। ফেট্টি পড়ে যারা এসে বলবে দেশকে ভাগ করতে, তাদের বলুন, বাংলার সংস্কৃতি ফেট্টিবাজদের জায়গা নয়। আমরা থাকাকালীন কারও ক্ষমতা নেই, আপনাদের ওপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দেবে।’

কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে নিশানা করে মুখ্যমন্ত্রী আরও যোগ করেন, ‘আমরা ৭০ বছর, ১০০ বছর ধরে এখানে রয়েছি। দেশের স্বাধীনতার সময় থেকে রয়েছি। আজ আপনারা ঠিক করবেন কে নাগরিকত্ব পাবে, কে পাবে না!’

নাগরিকত্ব বিল ও জনগণনা যে এক নয়, তা-ও বুঝিয়ে বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তার আবেদন, ‘১০ বছর অন্তর যে সমীক্ষা হয়, তাতে নামটা লিখিয়ে নেবেন। আর রেশন কার্ডের একটি কপি দিয়ে দেবেন।’

প্রসঙ্গত, ভারতের ১৭ তম লোকসভার নির্বাচনে জয়ের পরপরই বেশকিছু উদ্যোগ নেয় মোদি সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা তুলে দেয়া, বাবরি মসজিদের জায়গায় মন্দির নির্মাণের অনুমতিসহ সমালোচনার পাহাড় অতিক্রম করে এবার নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাস করা হল।

সোমবার মধ্যরাতে লোকসভায় পাস হওয়া নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জানিয়ে দেন, ‘১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ করেছিল কংগ্রেস। এই কারণেই এখন এই বিল আনতে হয়েছে। দেশভাগের ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিভাজনকে প্রশ্রয় দিয়েছে কংগ্রেস, এমনটাই মত পদ্ম শিবিরের ‘চাণক্যর’।’

লোকসভায় প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের সমালোচনার বিরোধিতা করে অমিত শাহ বলেন, ‘আমাদের কেন এই বিল নিয়ে আসতে হল? স্বাধীনতার সময় যদি ধর্মের ভিত্তিতে দেশকে ভাগ করা না হত, তাহলে এই বিলের আজ কোনো প্রয়োজন থাকত না।’

সাত ঘণ্টা ধরে বিল নিয়ে আলোচনার পর যখন ভোটাভুটি হয় তখন ঘড়ির কাঁটা মধ্যরাত পেরিয়েছে। শেষপর্যন্ত বিলের পক্ষে ভোট দেন ৩১১ জন, আর বিপক্ষে ছিলেন ৮০ জন।

বিল পাশের আগে এআইএমআইএম-এর আসাউদ্দিন ওয়াইসির অভিযোগের প্রেক্ষিতে শাহ বলেন, ‘আমাদের নাগরিকপঞ্জির জন্য মঞ্চ প্রস্তুতির কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা দেশজুড়েই এনআরসি করব। একটিও অনুপ্রবেশকারীদের সেখানে রেহাই দেওয়া হবে না।”

বিলের সপক্ষে যুক্তি সাজিয়ে দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এই প্রস্তাবিত আইনের একমাত্র উদ্দেশ্য হল আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসীদের চিহ্নিত করা এবং যারা ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে ভারতে পালিয়ে এসে ‘ভয়ঙ্কর’ জীবনযাপন করেছেন, তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া। এমনাকি এই বিল ‘অসাংবিধানিক’ কিংবা ‘সংবিধান বিরোধী’ নয় বলেও দাবি করেছেন বিজেপি সভাপতি। ১১৯ ঘণ্টা ধরে ১৪০ জন প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, লোকসভাতে এমন কথাই জোর গলাতেই বলেন অমিত শাহ।

তবে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে ‘চিন্তিত’ মুসলিমদের আশ্বাস দিয়ে অমিত শাহ জানান, এই আইনের ফলে মুসলিমদের কোনো ভয়ের কারণ নেই। তিনি বলেন, মুসলমানদের একত্রিত করে বিলের বিপক্ষে সুর চড়ানো হচ্ছে, কিন্তু পড়শি তিন দেশ থেকে যদি কোনো ‘স্বজন’ মুসলিম নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেন তবে অবশ্যই তা বিবেচনা করা হবে। তবে, রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ উল্লেখ করে শাহ বলেন, বাংলাদেশ থেকে আগত এই সম্প্রদায়কে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না।

নাগরিকত্ব বিল নিয়ে কংগ্রেসকে আক্রমণ শাণিয়ে শাহ বলেন, ‘গোটা বিলের নেপথ্যে রয়েছে মোহম্মদ আলি জিন্নার তত্ত্ব মেনে নিয়ে কংগ্রেসের দেশভাগকে সমর্থনের রাজনীতি। ১৯৫০ সালে ভারত ও পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের রক্ষার জন্য নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। তারা কিন্তু ভারতে সুরক্ষিতই ছিলেন, কিন্তু পাকিস্তানে তারা নির্যাতিত হয়েছিলেন। আপনারা কি বলতে চান, পাকিস্তানে বা বাংলাদেশে মুসলিমদের উপরে অত্যাচার হবে? এটা হতে পারে না।’

তিনি বলেন, শরণার্থী এবং অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য আছে। এই বিলটি শরণার্থীদের জন্য। ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি না করে চোখ, কান খুলুন। লাখ লাখ, কোটি কোটি মানুষ ভয়ঙ্কর জীবনযাপন করছেন, মৌলিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাদের সোনালি সূর্যের ভোর উপহার দেবেন বলেও মন্তব্য করেন ভারতের এ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ।