বৈসু উৎসব: ত্রিপুরা জাতির একটি সংক্ষিপ্ত নকশা

0
1544

বৈসু উৎসব: ত্রিপুরা জাতির একটি সংক্ষিপ্ত নকশা

পপেন ত্রিপুরা:

ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর প্রধান সামাজিক উৎসব হলো বৈসু। প্রতি বছর জুম আবাদ শুরুর আগে ত্রিপুরারা এ উৎসব উদযাপন করে থাকে। এ উৎসব অনেকটা জুুম আবাদ কেন্দ্রিক। যেহেতু বৈশাখ মাস থেকে পুরোদমে জুম আবাদের কাজ শুরু হয়, তাই বিরতিহীন জুম কাজে হাত দেয়ার আগে ত্রিপুরারা বৈসু উৎসব উদযাপন করে থাকে। ত্রিপুরা জাতির বৈসু উৎসব প্রধানত তিনদিন। পুরনো বছরের শেষ দুইদিন ও নতুন বছরের প্রথম দিন।  ১. হারি/হার বৈসু ২. বৈসুমা ও ৩. আতাদাক। সাধারণত চৈত্রের ৩০, ৩১ ও বৈশাখের ১লা(এপ্রিলের ১৩, ১৪ ও ১৫) তারিখ এই তিন দিন বৈসু উৎসব উদযাপিত হয়। তবে, বাংলাদেশের প্রণীত বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী দিনটি হওয়ার কথা ১২, ১৩ ও ১৪ এপ্রিল। কিন্তু ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী এখনো পূর্বের অবিভক্ত বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ীই বৈসু উৎসব উদযাপন করে থাকে। তাই চাকমাদের বিজু উৎসবের সাথে ত্রিপুরাদের বৈসু উৎসব একদিনের ব্যবধান। চাকমারা বাংলাদেশের বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী আর ত্রিপুরারা অবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশের বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে সব ধরণের উৎসব, পুজা, পার্বন উদযাপন ও পালন করে থাকে।

হারি বৈসু:বৈসু উৎসবের প্রথম দিনকে হারি বৈসু বলা হয়। এ দিনে, ফুল দিয়ে ঘর-বাড়ি সাজানোর দিন। হারি বৈসুর আগের রাত গ্রামের ত্রিপুরা কাশোর কিশোরীরা ফুল তোলার জন্য সারারাত জেগে থাকতো। টর্চ লাইট, হারিকেন নিয়ে পাড়ার এ মাথা থেকে ওই মাথা ছুটোছুটি করে মাতিয়ে রাখতো তারা। ভোরে ফুলগুলো ফুটতে শুরু করার সাথে সাথে কিশোর কিশোরীরাও ফুল তোলা শুরু করে দেয়। সারারাত ফুল তোলে সকালে ফুলের মারা গেঁথে বাড়ির প্রতিটি দরজায় ফুলের মালা দিয়ে সাজানো হয়। নিমফুল, বেত(রাইচৌক) পাতা, খুমচাক(নাগেশ^র), খুমতাই, চুয়ানথি, খুম রিংকুসহ নানান ধরণের ফুল দিয়ে ঘর সাজিয়ে ঘরগুলোকে সুবাসিত করে তোলা হয়। ঘরের গৃহপালিত প্রাণি গরু-ছাগলকে ফুলের মালা পরানো হয়।

গঙ্গাস্নান ও গঙ্গাপুজা: ঘর-বাড়ি সাজানোর পর কিশোর কিশোরীরা দলবেঁধে ছড়া নদীতে গোসল করে ফুল দিয়ে তৈবোংমা(গঙ্গা)করে বাড়িতে ফিরে মাইলোংমা(ল²ী) আসনে ফুল-ধূপবাতি দিয়ে পুজা সম্পন্ন করে থাকে। বিশেষ করে বাড়ির মায়েরাই ফুল দিয়ে গঙ্গা পুজা করে থাকে। গ্রামীণ ত্রিপুরা নারীরা সারা বছর প্রতি বৃহস্পতিবার ফুল দিয়ে তৈবোংমা(গঙ্গা)ও বাড়িতে মাইলোংমা(ল²ী) আসনে মাইলোংমা(ল²ী) করে থাকে। বৈসু উৎসবের দিনগুলোতে নারী-পুরুষ, কিশোর-কিশোরী সবাই যার যার ইচ্ছানুযায়ী ফুল দিয়ে তৈবোংমা(গঙ্গা)পুজা করে থাকে। কোনো বাধ্যবাধ্যকতা বা নিষেধাজ্ঞা নেই। সাধারণত ত্রিপুরা নারীরাই এ কাজটি করে থাকে। পুরুষরা সম্পন্ন করে থাকে ’কুচাই’ পানি।

কুচাই পানি(শুদ্ধিকরণ জল): উপাদান: এক-দেড় ফুট লম্বা একটি বাঁশের চোঙা, চোঙার জন্য একটি বাঁশের ব্রাশ, সুকৈ, কুচাই, সিলিক(কাঁচা হলুদ)। সুকৈ(ঘিলা), কুচাই(), সিলিক(কাঁচা হলুদ) এই তিন প্রকারকে একসাথে বেটে একটি এক ফুট সাইজের বাঁশের চোঙায় ভরানো হয়। তারপর তিনটি বা পাঁচটি বা সাতটি বাড়িতে গিয়ে তাদের কাছে পানি চেয়ে নিয়ে সেই পানি ঘরের চালের উপর ছিঁটিয়ে দিয়ে গড়িয়ে পড়লে সেই পানি বাঁশের চোঙায় ভরতে হবে। এভাবে একে একে তিন বা পাঁচ বা সাতটি বাড়ি থেকে চোঙায় পানি ভরতে হবে। ছড়ায়(নদী) গিয়ে চোঙায় ছড়ার পানিও যোগ করে কুচাই পানি তৈরি করতে হবে।

এ পানি দিয়ে বাড়ির সকল সদস্যদের ছিটিয়ে দেয়া হয়। তারপর ফলমূল গাছেও ছিটানো হয় এ পানি। এ রিচ্যুয়াল( করণ)টি করে থাকে ত্রিপুরা পুরুষরা। আর নারীরা করে ফুল দিয়ে গঙ্গা পূজা। বৈসু উৎসবে তিনদিন নদীর ¯œানাঘাটের উজানপাড় ফুলেল হয়ে উঠে। এবং সন্ধায় ¯œানাঘাটে চেরাক জ¦ালানো হয়।

ত্রিপুরাদের বিশ্বাস, এ পানি ছিটালে পুরনো বছরের গঙ্গা পানি, অশুভ শক্তি দূর হয়, বন্ধ্যা ফল গাছে ফল ধরবে। বৈসুতে নারী-পুরুষের এ করণগুলো তিনদিনব্যাপী হয়ে থাকে।

ধান ছিটানো ও প্রণাম উৎসব: শিশু-কিশোররা গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে প্রত্যেকের বাড়ির উঠানে ধান ছিটিয়ে দেয়, বাড়ির বয়স্কদের প্রণাম করে। ধান ছিটানোর উদ্দেশ্য হলো, এই বসুন্ধরা যেন অকৃপণতায় শস্যে ভরপুর হয়ে উঠে। ছিটানো ধানগুলো হাঁস-মুরগিগুলো অবাধে খেতে পারে।

অন্যান্য: হারি বৈসুর দিনেই গাছের ফলমূল ছিঁড়ে রাখতে হবে। কারণ বৈসুমার দিনে গাছ থেকে কোনো ফলমূল ছিঁড়া নিষিদ্ধ রয়েছে। গন্দ(পাঁচন/লাব্রা) রান্নার জন্য গাছের কাঁঠাল, পেঁপেসহ বিভিন্ন ধরণের শাক-সবজি এ দিনেই ছিঁড়ে বাড়িতে তুলে রাখা হয়। হারি বৈসুর রাতটা অনেকের নির্ঘুম থাকে। গন্দ রান্নার জন্য শাক-সবজি কুটা, পিঠা বানানো ইত্যাদি কাজ করতে করতে গভীর রাত পার হয়ে যায়। কারণ সকাল হলেই রান্না করে আপ্যায়ণ করতে হবে।

বৈসুমা:  উৎসবের দ্বিতীয় দিন বৈসুমা। বৈসুমাকে উৎসবের মূল পর্ব বলা হয়ে থাকে। এ দিনেই পানাহারের উৎসব চলে। এ দিনেও কিশোর-কিশোরীরা ফুল তুলে এবং ঘর সাজায়। রীতিমতো এ দিনেও ¯œান, গঙ্গাপুজা, কুচাই পানি, প্রণাম, ধান ছিটানো উৎসব চলতে থাকে। তারপর শিশু-কিশোররা দলবেঁধে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি ছুটে ছুটে পিঠা-পায়েস খেয়ে ফূর্তি করতে থাকে।

মাইমি(বিন্নি), আওয়ান(পিঠা), মাইসি(কাকন চালের পায়েস), মাইকতৈ(পায়েস), গন্দ(পাঁচন/লাব্রা), সেমাই, কলা, মুড়ি, বিস্কুট, চকলেট, তরমুজ,  নানান ধরণের কোল্ড ড্রিংকস, কয়েক প্রকার মদ ইত্যাদি যে যার সামর্থ অনুযায়ী আয়োজন করে থাকে। শিশু-কিশোররা আকৃষ্ট থাকে পিঠা-পায়েসের প্রতি আর বড়োরা দলে দলে মদ পান করে। তবে, বৈসুমার দিনে কোনো ধরণের আমিষ খাবারের আয়োজন করা থাকে না। সন্ধার দিকে, নারীরাও দলবেঁধে বের হয়। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি ঘুরে ঘুরে পিঠা-পায়েস, মদ গ্রহণ করতে থাকে। মদের মধ্যে নারীদের প্রিয় মদ ইঃিশি (জগরা)। জগরা বানানো হয় বিন্নি চালের ভাত দিয়ে। সারাদিন বিভিন্ন গ্রাম থেকে গরয়া দেবের খেরাবই দল, নামকীর্তন দল আসতে থাকে। তাদের নাচ-গান পরিবেশনে সারাদিন মুখরিত থাকে বৈসু উৎসব। এদিন সারাদিন এবং মধ্যরাত পর্যন্ত পানাহারের উৎসব চলতে থাকে।

রিচ্যুয়াল: যার জন্মবারে বৈসুমার দিন হয় তার নিজ বাড়িতে ভাত খাওয়া মানা রয়েছে। খেলে তার অসুখ-বিসুখ হয়ে থাকে বলে ত্রিপুরাদের বিশ্বাস। এই বিশ্বাসে বা কেবল প্রথাগত হিসেব করে রিচ্যুয়ালটি এখনো পালন করে থাকে। যার জন্মবার তাকে ওইদিন প্রতিবেশী কারোর বাড়িতে ভাত খেতে হবে। অথবা বাড়ির বারান্দা থেকে উঠানে একবার একবার করে তিনবার বা পাঁচবার বা সাতবার লাফ দিয়ে উঠানামা করতে হবে। অর্থাৎ একবার লাফ দিয়ে নামার পর আবার উঠে এসে ফের লাফ দিয়ে নামতে হবে।

আতাদাক: বৈসু উৎসবে তৃতীয় এবং শেষ দিনটিকে বলা হয় আতা দাক। দিনটি হলো নববর্ষের প্রথম দিন। তাই এ দিনটিকে বিসিকাতালও বলা হয়ে থাকে। এদিনেও আগের দুইদিনের মতো অন্যান্য রিচ্যুয়াল যেমন- গঙ্গাপুজা, কুচাই পানি, ধান ছিটানো করা হয়ে থাকে। এ দিনে বাড়ির মাতা-পিতা, দাদা-দাদীদের নদী থেকে জল তুলে এনে  ¯œান করানো হয়। নতুন কাপড় দান করা হয়। এদিন ত্রিপুরাদের প্রতিটি বাড়িতে পিঠা-পায়েস ছাড়াও মাছ-মাংসের আয়োজন চলে। এদিনেও নারী-পুরুষের  মদপানের উৎসব চলে। বিশেষ করে এই দিনেই বড়োদের পানাহারের উৎসব চলে।

গরিয়া/গরয়া: ত্রিপুরাদের বৈসু উৎসবের প্রধান আকর্ষণ হলো তাঁদের প্রধান দেবতা গরিয়া দেবের খেরাবই নৃত্য। গরিয়া পূজায় যাঁরা নাচে তাঁদেরকে বলা হয় খেরাবই। গরিয়া দেবের প্রতিমূর্তিকে বহন করে এক পাড়া থেকে আরেক পাড়ায় নৃত্য পরিবেশন করে খেরবাই দল। দেখানো নয় ত্রিপুরাদের জীবন-জীবিকার উপর খেলা ও অভিনয়।

ভারত ও বাংলাদেশের ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর লোকেরা চৈত্রের ৩০, ৩১ ও বৈশাখের ১ তারিখে হারি বৈসু, বৈসুমা ও বিসিকাতাল উদযাপন করে থাকে বলে অনেকেরই ধারণা ত্রিপুরারা বঙ্গাব্দ বর্ষকে ঘিরে উৎসব উদযাপন করে থাকে। কিন্তু এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল বলে দাবি করেন, বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক মূখ্য প্রযোজক ও বাংলা একাডেমি পদকপ্রাপ্ত লেখক ও গবেষক প্রভাংশ্ ত্রিপুরা। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বঙ্গাব্দ থেকে ত্রিপুরাব্দ তিন বছরের বড়। ত্রিপুরাব্দই আগে শুরু হয়েছিল। মূলত ত্রিপুরাব্দকে অনুসরণ করেই বঙ্গাব্দও পহেলা বৈশাখে নববর্ষ শুরু করেছিল।

ত্রিপুরাব্দের সংক্ষিপ্ত সাক্ষ্য: জানা যায়, স্বাধীন ত্রিপুরা মহারাজা হামতরফা ৫৯০ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরাব্দ বা ’তিপ্রা বিসি কাতাল’ প্রচলন করেন। তখন খ্রিস্টাব্দের বাস্তবিক বয়স ছিল মাত্র ৯০ বছর। এবং ভারতে তার অস্তিত্বও ছিল না। শকাব্দের বয়স তখন ৫১২ বছর এবং ভারতের সর্বাধিক প্রচলিত অব্দ ছিল। শকাব্দের পরবর্তী বিভিন্ন অব্দের ন্যায় ত্রিপুরাব্দও শকাব্দের মাসকেই অনুসরণ করতো। ত্রিপুরাব্দের মাসের সাথে শকাব্দের মাসের যে সামঞ্জস্য ছিল তার প্রমাণ ত্রিপুরা রাজাদের সনন্দ বা তা¤্র শাসনে পাওয়া যায়।

২০০৮ সালে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা থেকে প্রকাশিত ’ট্রুথ এ্যাবাউট ত্রিং’ থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এ চটি বইয়ে প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী, বঙ্গাব্দ প্রচলনের তিন বছর আগে ত্রিপুরাব্দ প্রচলন হয়েছিল। অর্থাৎ ত্রিপুরাব্দকে অনুসরণ করেই বঙ্গাব্দ প্রচলন করা হয়েছিল।

ত্রিপুরাব্দ বর্ষের মাস ও বারের নাম কেন বাংলায় রাখা হলো? এ ব্যাপারে, লেখক ও গবেষক প্রভাংশু ত্রিপুরা বলেন, ’স্বাধীন ত্রিপুরা মহারাজারা বাংলা সাহিত্যেও অনুরাগী ছিলেন এবং সেসময় ককবরক(ত্রিপুরা ভাষা) লিখিত রূপের চর্চা ছিল না, এ কারণে শকাব্দের বার ও মাসকেই অনুসরণ করা হয়েছিল।’

বর্তমানে ত্রিপুরাদের কিছু সংগঠন ত্রিপুরাব্দ ক্যালেন্ডার নামে মাঝেমাঝে যে ক্যালেন্ডার প্রকাশ করে থাকে এটা সর্বজন স্বীকৃত নয় বলেও অভিমত প্রকাশ করেন প্রভাংশু ত্রিপুরা। তাঁর দাবি, এটা ত্রিপুরা রাজ্যের একটি রাজনৈতিক সংগঠনের প্রচলন করা ক্যালেন্ডার। এই বিতর্কিত ক্যালেন্ডারটি খ্রিস্ট ধর্মের কিছু উপলক্ষ্যকে কেন্দ্র করেই করা হয়েছিল বলেও তাঁর দাবি।

ভারতের গবেষক  ড. অতুল দেববর্মার প্রস্তাবিত ককবরকে বার, মাস, ঋতুর নাম ব্যবহার করে ত্রিপুরাব্দ বর্ষ পঞ্জিকা প্রচলন করতে বাংলাদেশে বসবাসরত ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীদের প্রতি আহবান জানান।

পপেন ত্রিপুরা: মুক্ত গণমাধ্যম কর্মী ও নির্বাহী সম্পাদক, সান্তুআ জার্নাল।

e-mail: papencht1979@gmail.com