অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্যমতে এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে যেসব দেশ সাজা হিসেবে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড দিয়ে থাকে বাংলাদেশ তার একটি। বাংলাদেশে বড় কোন অপরাধ সংগঠিত হলেই মৃত্যুদণ্ডের দাবি ওঠে।
জানুয়ারী ২০২০ শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রীকে ধর্ষণের প্রতিবাদে ক্যাম্পাসে ব্যপক বিক্ষোভ হয়েছে। ওই বিক্ষোভে ব্যাপকভাবে শোনো গেছে ধর্ষনের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে স্লোগান। সড়কে আঁকা হয়েছিলো ফাঁসির দড়ির চিত্র। এই দাবি নিয়ে প্ল্যাকার্ড হাতে দাড়িয়েছিলেন অনেক শিক্ষার্থী।
বাংলাদেশে চাঞ্চল্যকর অথবা নৃশংস কোন হত্যাকাণ্ড ছাড়াও ধর্ম অবমাননাকারী থেকে শুরু করে, ধর্ষণ, খাদ্যে ভেজালকারী, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু এরকম বিভিন্ন ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড দাবি করতে দেখা যায়।
অথচ বিশ্বের বহু দেশে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড রহিত করা হচ্ছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্যমতে বিশ্বের ১০৬টি দেশ মৃত্যুদণ্ড রহিত করেছে। এছাড়া আশিটিরও বেশি দেশ রয়েছে যেখানে মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকলেও তার ব্যবহার নেই।
একজন বলছেন, “আমার নিজের অথবা আমার পরিবারের কারোর উপর যদি মারাত্মক কোন অপরাধ হয় তাহলে আমি বলবো যে ওই অপরাধীর পৃথিবীতে থাকার কোন অধিকার নেই। যাতে এই অপরাধ সে আবার করতে না পারে।”
ঢাকার আরেক বাসিন্দা মনে করেন, “একটা দেশে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড থাকা উচিত কারণ যখনই লোকে দেখবে যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, তখন একটা ভুল কাজ করার আগে সে অবশ্যই চিন্তা করবে।”
অ্যামনেস্টির তথ্যমতে ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ২৩০ জনের মতো ব্যক্তিকে সাজা হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। পূর্ববর্তী মামলায় দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত অপরাধীসহ সব মিলিয়ে ওই বছর দেশে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মোট আসামির সংখ্যা ছিল ১,৫০০-এর বেশি।
এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে যেসব দেশ সাজা হিসেবে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড দিয়ে থাকে বাংলাদেশ তার একটি।
বিচারহীনতার সংস্কৃতি: নৃবিজ্ঞানী জোবায়দা নাসরিন বলছেন, “বাংলাদেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি রয়েছে। দেখা যাচ্ছে আন্দোলন বা বড় ধরনের আওয়াজ না উঠলে বিচার প্রক্রিয়া খুব ধীর গতিতে চলে। সেটা গ্রেফতার থেকে শুরু করে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা পর্যন্ত।” তার মতে, “বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের অনাস্থা তাকে প্রতিশোধ পরায়ণ করে তুলেছে। সর্বোচ্চ শাস্তির মাধ্যমে মানুষ তাড়াতাড়ি প্রতিকার চায়।”
বাংলাদেশে বেশ কটি গণ-আন্দোলনের সময় মানুষজনের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে ব্যাপক সমর্থনের চিত্র ফুটে উঠেছে। যার একটি বড় উদাহরণ ছিল শাহবাগ আন্দোলন। তখন নিজের শিশুর হাতে ফাঁসির দাবির প্ল্যাকার্ড তুলে দিয়ে শাহবাগে গেছেন মানুষজন, ফাঁসির দড়িও নিয়ে এসেছিলেন অনেকে।
ধর্ষণের জন্যে মৃত্যুদণ্ডের দাবি গত কয়েক বছর ধরে বেশ সমর্থন পাচ্ছে। এমনকি প্রকাশ্য জনসম্মুখে তা কার্যকর করার কথাও বলেন অনেকে। জোবাইদা নাসরিন মনে করেন, অনেক সময় সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে এই দাবি তোলা হয়। তিনি বলছেন, “যত বেশি চাপ তৈরি হয় বিচার প্রক্রিয়া তত দ্রুত এগোয়। মানুষ মৃত্যুদণ্ড চায় এবং মনে করে তা সরকারের উপর চাপ তৈরি করছে। তারা মনে করে সরকার চাপের কারণে ঘটনার বিচার করার ব্যাপারে আরও কমিটেড হবে। সেকারণে প্রতিবাদগুলোতে মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে আওয়াজ ওঠে।”
মৃত্যুদণ্ড কী অপরাধ কমাতে সাহায্য করে? : মাত্র কয়েক দিন আগে শিশু ধর্ষনের অপরাধে করা মামলায় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার ব্যাপারে নির্দেশনা চেয়ে একটি রিট আবেদন করা হয়েছিলো, যার প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট একটি রুল জারি করেছে। সেই রুলে বলা হয়েছে ১৬ বছরের নিচে কেউ ধর্ষণের শিকার হলে ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কেন দেওয়া হবে না?
ধর্ষণের ঘটনায় কারও মৃত্যু হলে আইনে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি যাবজ্জীবন সাজার যে বিধান রয়েছে তা বাদ দেয়ার ব্যাপারে সরকারের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ হবে না- রুলে তাও জানতে চেয়েছে আদালত।
সাধারণত অপরাধীর মনে ভীতি জাগিয়ে তোলার কায়দা হিসেবে অনেক দেশে মৃত্যুদণ্ড প্রতিষ্ঠিত একটি শাস্তি। সৌদি আরব, ইয়েমেনসহ কিছু আরব দেশ ও ইরানে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। কিন্তু সাজা হিসেবে মৃত্যুদণ্ড কি একটি সমাজে অপরাধ কমাতে সাহায্য করে?
অপরাধবিজ্ঞানী খন্দকার ফারজানা রহমান বলছেন, “এই বিষয়ে যত অ্যাকাডেমিক লিটারেচার আছে, আপনি ঘেঁটে দেখুন, রিঅফেন্ডিং রেট, শাস্তির পরও আবার অপরাধ করার যে প্রবণতা সেটা কোন দেশে কমানো যায় নি।” তিনি কানাডা, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অঙ্গরাজ্য ও ইউরোপের স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর উদাহরণ দিয়ে বলছেন, “এসব দেশে তো মৃত্যুদণ্ড নেই। কিন্তু সেখানে ক্রাইম রেট দেখুন অনেক কম।” তিনি বলছেন, “আপনি মৃত্যুদণ্ড দিয়ে অপরাধীকে নির্মূল করলেন কিন্তু অপরাধ নির্মূলের জন্য কোন ব্যবস্থা নিলেন না। সেটা যদি একটা সমাজ ব্যবস্থায় না থাকে আপনি সব অপরাধীকে ধরে মৃত্যুদণ্ড দিলেও অপরাধটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।”
“কারাগারে পাঠানো অথবা মৃত্যুদণ্ড ছাড়া অন্য কোন ধরনের সাজাকে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে আমাদের বিচার ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রযন্ত্র। সরকার ও প্রশাসনের মেন্টালিটি হল যত বেশি অপরাধীকে কারাগারে পাঠিয়ে শাস্তি দিতে পারছি বা মৃত্যুদণ্ড দিতে পারছি, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে তত বেশি সাকসেস রেট।” তার মতে, ভুলবশত একজন নিরপরাধ ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড হয়ে গেলে তার প্রাণ ফিরিয়ে দেয়ার কোন উপায় নেই। আর সাজা হিসেবেও মৃত্যুদণ্ড একটি দেশ ও তার বিচার ব্যবস্থার জন্য ব্যয়বহুল একটি ব্যবস্থা। সে ব্যাপারে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে করা একটি গবেষণার তথ্য তুলে ধরে বলছেন, “সেখানে দেখা গেছে মৃত্যুদণ্ড হয়নি এমন অপরাধীর থেকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলে চারগুণ বেশি টাকা খরচ হয়। সে মৃত্যুদণ্ড থেকে বাঁচতে বিভিন্ন ধাপে আপিল, রিভিউ, রিভিশন, দেশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সাধারণ ক্ষমার বিষয় থাকে।”
অপরাধীর শাস্তি নাকি সংশোধন?: বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ড-বিরোধী ক্যাম্পেইন করে এমন সংগঠনও খুব একটা নেই। বাংলাদেশ লিগাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্ট এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্র মাঝে মাঝে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সিনিয়র উপ-পরিচালক নীনা গোস্বামী বলছেন, ভিন্ন ধরনের শাস্তি ও অপরাধীর সংশোধনমূলক ব্যবস্থার ধারনাটি জনপ্রিয় করে তোলার কথা। তিনি বলছেন, “আমরা তো ঔপনিবেশিক আইন অনুসরণ করছি, যাতে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের কথা বলা আছে। কিন্তু কথা হচ্ছে যারা এই আইন করেছিলো, সেই ব্রিটিশরাই কিন্তু এখন সেখান থেকে সরে গেছে। মৃত্যুদণ্ড এখন আর তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি নয়।” তার মতে, “অন্যান্য রাষ্ট্র যদি মনে করতে পারে যে এটার দরকার নাই, অন্যভাবে এটার শাস্তি হতে পারে, একদিন আমরাও হয়তো ভাবতে পারি যে দেখি না অন্য রাষ্ট্রগুলো কিভাবে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বা সংশোধনমূলক নিচ্ছে।”
বাংলাদেশ কী সত্যিই একদিন এমন চিন্তা করবে?আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলছেন, মৃত্যুদণ্ড রহিত করার ব্যাপারে বাংলাদেশ আগ্রহী নয়। তিনি বলছেন, “কিছু কিছু অপরাধ আছে যার শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড আগে থেকেই ছিল এবং সেগুলো আমরা পরিবর্তন করবো না বলেই আপাতত আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” ধর্ষণের সাজা হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের যে দাবি উঠেছে সে নিয়ে কী ভাবছে সরকার?
এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলছেন, “যেখানে অপরাধ অত্যন্ত গর্হিত, সেখানে অপরাধের গুরুত্ব বুঝে, জনগণ যখন চাচ্ছে এইসব অপরাধের জন্য আবার ফাঁসি চালু করতে সেটা আমরা চিন্তাভাবনা করবো।”
“দাবি উঠেছে বলেই যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে তা নয়। আমরা যেটা দেখবো ধর্ষনের সাজা যদি বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড করা হয় তাতে অপরাধটা কমবে কিনা। এবং সেটা দেখার পরেই আমরা বিবেচনা করবো।”
BBC