বৃটেনের উন্নয়ন সংস্থা ডিএফআইডি-র অর্থায়নে এবং চায়না ডায়লগের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত দি থার্ড পোল ডট নেট রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা এবং এশিয়াজুড়ে চীনের দিগন্ত প্রসারিত করার আগ্রহের মধ্যে একটা মেলবন্ধন ঘটেছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে চীন এখন বাংলাদেশে প্রধান বিনিয়োগকারী হিসেবে আত্বপ্রকাশ করেছে।
প্রতিযোগী অনেকে মনে করেন চীনের ঋনের ফাদে বাংলাদেশ পড়তে যাচ্ছে । কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে চীন অনেককে পেছনে ঠেলে দিচ্ছে। চলতি অর্থবছরের বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং মেগা প্রকল্পগুলোতে বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে প্রায় ৬শ’ মিলিয়ন ডলার বা ৬০ কোটি ডলার গ্রহণ করেছে। একই সময়ে ভারত বিনিয়োগ করেছে চীনা বিনিয়োগের দশ ভাগের এক ভাগ ৬৫ মিলিয়ন বা সাড়ে ৬ কোটি ডলার।
পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চীন থেকে বাংলাদেশে সরাসির বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ৫০৬ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা মোট বৈদেশিক পুঁজি প্রবাহের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। বর্তমানে প্রায় ৪০০টি চীনা কোম্পানি বাংলাদেশে ব্যবসা করছে। এর মধ্যে প্রায় দু’শ’ বড় কোম্পানি এবং দু’শ’ ছোট ও মাঝারি কোম্পানি রয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ গত বছরে চীনের শেনঝেনের একটি কনসোর্টিয়াম এবং সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জের কাছে ২৫ ভাগ শেয়ার বিক্রি করে। চীনের কনসোর্টিয়ামের প্রস্তাব অন্য প্রস্তাবের চেয়ে ৫৬ শতাংশ বেশী ছিলো বলে বাংলাদেশ তা গ্রহন করে। চীনের আরেকটি বড় বিনিয়োগের জায়গা হচ্ছে জ্বালানী খাত। চীনের বিনিয়োগের প্রধান একটি ক্ষেত্র হচ্ছে জ্বালানী। কয়লা ভিত্তিক জ্বালানী খাতে চীন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে। যদিও কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র নিয়ে মানুষের যথেষ্ট আপত্তি আছে। সুন্দরবনের ভেতরে একটি বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মানের ভারতকে অনুমতি দেয়া হয়েছে। ব্যাপক বিক্ষোভের পরও ভারত এই প্রকল্প থেকে সরে দাড়ায়নি।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে চীনের ৪০৭ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ এসেছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোতে । এর মধ্যে চট্টগ্রামে ১৩শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মানে চীনের বড় বিনিয়োগের প্রকল্প আছে অন্যটি পটুয়াখালীর পায়রায়। কক্সবাজারে ১৩০০ মেগাওয়াট কয়লা প্রকল্পের জন্য চীনের সঙ্গে সম্প্রতি আরেকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ সরবরাহ বর্তমানের ২ ভাগ থেকে ৫০ ভাগের বেশিতে উন্নীত করার টার্গেট নিয়েছে। এর আওতায় ২৩ হাজার মেগাওয়াট নতুন কয়লাচালিত প্রকল্প পাইপলাইনে রয়েছে।
কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র ছাড়াও দেশের অবকাঠামো খাতে চীনের বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে। বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে চীন অপ্রতিদ্বন্দ্বী বিনিয়োগকারী দেশ। অবশ্য বাংলাদেশে অবকাঠামো খাতে চীনের বিনিয়োগ নতুন নয় বরং সর্ম্পকটি ঐতিহাসিক। আশির দশক থেকে দেশের বড় বড় অবকাঠামো নির্মানে চীন সম্পৃক্ত ছিলো। দেশের অনেক পুরানো বড় সেতু চীনের বিনিয়োগে তৈরি। চায়না ডেইলির মতে, চীন বাংলাদেশে ১০ বিলিয়ন ডলারের অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে চীনের অর্থনৈতিক ও শিল্পাঞ্চল, অষ্টম চীন-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ সেতু এবং একটি আর্ন্তজাতিক প্রদর্শনী কেন্দ্র রয়েছে। বাণিজ্যেও একই প্রবণতা লক্ষণীয়। চীন । বাংলাদেশ সবজি, হিমায়িত এবং জীবন্ত মাছ, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, টেক্সটাইল ফাইবার, কাগজের সুতা এবং বোনা কাপড়, পোশাক এবং পোশাক সামগ্রী রপ্তানি করছে। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ছিল ১২ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২১ সালের মধ্যে তা ১৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের বড় বাণিজ্যিক অংশীদার চীন এবং দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগকারী। অবকাঠামোতে চীনা বিনিয়োগের সাফল্য মূলত প্রকল্পগুলোর আর্থিক কার্যকারিতা এবং রপ্তানি আয়ের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কের উপর নির্ভর করে। পুঁজিবাজারে এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে (এসইজেড) বিনিয়োগ দীর্ঘমেয়াদি সুবিধা আনতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশে চীনের অবকাঠামো নির্মানের প্রকল্পের সাথে চীনে প্রেসিডেন্ট শি জিন পেয়ং এর বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্প রয়েছে। ২০১৩ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ ঘোষণার পর থেকে নতুন বাংলাদেশ-চীন অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। একুশ শতকের মেরিটাইম সিল্ক রোড এবং সিল্ক রোড অর্থনৈতিক বেল্ট-উভয়েরই বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। বাংলাদেশে ভারত মহাসাগর ও ইউনানসহ চীনের ভূমিবেষ্টিত প্রদেশগুলোর মধ্যে সামুদ্রিক ও স্থলপথে সংযোগের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে একটি। ২০১৬ সালের অক্টোবরে শি জিনপিংয়ের দুই দিনের বাংলাদেশ সফরকালে গতিশীলতা অর্জন করে। এই সফরকালে উভয় দেশ ভূমি ও মেরিটাইম কানেকটিভিটি, অবকাঠামো উন্নয়ন, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, পরিবহন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সহ বিভিন্ন সেক্টরে তাদের সহযোগিতা আরো বাড়াতে সম্মত হয়।
চায়না গ্লোবাল ইনভেস্টমেন্ট ট্র্যাকারের মতে, ওই সফর থেকে এ পর্যন্ত উভয় দেশ ৯ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি চুক্তি সই করেছে। এর আওতায় মোট বিনিয়োগ ২৬.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণে ৩.৩ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি গত বছর সম্পন্ন হয়েছিল। এটি উত্তর ও দক্ষিণ বাংলাদেশকে সড়ক ও রেলপথে সংযুক্ত করবে। দেশটিতে নির্মিত চ্যালেঞ্জিং প্রকৌশল প্রকল্পগুলির মধ্যে এটিই সবাইকে ছাড়িয়ে যাবে।
অন্য প্রধান প্রকল্পগুলোর মধ্যে ডিজিটাল কানেকটিভিটি উন্নত করতে ১ বিলিয়ন ডলার এবং পাওয়ার গ্রিড শক্তিশালী করতে ১.৩২ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। চায়না গ্লোবাল ইনভেস্টমেন্ট ট্র্যাকারের মতে, চীনা কোম্পানিগুলো দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের বিভিন্ন সেক্টরে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করছে। ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে চীন পাকিস্তানে ২.৫৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, শ্রীলংকায় ২.৫৫ বিলিয়ন ডলার, নেপালে ১.৩৪ বিলিয়ন ডলার, এবং মিয়ানমারে ২.১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে।
বাংলাদেশে অব্যাহত চীনের বিনিয়োগে নি:সন্দেহে অনেকেই ঈর্শান্বিত । বাংলাদেশে ভারতের জন্য একটি অনুকুল সরকার থাকার পরও কেন বিনিয়োগে ভারত অনেক পিছিয়ে। নিউ দিল্লি ও লন্ডনভিত্তিক ওয়েবসাইট দি থার্ড পোল ডট নেট-এ সম্প্রতি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সমর্থন দেয়ার সময় থেকে বাংলাদেশ-ভারত একটি সর্ম্পকের বন্ধনে আবদ্ধ। কিন্তু বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ওই বন্ধন দেখা যায় না । এর প্রধান কারন ভারতের উদার মনোভাবের অভাব । বড় ভাই সুলভ আচরন । ভারত প্রায়ই কঠিন ঋনের শর্ত জুড়ে দেয় । যে কোনো বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নির্মান সামগ্রী ভারত থেকে আমদানির শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। অবকাঠামো নির্মানে ইট, বালি, রড বা পাথর ভারত থেকে আমদানির শর্ত থাকে। যা পুরন করা কখনো সম্ভব হয় না। ফলে ভারতের দেয়া ঋন অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যবহার করতে পারে না।