ইরান: বিপ্লবের ৪৪ বছর

0
169

ইরান: বিপ্লবের ৪৪ বছর

ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের মধ্য দিয়ে ইরান ইসলামের মর্যাদা সারা বিশ্বের সামনে সমুন্নত রেখেছে । কঠিন অবরোধের মধ্যেও বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে দ্রুত গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে দেশটি। বিশ্বের সকল মুসলিম জাতির কাছে ইসলামকে  রাষ্ট্রীয় নীতিতে ধর্মীয় ধারায় প্রবাহিত করা এক অনণ্য উদাহারন ইরান । স্রোতের বিপরীতে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরান বিস্ময়কর অগ্রগতি অর্জনে সক্ষম হয়েছে।তবে বিভিন্ন উন্নয়ন সূচকে শক্তিশালী অবস্থান বলে দিচ্ছে দেশটি কতটা অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে। ইরানের ঐতিহাসিক বিপ্লবের ৪৪ বছর বিশ্বের সকল মুসলিম জাতির জন্য একটি রোল মডেল।যদিও তাদরে ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে অন্য মুসললিম দেশে র্বিতক আছে। ৪৪ বছরের গণবিপ্লব ইরান কতটুকু এগিয়েছে বা কতটুকু পিছিয়ে পড়েছে তা ভেবে দেখার বিষয়।
আরবরা পারস্যকে জয় করে নিলেও সিরিয়া মিশর যেভাবে আরবদের সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়, ইরান ছিল তার থেকে ব্যাতিক্রম । আরবরা ছিল সেমিটিক জাতি আর ইরানিরা ছিল প্রাচীন আর্য্য বংশীয়। ইরানিয়ান সাংস্কৃতির অনেক কিছুই আরবী সাংস্কৃতি দ্ধারা প্রভাবিত হলেও স্বাতন্ত্রতা ছিল । পারসিয়ানদের ভাষাও ছিল ভিন্ন। জাতি হিসাবে ইরানিরা আরবদের থেকে পৃথক হয়ে আছে ।
শাহ পাহলভি সরকারের চরম পাশ্চাত্য-প্রীতির কারনে ইরানী জনগণ অসন্তুষ্ট ছিলো। ফলে ইরানী জনগণ তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির দিকে এবং আত্মপরিচয় ফিরে পাওয়ার অনুভব করেছিল। শাহের বিরুদ্ধে জনগণের বিশাল বিক্ষোভকে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো গণবিক্ষোভে পরিণত হয় । আর এই গণবিক্ষোভ ১৯৭৯ সালের শুরুতে গণ বিপ্লবের সূচনা হয়।। যা ইসলামি বিপ্লব নামে পরিচিত । এরফলে, ৩৮ বছরের রাজতন্ত্রের পতন হয় এবং শাসক রেজা শাহ পাহলভির জনরোষের মুখে দেশত্যাগে বাধ্য হন। নির্বাসন থেকে ইরানে ফেরেন গণবিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি। ইরানে রাজতন্ত্র বাতিল করে ভবিষ্যৎ ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের একটি খসড়া জাতির সামনে তুলে ধরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করার ঘোষনা দেন। যা প্রথম শরিয়াহভিত্তিক সরকার। এসময় ইরানে দেখা দেয় চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা।
একটি দেশের উন্নয়নের প্রধান চালিকাশক্তি হচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞান। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যে জাতি যত বেশি এগিয়ে, সেই দেশ-জাতি তত উন্নত। দেশটির বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে ইরানের বিজ্ঞানীদের অগ্রগতি গোটা বিশ্বের বিজ্ঞানীদের গড় অগ্রগতির চেয়ে প্রায় ৮ গুণ দ্রুততর। মহাকাশ প্রযুক্তির জ্ঞানের দিক থেকে ইরান বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে রয়েছে এবং মহাকাশ বিজ্ঞানের দিক থেকে রয়েছে ১১তম স্থানে। মহাশূন্যে নিজস্ব প্রযুক্তিতে নির্মিত স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে সক্ষম দেশের মধ্যে ইরানের অবস্থান নবম এবং মহাকাশযানে প্রাণী পাঠানোর ক্ষেত্রে ইরানের অবস্থান ষষ্ঠ। স্টেমসেল গবেষণার ক্ষেত্রে ইরান প্রথম সারির ১০টি দেশের মধ্যে অবস্থান করছে। স্টেমসেল রিপ্লেস করার ক্ষেত্রে বিশ্বে ইরানের অবস্থান দ্বিতীয়। আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বিশ্বে শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে ১৩তম স্থানে রয়েছে ইরান। বিশ্বসেরা গবেষকদের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন ১২ জন ইরানি গবেষক। ইসলামি বিপ্লবের গত চার দশকে ইরান বায়োপ্রযুক্তি, ন্যানোপ্রযুক্তি, চিকিৎসাব্যবস্থা ও ওষুধশিল্পসহ বিজ্ঞানের প্রায় সব ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করেছে।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিভিন্ন উন্নয়ন সূচকে দেশটির শক্তিশালী অবস্থান লক্ষণীয়। বৈশ্বিক মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে তাদের অবস্থান এখন ১৮৯ দেশের মধ্যে ৬০তম, যা তুরস্ক, চীন ও ভারতের ওপরে। শিক্ষা, বিজ্ঞান, উদ্ভাবন, প্রযুক্তিগত উন্নয়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এখন নেতৃস্থানীয় দেশের তালিকায় ইরান। আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বর্তমানে ইরানের অবস্থান বিশ্বে দ্বিতীয়। ন্যানো প্রযুক্তিতে দেশটির অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ। সাবমেরিন শিল্পে ষষ্ঠ, অ্যারোস্পেস, সামরিক ও বেসামরিক বিমান শিল্প, কৃত্রিম উপগ্রহ ও মহাকাশসংক্রান্ত প্রযুক্তিতে অষ্টম, চিকিৎসা খাতে দশম, কৃষিতে দশম, খেলাধুলায় ১৩তম এবং শিল্প খাতে ইরানের অবস্থান বিশ্বে ১৯তম। আইএমএফের তালিকায় বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোর তালিকায় ২০তম অবস্থানে উঠে এসেছে মধ্যপ্রাচ্যে পশতু ভাষার এ দেশটি। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও অর্থনীতির আকার বিচারে ইউরেপের অনেক  দেশের চেয়েও ইরান এখন এগিয়ে। রপ্তানি খাতেও নতুন রেকর্ড তৈরী হয়েছে । পণ্যের তেলবহির্ভূত রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৪৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে গত ৮ মাসে ইরানের বাণিজ্য ৩৪ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। ইরানের প্রেসিডেন্ট সাইয়্যেদ ইব্রাহিম রায়িসি দেশটির জাতীয় সংসদে চলতি ফার্সি ১৪০২ অর্থবছরের জন্য ১৩ হাজার কোটি ডলারের বাজেট পরিকল্পনা পেশ করেছেন।
ইসলাম বিদ্বেষী, পশ্চিমাদের অপপ্রচার এবং ঘরে-বাহিরে প্রবল বাধার পরও পশ্চিম এশিয়ায় ইরান এখন অন্যতম বড় প্রভাবশালী শক্তি। ইরানের প্রভাব কাশ্মির, আফগানিস্তান, বসনিয়া, লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন, ফিলিস্তিন ছাড়িয়ে গেছে ।
সব বিপ্লব সবসময় সফল হয় না। সবার পূর্ণ নাগরিক অধিকারও দেওয়া সম্ভব হয়না । বহু দেশের বিপ্লবই চিন্তাগত বা আদর্শিক ঐক্যের অভাবে আপোষকামীতা আর নানা ধরনের ঘরোয়া দ্বন্দ্বের শিকার হয়ে কিছুকাল পরই নিষ্ক্রিয় ও বিলুপ্ত হয়ে যায় । কিন্তু ইরানের নেতৃবৃন্দ ও জনগণের আদর্শিক ঐক্য ইসলামী বিপ্লবকে দুর্বলতা ও বিলুপ্তি থেকে এখন পর্যন্ত রক্ষা করে চলছে, এবং এটাই সফলতার অন্যতম প্রধান কারণ। তবে দেখার বিষয় এই অগ্রযাত্রা কতদিন চালাতে পারবে ইরান ।

 

সূত্র: বিবিসি, রয়টার্স, পার্স ট্যুডে, উইকিপিডিয়া, ইরান মিরর