শত বৎসরের পুরানো ট্রাস্ট আইনে বাঁধা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

0
14

শত বৎসরের পুরানো ট্রাস্ট আইনে বাঁধা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশের ট্রাস্ট আইন একটি পুরাতন এবং জটিল আাইন। ট্রাস্ট আইন প্রনয়নে ২০১৭ সালে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হককে চেয়ারম্যান করে অধ্যাপক ড.শাহ আলম এবং বিচারপতি এটি এম ফজলে কবীর কে সদস্য করে গঠিত আাইন কমিশনের সুপারিশ ও বিলের খসড়া প্রস্তাবনাতে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশে প্রচলিত ট্রাস্ট সংক্রান্ত মূল আইনটি ট্রাস্ট এক্ট ১৮৮২ প্রায় একশত পঁয়ত্রিশ বছর পুরানো । সামান্য কিছু সংশোধন সহ উক্ত আইনটিই প্রাইভেট বা ব্যক্তি উদ্যোগ মূলক ট্রাস্ট সৃষ্টি ও পরিচালনার ক্ষেত্রে পরিচালিত। অন্যদিকে সরকারি ও জনকল্যাণমূলক ট্রাস্ট গঠন ও পরিচালনার জন্য একক কোনো বিশেষ আইন নাই।

কমিশনের সুপারিশ বলা হয়েছে ট্রাস্ট আইন  ১৮৮২ ট্রাস্টের বিষয়ে সরকারি ও জনকল্যাণমূলক তেমন কোন সুষ্পষ্ট বিধানের উল্লেখ না থাকায় সরকারি অর্থে জনকল্যাণমূলক ট্রাস্ট গঠন করতে প্রতিটির জন্য পৃথক আইন প্রণয়ন করতে হয়। যারফলে, স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বাংলাদেশে সৃষ্ট পনেরটি পাবলিক ট্রাস্টের তালিকা পাওয়া যায়।যা ভিন্ন ভিন্ন ট্রাস্টের জন্য ভিন্ন ভিন্ন আইন হিসেবে প্রনয়ন করা হয়েছে।  কমিশনের মতে উপমহাদেশে ইংরেজ শাসনের পূর্ব হতে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সমাজে বিভিন্ন প্রকার ট্রাস্টের ব্যবহার আছে । অস্পস্টতার কারনে বা আইন না বুঝার কারনে বেসরকারি ট্রাস্টের ক্ষেত্রে প্রায়ই পক্ষগণের মধ্যে বিরোধ তৈরী হয় যা নিষ্পত্তির জন্য দেওয়ানি আদালত পযর্ন্ত গড়ায়। অনেক ক্ষেত্রে মামলার জটিলতা সৃষ্টি হয় যা অত্যন্ত সময় সাপেক্ষ এবং হয়রানী মূলক প্রক্রিয়া। ফলশ্রুতিতে, পক্ষগণ ট্রাস্টের যথাযথ সুবিধাভোগ করতে পারে না। ফলে, ট্রাস্ট গঠন ভাল উদ্যোগ হলেও অনেকেই জটিলতার কারনে নিরুৎসাহিত বোধ করে।  তাই গঠিত আাইন কমিশনের সুপারিশ ও বিলের খসড়া প্রস্তাবনাতে ব্যক্তি উদ্যোগ ট্রাস্ট কে যুগাপযোগী এবং সার্বজনিক বা সরকারি ও জনকল্যাণমূলক ট্রাস্ট আইন এই তিনটিকে আলাদা প্রবর্তন করার প্রস্তাব রয়েছে।  এতে যে কোনো প্রকার ট্রাস্ট গঠন ও পরিচালনা সংক্রান্ত অনেক জটিলতার অবসান এবং একই সাথে ব্যক্তিগত, সরকারি ও জনকল্যাণমূলক ট্রাস্ট আইনের অনেক অসামঞ্জস্যতাও দূর হবে । বর্তমানে ১৮৮২ সালের আইনটি নিজের বা অন্যের উপকারার্থে কোন সম্পত্তির দায়িত্ব অন্যের উপর ন্যস্ত করা এবং সম্পত্তির মালিক বা যে ট্রাষ্ট সৃষ্টি করে তাকে আস্থা স্থাপনকারী বা ট্রাষ্ট প্রবর্তক বলা হয়েছে।  ট্রাস্ট গঠন করা হয় সাধারনত: সম্পত্তি হস্তান্তর ও উত্তরাধিকার আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। যা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রযোজ্য নয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ১৫ ধারাতে বলা হয়েছে, ”প্রত্যেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালনার জন্য একটি র্বোড অব ট্রাস্ট থাকিবে এবং উক্ত র্বোডের সদস্যগনের একজন সদস্য র্বোড অব ট্রাস্ট-এর সভাপতি হইবেন”। এছাড়া আইনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য ”র্বোড অব ট্রাস্ট-এর ক্ষমতা ও দায়িত্ব”দেওয়া আছে। ইউজিসির অফিস আদেশে বলা হয়েছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি, প্রোভিসি ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের লক্ষ্যে র্বোড অব ট্রাস্টের কোনো সদস্যের নাম তিনজনের প্যানেলে প্রস্তাব করা যাবে না এবং র্বোড অব ট্রাস্টের কোনো সদস্য বিশ্ববিদ্যালয়ে উল্লিখিত তিন পদে নিয়োজিত থাকতে পারবেন না। ৬(১) ধারাতে বলা হয়েছে, ”সাময়ীক অনুমোতির জন্য প্রস্তাবিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন ও পরিচালনার উদ্দেশ্যে অনধিক ২১ কিন্তু অন্যুন ৯ সদস্য বিশিষ্ঠ একটি র্বোড অব ট্রাস্টিজ গঠন করিতে হইবে। তার মানে ২১ জন সবাই র্বোড সদস্য (?) আইনের কোথাও ট্রাস্ট কিভাবে গঠিত হইবে বলা নাহলেও ট্রাস্ট আইন  অনুযায়ীই নিবন্ধন করা হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন  ২০১০-এ ট্রাস্ট গঠন প্রক্রিয়া না থাকায় বিভিন্ন জটিলতা তৈরী হচ্ছে। ইউজিসির নির্দেশনা অনুযায়ী র্বোড অব ট্রাস্ট গঠন করে ট্রাস্ট এক্ট ১৮৮২ অধীনে চুক্তি বদ্ধ হয়ে ১৮৬০ সোসাইটি এক্ট অনুযায়ী জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে নিবন্ধন নিতে হয় এবং সাব রেজিস্ট্রার অফিসে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়, যা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন  ২০১০-এর কোথাও উল্লেখ নাই। যে কারনে কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যগণ ট্রাস্টের কাঠামো এবং  তার পদগুলি মানতে চান না।   ট্রাস্ট শব্দের অর্থ আস্থা, নির্ভরশীলতা, বিশ্বাস। কোন তৃতীয় ব্যাক্তির বা পক্ষের কল্যাণের জন্য যদি কোন ব্যাক্তি অন্য কোন ব্যক্তির বরাবর সম্পত্তি হস্তান্তর করে তাহলে তা জিম্মা বা ট্রাস্ট হিসাবে বিবেচিত হয়। ট্রাস্ট তিনটি পক্ষের মধ্যে একটি চুক্তি অর্থাৎ(১) দাতা বা ট্রাস্ট সৃষ্টিকারী : যিনি তাঁর সম্পত্তি কোন ভালো বা অসহায়দের সাহায্য কারার উদ্দেশ্য তার সম্পত্তির কিছু অংশ একজন বা কাউকে বিশ্বাস করে তৃতীয় পক্ষের উপকার করার জন্য বিশ্বাস করে দান করেন তাকে বলা হয় ট্রাস্টকারী । (২) ট্রাস্টি: তিনি বা তারা যাকে বিশ্বাস করে সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেন তাকে বলা হয় ট্রাস্টি। এবং (৩)সুবিধা ভোগী: যারা উক্ত সম্পত্তির থেকে তাদের লাভ বা উপকার পাবে তাদের বলা হয় সুবিধা ভোগী । বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুবিধা ভোগী কে বা কারা? শিক্ষার্থীরা সুবিধা ভোগী নয়, শিক্ষার্থীরা যে সার্ভিস পায় তার জন্য ফি দেয় । যারফলে, ট্রাস্ট আইন  ১৮৮২ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অস্পস্ট ।  যাঁরা একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান ট্রাস্ট হিসেবে স্থাপন করতে চান, তাঁরা জানেন ট্রাস্ট চালানো কোনো সহজ বা চাপমুক্ত কাজ নয়। একটি ট্রাস্ট রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিচালনার জন্য যথেষ্ট সময় এবং পরিশ্রম বিনিয়োগ করার জন্য একজন  ট্রাস্টির প্রয়োজন। একটি ট্রাস্ট যে ভাবেই নিবন্ধিত হউক না কেন ট্রাস্ট আইন  অনুযায়ী একজন  ট্রাস্টির ট্রাস্ট সম্পকৃত কাজের জন্য সাধারনত: পারিশ্রমিক পাবেন না, যদি সকল  ট্রাস্টি এক মত  হন তাহলে ভিন্ন কথা। তবে বিভিন্ন দেশে ট্রাস্ট সুরক্ষার জন্য পেশাদার ট্রাস্টিদের ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতা দেখা যায় এবং পেশাদার ট্রাস্টিদের অর্থ প্রদানের ধারনা এখন অনেক বেশি বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। বর্তমান আইনে, পেশাদার ট্রাস্টিদের বা একজন  ট্রাস্টি যদি ট্রাস্টের বাহিরে অন্য কোন পদে কাজ করেন, তার কোন নির্দেশনা নাই । তাঁদের মেধার জন্য পারিশ্রমিক দেওয়া না দেওয়ার কথাও বলা নাই । ট্রাস্ট সুরক্ষা এবং ট্রাস্টের কাজের বাহিরে ট্রাস্টের বাহিরে অন্য পদের কাজের জন্য পেশাদার ট্রাস্টিদের তাঁদের মেধার জন্য অর্থ প্রদান বিভিন্ন দেশে প্রচলিত। ট্রাস্ট এক্ট ১৮৮২-তে ৫০ ধারায় যা বলা আছে তা কেবল ট্রাস্ট সর্ম্পকিত।”একজন  ট্রাস্টির তার ঝামেলা, দক্ষতা এবং ট্রাস্ট কার্যকর করার সময় নষ্ট হওয়ার জন্য পারিশ্রমিক পাওয়ার অধিকার নেই।”এখানে ট্রাস্টের বাহিরের পদের কথা বলা হয় নাই । অথচ ৫০ ধারা সঠিক ভাবে না বুঝে নিজস্ব অনুমান ও মতামতের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। সময়ের দাবি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্ট পরিচালনার জন্য সঠিক দিক নির্দেশনা । অন্যথায় সমস্যা লেগেই থাকবে। সুস্পষ্ট লক্ষ ও উদেশ্যে শিক্ষা অনুরাগীরা তাদের মেধা দিয়ে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, অর্থ প্রদান করেন, দায়-দায়িত্ব নিয়ে সার্বক্ষনিক সময়ও দেন । কিন্তু তাঁরা ট্রাস্ট সুরক্ষার জন্য এবং ট্রাস্ট পরিচালনার বাহিরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁদের পেশাদারিত্বের প্রয়োগ করতে সার্বক্ষনিক সময় দিতে পারবেন না, তা কিন্তু আইনে নাই। উদ্যোক্তা যদি শিক্ষার বিস্তারে ভূমিকা রাখতে না পারেন, তাঁরা লক্ষ ও উদেশ্যে কে কিভাবে বাস্তবায়িত করবেন! বেসরকারি উদ্যোক্তারা কেন এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ নেবেন? এতে বেসরকারি খাতে উচ্চশিক্ষার বিস্তার বাধাগ্রস্ত হতে পারে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারক বাহক ট্রাস্ট। শুধু আইন দিয়ে যদি প্রতিষ্ঠান ভাল ভাবে চলতো তাহলে আমাদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এত সংবাদ প্রচার মাধ্যমে আসতো না। শিক্ষা প্রসারের জন্যই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় । দুর্নীতি রোধ করার জন্য উদ্যোগ এবং মেধাকে চাপিয়ে না রেখে যথাযত আইনের এবং ইতিবাচক আচরনের মাধ্যমেই ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব ।

দেশে উচ্চশিক্ষা বিস্তারের জন্যই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করতে আসেন ট্রাস্টিরা। সরকারি আর  বেসরকারির মধ্যে পার্থক্য কেবল অর্থায়নে। একটিতে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী আর অপরটিতে সরকার অর্থায়ন করে। এছাড়া আর সবই একই।তবে অনিয়মের কথা বলে কোনো সংস্থার নিয়ন্ত্রণ হলে তা হবে দু:খজনক। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আর হাইস্কুলের কোনো পার্থক্য থাকবে না। সরকার যদি নিয়ন্ত্রণ করেত চায় তাহলে  বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থ ব্যয়ের দায়িত্বও সরকারের নেওয়া উচিত।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আলাদা ট্রাস্ট আইন করলে দেশের উচ্চ শিক্ষাব্যবস্থা সংকীর্ণতার হাত থেকে রেহাই পাবে । বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিদ্যমান পরিস্থিতি তদারকি করে একটি পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা হওয়া প্রয়োজন। সুশাসন প্রতিষ্ঠা, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত এবং স্বচ্ছ পরিচালনা পরিষদ বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টিজের ক্ষমতা, অধিকার, সম্মান,যথাযথ না হলে এক সময় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ‘বোঝা হয়ে দাঁড়াবে’।আস্থা হরিয়ে অর্থ সংকটে পড়বে। যার কিছু লক্ষণ এখনই দেখা যাচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আলাদা ট্রাস্ট আইন না হলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সক্ষমতা গুণগত শিক্ষার মান নিশ্চিত করা কঠিন হবে ।

লেখক: টেকসই উন্নয়ন কর্মী

E-Mail: sjahan@southern.ac.bd