বাংলাদেশ ভারতকেন্দ্রিক পররাষ্ট্রনীতির নতুন দিগন্ত
ভারতের ওপর থেকে নির্ভরতা কমিয়ে পররাষ্ট্রনীতিতে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ। প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূস আসিয়ানে যোগ দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন ।১০ সদস্যের এই জোটে যোগদানের ক্ষেত্রে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মালয়েশিয়ার সমর্থন চেয়েছেন তিনি। ঢাকায় নিযুক্ত মালয়েশিয়ার হাইকমিশনার হাজনাহ মোহাম্মদ হাশিম মোহাম্মদের সাথে বৈঠকের সময় ওই আগ্রহ জানান মোহাম্মদ ইউনূস। হাইকমিশনার জানান, ইউনূসের অনুরোধের বিষয়টি তিনি তার দেশের সরকারের কাছে পৌঁছে দিবেন। এখানে মনে রাখা দরকার যে, ২০২৫ সালে আসিয়ানের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছে মালয়েশিয়া।
বিশেষজ্ঞদের মতে এখনই আসিয়ানের সদস্য হওয়াটা ঢাকার জন্য সহজ নয়। প্রবল গণআন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে হেলিকপ্টার নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান ৭৬ বছর বয়সী শেখ হাসিনা। গণতন্ত্রবিহীন ১৫ বছরের শাসনকালে তিনি প্রচন্ড স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিলেন।শেখ হাসিনা দেশকে যে বিপর্যস্ত অবস্থায় রেখে পালিয়ে গেছেন, সেটাকে সামলে নেওয়ার ধকল এখন বইতে হচ্ছে নতুন সরকারকে। বাংলাদেশ এখন যে রাজনৈতিক আর আর্থ-সামাজিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, আসিয়ানের অধিকাংশ দেশই সেটাকে সহানুভূতির চোখে দেখলেও,আঞ্চলিক গুরুত্বপূর্ণ এই ফোরামে সদস্যপদের জন্য নিজেদেরকে উপযুক্ত করে তুলতে বাংলাদেশকে আগে স্থিতিশীলতা নিয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক অস্থিরতা কমাতে হবে। বিশেষ করে নানা সমস্যা আর চ্যালেঞ্জে জর্জরিত বাংলাদেশকে সদস্য হিসেবে নেয়ার জন্য আসিয়ান তাড়াহুড়া করবে না।
আসিয়ানের সদস্য হওয়ার জন্য বাংলাদেশের আগ্রহের অন্নতম কারণ হচ্ছে শেখ হাসিনার সরকার সবসময় ভারত-কেন্দ্রিক পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করেছেন। বাংলাদেশ এখন সেই জায়গা থেকে বেরিয়ে পূর্বের দেশগুলোর দিকে ঝুঁকছে। শেখ হাসিনার পুরো শাসনকালেই ভারতের শীর্ষ নেতাদের সাথে জোরালো সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন শেখ হাসিনা। ২০২৪ সালের জুলাই মাসেও ভারত সফরে গিয়ে ১০টি চুক্তি করে এসেছিলেন । নৌসীমায় সহযোগিতা, ডিজিটাল অংশীদারিত্ব ও রেল সংযোগ থেকে শুরু করে মহাকাশ প্রযুক্তি খাতেও ভারতের সাথে চুক্তি করেছিলেন শেখ হাসিনার ।
শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে ২০২৪ সালের গণবিক্ষোভে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে তীব্র ক্ষোভ ছিল।বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারত দীর্ঘদিন ধরে অনাকাঙ্খিক্ষত হস্তক্ষেপ করেছে। যারফলে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ভারতের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ছিল।ফলে আলোচনায় এসেছে বাংলাদেশের এই উত্থানের বিষয়টি। ভারতীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এখন বাংলাদেশের নেয়া সিদ্ধান্ত ও আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। ভারতের সবসময় অযাচিত হস্তক্ষেপের বিপরীতে একটা বৈশ্বিক অবস্থান তৈরির জন্য বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে নিজ অবস্থানকে শক্তিশালী করার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে আসিয়ানের সদস্যপদকে একটা বিকল্প প্ল্যাটফর্ম বিবেচনা করছে অনেকেই।
বিগত তিনটি নির্বাচনকে সম্পূর্ণ প্রহসন বানিয়ে ছিলেন পতিত শেখ হাসিনার প্রশাসন।বাংলাদেশ ছাড়াও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকও এই অভিযোগ করেছে। পাতানো ওই নির্বাচনের মাধ্যমে টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় বসেছিলেন হাসিনা এবং তাঁর দল। নির্বাচনের আগেই বিরোধী দলের নেতাকর্মীকে আটক করে জেলে ঢুকিয়েছিল হাসিনার সরকার।ব্যাপক আন্তর্জাতিক সমালোচনার পরও ভারত ওই নির্বাচনের ফলকে স্বাগত জানিয়েছিল। ভারতের এই অবস্থানের জবাবে সারা বাংলাদেশ জুড়ে তখন ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক ওঠে। আগে যেভাবে ভারত বাংলাদেশের বিষয়গুলোতে প্রভাব বিস্তার করতো,এখন আর সেদিন নেই।
ক্ষমতাচ্যুত সরকার খুব বেশি ভারতকেন্দ্রিক ছিল। ভারতের সঙ্গে অবশ্যই ভালো সম্পর্ক চাই। এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে সেটা পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে হতে হবে। পূর্ববর্তী সরকার সব সময় বলার চেষ্টা করেছে যে, ভারতের সঙ্গে সোনালি অধ্যায় চলছে। বিগত দেড় দশক ধরে ভারতের একটি ঘনিষ্ঠ বন্ধু সরকার ক্ষমতায় থাকার পর প্রায় রাতারাতি সেই সরকার বিদায় নিয়েছে।ভারতের প্রতিবেশী অনেকগুলো দেশেই সে দেশের সরকার ভারতের প্রতি খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ – কিন্তু সে দেশের সাধারণ মানুষ ভারত-বিরোধিতায় ফুঁসছেন। একই ভাবে তাই ঘটেছে বাংলাদেশে ।
ভারত-বাংলাদেশের নেতা-মন্ত্রীরা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক দারুণ উন্নত হয়েছে বলে ক্রমাগত দাবি করে গেছেন। কিন্তু এই দুটোর মধ্যে একটা মারাত্মক স্ববিরোধিতা আছে, যেটা বেশি দিন ধামাচাপা দিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। ভারত মনে করে প্রতিবেশী দেশের সরকার পাশে থাকলেই তাদের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকবে। ভারত প্রতিবেশী দেশগুলোতে নিজেদের স্বল্পকালীন স্বার্থের হিসেব করেই এগিয়েছে, দীর্ঘমেয়াদে কী হবে তা নিয়ে কখনও মাথা ঘামায়নি। আর একটার পর একটা দেশে তার পরিণামও ভুগতে হচ্ছে তাদের।
ভারত নিজেকে একটি আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায় কিন্তু এই দেশগুলোর প্রতি তাদের কিছু দায়িত্বও পালন করতে চায় না – যেটা এখন প্রায় অনুপস্থিত। সফল বৈদেশিক নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সক্ষম পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দরকার। পেশাদার কূটনীতিকদের ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারলে বাংলাদেশ সফল হবে।’