শান্তি ও উন্নয়নের জন্য বিশ্ব বিজ্ঞান দিবস ২০২৫
বিজ্ঞান একটি জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতির প্রধান চালিকাশক্তি। বিশ্বব্যাপী শান্তি, সমতা, স্বাস্থ্য ও টেকসই উন্নয়নে বিজ্ঞানের অবদান অপরিসীম। এ উপলক্ষে প্রতি বছর ১০ নভেম্বর পালিত হয় “শান্তি ও উন্নয়নের জন্য বিশ্ব বিজ্ঞান দিবস”।
এই দিবসটির ধারণা আসে ১৯৯৯ সালে বুদাপেস্টে অনুষ্ঠিত বিশ্ব বিজ্ঞান সম্মেলন থেকে। এই সম্মেলনে বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ব্যবহারের উপর একটি ঘোষণাপত্র তৈরি করা হয়, যা ইউনেস্কো কর্তৃক ঘোষণা: ২০০০ সাল নামে পরিচিত। এই ঘোষণার প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য এবং বিজ্ঞানের ভূমিকাকে আরও সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য ইউনেস্কো একটি বার্ষিক দিবস পালনের প্রস্তাব দেয়। ইউনেস্কোর উদ্যোগে ২০০১ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই দিবসটি ঘোষণা করে এবং ২০০২ সাল থেকে এটি প্রথম পালিত হতে থাকে ।
সকলের জন্য বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতায় টেকসই উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান দশক ২০২৪-২০৩৩ । সেই সম্ভাবনা উন্মোচনের জন্য ইউনেস্কোর নেতৃত্বে, একটি বিশ্বব্যাপী আন্দোলন যা বিজ্ঞানকে একটি সাধারণ হিসেবে প্রচার করে এবং এটা সীমান্ত পেরিয়ে উদ্ভাবন, অন্তর্ভুক্তি এবং সহযোগিতার ইন্ধন জোগায়। একসাথে, এমন একটি ভবিষ্যত গড়ে তুলার হবে যা মানুষ এবং গ্রহের জন্য আরও ন্যায়সঙ্গত, স্থিতিস্থাপক এবং তথ্যবহুল হবার আশা জাগায়।
২০২৫ সালের শান্তি ও উন্নয়নের জন্য বিশ্ব বিজ্ঞান দিবসের প্রতিপাদ্য হল “বিশ্বাস, রূপান্তর এবং আগামীকাল: ২০৫০ সালের জন্য আমাদের প্রয়োজন বিজ্ঞান”। এই প্রতিপাদ্য মূলত: আস্থা তৈরি, রূপান্তর চালিকাশক্তি এবং সকলের জন্য একটি টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের ভূমিকাকে তুলে ধরা হয়। এই দিবসটি একটি শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজনীয় বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞান-সমাজ সম্পর্কের উপর আলোকপাত করে । এর মাধ্যমে বিজ্ঞান আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে বিজ্ঞান সীমানা অতিক্রম করে এবং সকলের জন্য একটি উন্নত ভবিষ্যত গড়ে তোলে।
জাতিসংঘের মতে, এই দিবসটির চারটি প্রধান লক্ষ্য: (১)জনসচেতনতা বৃদ্ধি; (২)আন্তর্জাতিক সংহতি; (৩)প্রতিশ্রুতি নবায়ন; (৪)চ্যালেঞ্জের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ; অর্থাৎ এই দিবস পালনের প্রধান কারণ হচ্ছে, শান্তি, টেকসই উন্নয়ন এবং সকলের কল্যাণে বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পুনর্ব্যক্ত করা। বৈজ্ঞানিক উন্নয়ন সম্পর্কে সমাজের সকল অংশের মানুষকে সচেতন করা এবং বিজ্ঞানকে মানুষের কাছাকাছি নিয়ে আসা। জনগণের মধ্যে বিজ্ঞানচর্চার গুরুত্ব তুলে ধরা। দেশগুলির মধ্যে ভাগ করা বিজ্ঞানের জন্য সংহতি প্রচার করা। বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উদ্ভাবনে জনসচেতনতা বৃদ্ধি। সমাজকে উপকৃত করার জন্য বিজ্ঞানের ব্যবহারের প্রতি প্রতিশ্রুতি নবায়ন করা। বিজ্ঞানীদের সামাজিক দায়িত্ব ও নৈতিকতা স্মরণ করিয়ে দেওয়া। বিজ্ঞানের মুখোমুখি হওয়া চ্যালেঞ্জগুলির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা।
বিজ্ঞানকে সমাজের কাছাকাছি নিয়ে আসা অর্থাৎ, এই দিবসটি বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায় এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তৈরির উদ্দোগ নেওয়া । এর মাধ্যমে নাগরিকরা বিজ্ঞানের সর্বশেষ অগ্রগতি সম্পর্কে জানার সুযোগ পাবে এবং বৈজ্ঞানিক বিতর্কে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত হবে।
দিবসটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনের অপরিহার্য ভূমিকাকে তুলে ধরা। জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র্য, মহামারি এবং অন্যান্য বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য বিজ্ঞানই প্রধান হাতিয়ার। ইউনেস্কো এই দিনটি ব্যবহার করে সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে বসবাসকারী বিজ্ঞানীদের মধ্যে সহযোগিতা এবং যৌথ কর্মসূচিকে উৎসাহিত করা যাতে সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে সহযোগিতা পাওয়া যায়।
একথা সত্য পরমাণু শক্তি যুদ্ধের বিপদ যেমন সৃষ্টি করেছে, তেমনি পরমাণু চিকিৎসা বহু প্রাণ রক্ষা করেছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদরা নিরলস গবেষণা চলচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতে, ভ্যাকসিন ও চিকিৎসা উদ্ভাবনে বিজ্ঞান শান্তি ও সুস্থতার অবদান রাখছে। প্রযুক্তির মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ, শিক্ষা বিস্তার, কৃষি উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে।
দেশে আজ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, আইসিটি খাতের প্রসার, উদ্ভাবনী স্টার্টআপ এগিয়ে যাচ্ছে। তবে এখনও বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ গঠনে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। এই দিনটি বিজ্ঞানকে সমাজের সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে যুক্ত করার লক্ষ্য রাখে, যাতে নাগরিকরা বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি সম্পর্কে অবগত থাকেন। এটি বিজ্ঞানীদের ভূমিকা তুলে ধরে, যারা আমাদের গ্রহ সম্পর্কে আমাদের বোধগম্যতা বাড়াতে এবং আমাদের সমাজকে আরও টেকসই করে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। দিবসটি সাধারণত প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট প্রতিপাদ্য নিয়ে পালিত হয়, যা সমসাময়িক বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিজ্ঞানের ভূমিকা তুলে ধরে।
শান্তি ও উন্নয়নের জন্য বিজ্ঞান অপরিহার্য। বিজ্ঞান শুধু প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ নয়, এটি মানবতার কল্যাণে ব্যবহৃত হওয়া উচিত। এই দিবসের মূল বার্তা— “বিজ্ঞান হোক মানবতার সেবায়, শান্তির অগ্রযাত্রায়”।
শান্তি ও উন্নয়নের জন্য বিশ্ব বিজ্ঞান দিবস বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানের জন্য অনেক বাস্তব প্রকল্প, কর্মসূচি এবং তহবিল তৈরি করেছে। এই দিবসটি সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে বসবাসকারী বিজ্ঞানীদের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধিতেও সাহায্য করেছে – এর একটি উদাহরণ হল ইউনেস্কো-সমর্থিত ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি বিজ্ঞান সংস্থা (IPSO) তৈরি।
এই দিবসটি শুধু বিজ্ঞানীদের জন্য নয়, বরং প্রতিটি নাগরিকের জন্য। এটি মানুষকে বিজ্ঞান সম্পর্কে আগ্রহী হতে, প্রশ্ন করতে এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে ইতিবাচক পরিবর্তনে ব্যবহার করতে অনুপ্রাণিত করে।
শান্তি ও উন্নয়নের জন্য বিশ্ব বিজ্ঞান দিবস উদযাপনের মূল ভিত্তি হলো টেকসই সমাজের জন্য বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের ভূমিকার গুরুত্ব এবং নাগরিকদের বিজ্ঞানের সাথে সম্পৃক্ত করার প্রয়োজনীয়তা। এই অর্থে, শান্তি ও উন্নয়নের জন্য বিশ্ব বিজ্ঞান দিবস সাধারণ জনগণকে তাদের জীবনে বিজ্ঞানের প্রাসঙ্গিকতা প্রদর্শন এবং আলোচনায় তাদের সম্পৃক্ত করার সুযোগ করে দেয়। এই ধরনের উদ্যোগ বিশ্বব্যাপী শান্তি ও উন্নয়নের অনুসন্ধানে একটি অনন্য দৃষ্টিভঙ্গিও নিয়ে আসে। “বিজ্ঞান হোক মানবতার সেবায়, শান্তির অগ্রযাত্রায়”।



