অনেক সাফল্য আর র্ব্যথতা নিয়ে পয়তাল্লিশ বছরের পথপরিক্রমায় আজকের এই বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সাফল্যের ভাগিদার এ দেশের সকল সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তথা এদেশের সাধারণ মানুষ। কিন্তু ব্যর্থতার দায়ভার কতটুকু সাধারণ মানুষের আর কতটুকু আমাদের অপরাজনীতির সেই প্রশ্ন থাকছেই। তবে রাজনীতি যেহেতু সাধারণ মানুষকে নিয়েই তাই সাধারণ মানুষ অসাধারণ হয়ে না উঠার এই দায়ও এড়াতে পারেন না নিশ্চয়। নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জনগণের অসীম সাহস ও ঈর্ষণীয় সাফল্য এবং বৈশ্বিক ও সামাজিক বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগামী অবস্থান আমাদের সবাইকে আপ্লুত ও আনন্দিত করে। আবার কিছু ঘটনা এই সাফল্যকে মøানও করে। মিডিয়ায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও এসব নিয়ে হচ্ছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। কারো মতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার, রাজনৈতিক শিষ্ঠাচারহীনতার, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের কথা। আবার কেউ বলছেন প্রশাসনিক সমন্বয়হীনতার কথা। তবে সবচেয়ে উদ্বিগ্ন, চিন্তিত ও ব্যথিত করে সামাজিক অবক্ষয়। মানুষের মানবীয় গুণাবলী নি:শ্বেষ হয়ে যাওয়া ও অমানবিক আচরণে যে গতিতে দেশ এগুচ্ছে সমতালে নীরবে সাফল্য মøান হচ্ছে।
আমাদের মিডিয়ায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে যখন প্রচার হয় বাবার হাতে সন্তান খুন, সন্তানের হাতে মা-বাবা খুন, ভাই ভাই খুনাখুনি, শিশু ধর্ষিত, স্বামী-স্ত্রীর সংঘাত। তখন আতঙ্কিত হওয়া এবং লজ্জা ছাড়া আর কি করার থাকে? প্রায় শুনা যায় ধর্ষণ করার পেছনে মেয়েদের চলাফেরা, পোষাক-আশাক নাকি অনেকাংশেই দায়ী। বুঝে আসে না শিশু কেন ধর্ষিত!
রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিবেশের দায় আমরা সরকারের বা বিরোধীদলের উপর চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে বসে থাকতে পারলেও, সামাজিক বা মনস্তাত্তিক অস্থিতিশীল পরিবেশের দায়ভারতো সকলকেই নিতে হবে। মানবীয় গুণাবলীর চর্চা ও অর্জন আমাদের নিজেদেরই করতে হবে। এই চর্চা শুরু করতে হবে আমাদের পরিবারের ভেতর থেকেই। আমাদের পরিবারগুলোতে জ্ঞানের চর্চা, ধর্ম, সংস্কৃতি, সুরুচির চর্চা অবশ্যই করতে হবে এবং ধারাবাহিকভাবে বজায় রাখতে হবে।
মা ও বোনেরা এবং কিছু ভাইয়েরাও পরম আগ্রহে ও ভালোবাসায় ভিনদেশি সিরিয়ালগুলো অনেক রাত জেগে দেখেন। এই ধরনের বিনোদনে ভালোটা শেখার থেকে খারাপটা শেখার সুযোগ অনেক বেশি। এই সকল অনুষ্ঠান সমাজে এবং আমাদের মনোজগতে খারাপ প্রভাব ফেলছে। আমরা বোধহয় তা বুঝতে পারলেও বুঝাতে পারছি না। এই অবস্থান থেকে উত্তরণে যুবসমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। এখন বাড়ির সবাই মিলে একটা ভালো সিনেমা দেখা, গানশুনা, পরিবারের সবাইকে নিয়ে গানের আসর আর বসে না। ভাল বই নিয়ে কথা বলাতো অনেক আগেই শেষ। সবাই মিলে দর্শনীয় স্থানে ঘুরে আসতে চায় অনেকে। কিন্তু রাজনীতির নামে আতঙ্ক, নিরাপত্তাহীনতায় অনেক কিছুই করা সম্ভব হয় না।
জনসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে অধিক সংখ্যক মানুষ এখন কর্মমুখি। বেশিদিন আগের কথা নয় ৮/১০ জন লোকের সংসারে উর্পাজনকারী ছিলেন একজনই। বর্তমানে শিক্ষিত পারিবারে ৪-৬ জন এবং প্রায় প্রত্যেকেই কর্মজীবী। জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি সীমাহীন চাহিদা ও বিলাসবহুল জীবনযাত্রার আকাঙ্খা প্রত্যেককেই উপার্জনে এবং আরো অধিক উপার্জনে প্রলুদ্ধ করছে। যার কারণে ছোট বেলায় সন্তানদের মনে নৈতিকতা, মূল্যবোধ, সততা, ভালোবাসা, যেভাবে দেওয়ার কথা ব্যস্ততার মধ্যে তা হারিয়ে গেছে। সন্তানেরা নৈতিকতা, মূল্যবোধ, সততা, ভালোবাসা, মমতা ও স্নেহের থেকে অনেক দূরে।
মানবীয় গুণাবলী সম্পন্ন মানুষ একদিনে হওয়া যায় না। পাঠ্য পুস্তকের পাশাপাশি সন্তানদের ভাল বই পড়ার উৎসাহ দেওয়া জরুরি। ভাল বই শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠিত ও সফল মানুষই বানাবে না, সাথে সাথে হৃদয়বান, সুবিবেচক মানুষে পরিণত হওয়ার একটা উপায়। পছন্দ অনুযায়ী সুকুমার বৃত্তিগুলো প্রষ্ফুটিত হওয়ার সুযোগ দিন দিন কমে যাচ্ছে। ধর্মের নামে উগ্রতা, প্রযুক্তির প্রভাব মানুষকে নিষ্ঠুর করে তুলছে। আজকাল তরুণ সমাজ মোবাইল ফোনের ছোট পর্দায় জীবনটাকে বন্দী করে রেখেছে নিজেরাই। ক্ষণজীবনের অনেকটা সময় ফেসবুক, ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নিজেকে ডুবিয়ে রাখে। প্রায় ভুলতেই বসে ভার্চুয়াল দুনিয়ার বাইরেও একটা সত্যিকার দুনিয়া আছে। যেখানে অনেক কিছু করার আছে তরুণদের। প্রযুক্তির কারণে এগুলো হয়তো জীবনের একটা অংশ হতে পারে, কিন্তু এটাই জীবন নয়। তরুণরাই এই দেশের আগামীর ভবিষ্যৎ।
তরুণদের সামাজিক মানুষ হিসাবে, মানবীয় গুণাবলী সম্পন্ন মানুষ হিসাবে নিজেদের গড়ে তোলার জন্য অবিরাম চর্চা করতে হবে। এই চর্চা চিরন্তন। তা হলে সমাজে অপরাধ প্রবণতা অনেকাংশে কমবে। সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয়ের কথা ও মানবীয় গুণাবলীর পুনঃগঠনের কথা সকলের সামনে তুলে ধরতে হবে।
শারীরিক অসুস্থতার সাথে সাথে মানসিক সুস্থতার ব্যাপারেও আমাদের সচেতন হতে হবে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও বিপর্যয়ের সাথে সাথে সামাজিক, মানবিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয়কেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। দেশের জন্য তরুণদের অনেক কিছু করণীয় আছে, সেই কাজগুলো অবশ্যই করতে হবে। এই তরুণরাইতো একদিন প্রবীণ হবেন এবং নতুন তরুণের জন্ম দিবেন। কবির ভাষায়-
‘ভবিষ্যতের লক্ষ আশা মোদের মাঝে সন্তরে,
ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা, সব শিশুরই অন্তরে’