সত্যের অধিকারের আন্তর্জাতিক দিবস:২৪ মার্চ

0
14

সত্যের অধিকারের আন্তর্জাতিক দিবস:২৪ মার্চ

সত্যের অধিকার প্রায়শই মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন এবং মানবিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘনের প্রেক্ষাপট তৈরী করে। নির্যাতিত বা নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনদের জানার অধিকার রয়েছে কেন তারা  নির্যাতিত তারা  কেন নির্যাতনের শিকার ।  অধিকার বলতে বোঝায় প্রকৃত সত্য যে ঘটনাগুলি ঘটেছিল, তাদের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে এবং কারা সেগুলিতে অংশ নিয়েছিল, সে পরিস্থিতিতে এবং সেইসঙ্গে সেগুলির কারণগুলি সম্পর্কে পূর্ণ সত্য জানা।
প্রতি বছর,২৪ মার্চ, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের মর্যাদার জন্য সত্যের অধিকারের জন্য আন্তর্জাতিক দিবস পালিত হয়। এল সালভাদরে ১৯৮০ সালের ২৪ মার্চ আর্চবিশপ অস্কার আর্নুলফো রোমেরো মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা করেছিলন তার পরই আর্চবিশপ অস্কার আর্নুলফো রোমেরোকে  সরকারপন্থী বাহিনী, তথাকথিত “ডেথ স্কোয়াড” দ্বারা হত্যা করা হয়েছিল, মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা করার পরে এই হত্যাকান্ড অনেকে গ্রহন করতে পারেনি। কারন তিনি সক্রিয়ভাবে এল সালভাদরের সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তিদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা করতেন ।তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য জাতিসংঘ এই দিবসটি উদযাপন করে।
এই দিবসটির উদ্দেশ্য:
(১)স্থূল এবং নিয়মতান্ত্রিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকারদের স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং সত্য ও ন্যায়ের অধিকারের গুরুত্ব প্রচার করা;
(২)সকলের জন্য মানবাধিকার প্রচার ও সুরক্ষার সংগ্রামে যারা তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন এবং তাদের জীবন হারিয়েছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা;
(৩)বিশেষত, এল সালভাদরের আর্চবিশপ অস্কার আর্নুলফো রোমেরোর গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং মূল্যবোধকে স্বীকৃতি দেওয়া, যিনি সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা করার পরে এবং নির্যাতনে শিকারদের জীবন রক্ষা প্রচারের নীতিগুলিকে রক্ষা করার জন্য মানুষের মর্যাদা এবং সব ধরনের সহিংসতার বিরোধিতা করার কারনে আত্ব ত্যাগ করেছেন।
২১ ডিসেম্বর ২০১০ তারিখে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২৪ মার্চকে স্থূল মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের মর্যাদার জন্য সত্যের অধিকারের জন্য আন্তর্জাতিক দিবস হিসাবে ঘোষণা করে। এই  তারিখটি বেছে নেওয়া হয়েছিল কারণ মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা করার পর আর্চবিশপ অস্কার আর্নুলফো রোমেরোকে হত্যা করা হয়েছিল। সংঘটিত সহিংসতার গুরুতর ঘটনা তদন্ত করার জন্য ২৭ এপ্রিল ১৯৯১ সালের মেক্সিকো চুক্তি অনুসারে এল সালভাদরের সত্যের উপর কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং সমাজে যার প্রভাব সত্যের জরুরি জনসাধারণের জ্ঞান প্রয়োজন বলে মনে করা হয়েছিল।
২০০৬ সালে পরিচালিত একটি সমীক্ষায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে স্থূল মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং মানবাধিকার আইনের গুরুতর লঙ্ঘন সম্পর্কে সত্যের অধিকার একটি অনির্বাণ এবং স্বায়ত্তশাসিত অধিকার, যা দায়িত্ব ও বাধ্যবাধকতার সাথে যুক্ত।প্রতিটি রাষ্ট্রের মানবাধিকার রক্ষা করার দায়িত্ব,কার্যকর তদন্ত পরিচালনা এবং কার্যকর প্রতিকার ও ক্ষতিপূরণের নিশ্চয়তা প্রদান করবে।
২০০৯ সালের সত্যের অধিকারের একটি প্রতিবেদনে, মানবাধিকারের জন্য জাতিসংঘের হাইকমিশনারের কার্যালয় এই অধিকারের কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য সর্বোত্তম অনুশীলনগুলি চিহ্নিত করেছে, বিশেষত মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন সম্পর্কিত আর্কাইভ এবং রেকর্ড সম্পর্কিত অনুশীলনগুলি এবং প্রোগ্রামগুলি এই ধরনের লঙ্ঘনের সাথে যুক্ত বিচারে জড়িত সাক্ষী এবং অন্যান্য ব্যক্তিদের সুরক্ষা। এখানে সত্যের অধিকার বলতে বোঝায়, যে ঘটনাগুলি ঘটেছিল,তাদের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে এবং কারা সেগুলিতে অংশ নিয়েছিল, সেই সাথে লঙ্ঘনগুলি যে পরিস্থিতিতে ঘটেছে তা জানার পাশাপাশি সেগুলির কারণগুলি সম্পর্কে সম্পূর্ণ সত্য জানা।
উল্লেখ:অধিকার দুই ধরনের। প্রাকৃতিক এবং আইনগত ।প্রাকৃতিক আইন কোনো ধরনের কোনো বিশেষ ধরনের সংস্কৃতি বা সরকারী আইন বা প্রথার ওপর নির্ভর করে না। এবং এই আইনগুলো সার্বজনীন এবং অবিচ্ছেদ্য (এই আইনগুলি কোনোদিনই কোনো আইন এর দ্বারা পরিবর্তিত হতে পারবে না, যেমনঃ কারো আইনি অধিকার ছিন্ন করা)। প্রাকৃতিক আইনের ধারণা প্রাকৃতিক অধিকারের সাথে সম্পর্কিত।
সত্যের  ব্যাপকতা অনেক। সত্য মানুষকে পথ দেখায়, সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস জোগায়,বাধার পাহাড় ডিঙাতে শক্তি দেয় আর কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর রাস্তা সুগম করে দেয়। সত্যের পথে থেকেই যেমন বহু জাতি পৃথিবী দাবড়ে বেড়িয়েছে, তেমনি সত্যের পথ থেকে দূরে সরে গিয়ে বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। সত্য থেকে দূরে সরে যাওয়া অন্যতম কারণ ব্যক্তিগত অগ্রাধিকার । যার ফলে আমরা নিজের সুবিধামতো অবস্থান বদল করতে পারছি। সত্যের মধ্যে রয়েছে শৃঙ্খলা, দায়িত্বশীলতা, সৎচরিত্র, বিশ্বাস আর নীতি। স্বাভাবিক কারণেই এগুলো খুবই কঠিন বিষয়। এগুলোকে গর্তে ঝেঁটিয়ে ফেলে দিতে সত্য আমাদের সমর্থন দেয় না। সত্য দেয় নির্মলতা আর স্পষ্টতা।
এটি সত্য যে, আমরা অভাবনীয় সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সম্মুখীন, সমাজে আজ জ্ঞানীরা পথ হারিয়ে বুদ্ধি প্রতিবন্ধীতে পরিনত হয়েছে ;আমরা রায় চাই না তবে বিচার চাই নিজের মত। আমরা ভালোবাসা চাই; কিন্তু অন্তর্মুখী হয়ে থাকি। আমরা সহনশীলতা চাই, মতপার্থক্য পছন্দ করি না। আমরা ঐক্য চাই, কিন্তু নিজের মত থাকতে পছন্দ করি। আমরা সমাধান চাই, আবার মনে করি কোনো কিছুই অকাট্য নয়। এমনকি আমরা জানি না যে, আমরা যা জানি না তা কীভাবে জানা যায়। আমরা সত্য বলতেই শুধু ভয় পাই না, সত্য শুনলে অনেক সময় তা ষড়যন্ত্র বা বেয়াদবি মনে করি। যারা সত্য বলে তাদেরকে আমরা মন্দ-রূঢ়-অভদ্র বলতে দ্বিধা করি না।
আমরা যখন সত্য গোপন করে নিজের মত করে সত্য বলার চেষ্টা করি,তখন আমরা নিজের অজান্তেই ভাবাবেগ আর অভিমতকে সত্যের ওপরে স্থান দিয়ে দেই।সমাজের একজন শিক্ষক বিশেষকরে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা উপার্চায,বিচারক বা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারি যখন এগিয়ে যাওয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে সত্যকে অধিষ্ঠিত করতে পারেন না তখন মনে করতে হবে সভ্যতার বিনাশ অবশ্যম্ভাবী।একটি সমাজের আবশ্যকীয় সম্পদ হল সত্য চর্চা।সত্য আবিষ্কারের বিষয় নয়; উদ্ঘাটনের বিষয়। সত্য তো সত্যই। সত্য আছে চোখের অদেখায়, আমাদের চারপাশে, ঠিক বায়ু-আলো-আঁধারের মতো। একে খুঁজে বের করা মানুষের কাজ, দায়িত্ব।অথচ আমরা সত্য গোপন করার জন্য বিভিন্ন রুপ ধারন করি যাতে মানুষ মিথ্যাকে সত্য মনে করতে বাধ্য হয় অথবা বিভ্রান্তিতে পড়ে।
এক সময় মনে করা হতো, পৃথিবী সমতল। যখন মানুষ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করে উদ্ঘাটন করল পৃথিবী গোলাকার, তখন তা সত্য হিসেবে মেনে নিল সবাই। যখন সমতল মনে করা হতো, তখনও পৃথিবী গোলাকারই ছিল, এ কথাও অস্বীকার করার কোনো যুক্তি নেই। কারণ সত্য সর্বকালেই সত্য।
আজ সত্য প্রায় সর্বত্র পরাজিত হচ্ছে। সত্যের ওপর নির্বিচারে নির্যাতন চলছে। নির্বিচারে যার-তার আবেগতাড়িত মতামত আর নিজ নিজ মনোভাব যথেচ্ছভাবে ছড়িয়ে দিয়ে সত্যের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে অহরহ। আবেগ আর নিজস্ব বিশ্বাস কোনো ঘটনাকে পরিবর্তন করতে পারে না।কোনো ব্যক্তি অকপটে বিশ্বাস করতে পারে না কোনো কিছু। যারা তথ্যভিত্তিক পৃথিবীর সন্ধানে, তারা কীভাবে সত্যের ওপর নির্যাতন মোকাবেলা করবে? অপরাধী মন আর চিন্তা নিয়ে সত্যকথন কখনও সম্ভব নয়। অপরাধগ্রস্ত সমাজে সত্য রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে; সমতা ঢুকতে পারে না কখনও সত্যের জগতে। ধীরে ধীরে সত্য যেন আমাদের কাছে আগন্তুকের মতো হয়ে যাচ্ছে।সত্যকথনের গুরুত্ব দিন দিন কমে যাচ্ছে। তার স্থান দখল করে নিচ্ছে হিংসা,আবেগ আর ব্যক্তিগত বিশ্বাস। সত্যকথনের চেয়ে মানুষ যেন ‘ফলাফলের যৌক্তিকতা’কে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক সুস্বাস্থ্যের জন্য যেমন সত্যকথন প্রয়োজন, তেমনি তা ধর্মীয় স্থানগুলোর জন্যও প্রয়োজন। ধর্মগ্রন্থগুলোতেও আমরা দেখি, সত্যের ওপর সব ধর্মই বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছে।
পরিশেষে, সচেতন নাগরিকেরা তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নের দাবির কারনে দেশে তথ্য অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়।এর অর্থ সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং জনগণের ক্ষমতায়ন। সংবিধান আনুযায়ী জনগণ সকল ক্ষমতার মালিক। জনগেণর এ ক্ষমতা কার্যকরভাবে প্রয়োগ এবং নজরদারি যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে তাদের সত্য তথ্য জানা আবশ্যক। কারণ তথ্যের ভিত্তিই হলো ‘সত্য’। অর্থাৎ সত্য তথ্য জানার অধিকার জনগেণর। সংবিধানে এ অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে−‘যেহেতু জনগণ প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক এবং জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য তথ্য অধিকার নিশ্চিত করা আবশ্যক।’ তাই জনগনের কাছ থেকে সত্য গোপন করার অধিকার কারোরই নেই। দেশের স্বার্থ্যে সত্য প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য । আসুন আমরা একটি উন্নত বাংলাদেশ গড়তে একসঙ্গে কাজ করি যেখানে সকলের অধিকার সম্মানিত ও সুরক্ষিত থাকে। আসুন আমরা সবাই এই ২৬ শে মার্চ ২০২৪ স্বাধীনতা দিবস থেকে সত্য প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করি।
-অধ্যাপক সরওয়ার জাহান
উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা, সাদার্ন ইউনিভার্সিটি ও টেকসই উন্নয়নকর্মী