১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতারের গান মুক্তি পিয়াসী মানুষের চেতনায় প্রাণ সঞ্চার করতো। এ গান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে পেত উদ্যম। আমাদের শিল্পীরা গানের সুরে সুরে স্ব-দেশকে ভালবাসার উর্বর ভূমিতে পরিণত করেছেন। সকল মানুষের কাছে শত-সহস্র ত্যাগের মহিমাকে অমর করে রেখেছে যে সুরগুলো, সে সুর আজও প্রাণে বাজে সকলের; ছোটদের-বড়দের-নবীনের-প্রবীণের-ধনীদের-নিঃস্বের। এখনো তুমুল জনপ্রিয় আমাদের দেশাত্ববোধক গানগুলো-যে গানগুলোর তাল-সুর-লয় সাধারণ মানুুষের জীবন থেকে নেয়া। তাই গানের সুরগুলো জীবনমুখি। আমার এদেশ সব মানুষের, সব মানুষের-এটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একটি গানের কলি। স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায় সব মানুষের গানটি গেয়েছেন। গানটি ‘ঝুমুর’ ও ‘কাহারবা’ তালে গাওয়া। বাংলা গানে ঝুমুর (দ্রুত দাদরা) এবং কাহারবা তাল বহুল প্রচলিত ও অতি জনপ্রিয়। জানা যায় ‘কাহার’ নামীয় এক উপজাতি সম্প্রদায় পালকি বহন করতো। আর পালকির তালে তালে গুনগুন করে এক ধরনের নৃত্য গীত গেয়ে বেড়াতো। ‘কাহার’ সম্প্রদায়ের গানের তাল থেকে নেয়া হয়েছে বলে এ তালের নাম হয়েছে কাহারবা। সঙ্গীতের সুর থেকে মানব চিত্ত শুধু আনন্দ কিংবা বেদনাই অনুভব করে না; উপলব্ধি করে জীবন-জগৎ, সুনীতি, মূল্যবোধ-ধর্মবোধকে। ইহা ভাব প্রকাশের মাধ্যম হিসাবেও কাজ করে; আন্দোলিত করে চিত্তকে; জাগ্রত করে চেতনাকেও। জাতিগত চেতনায় সঙ্গীত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে এর প্রমাণ বাঙালির জীবনেই সর্বাধিক। সঙ্গীত একটি সৃষ্টিধর্মী মাধ্যম। এটি একটি কলা বিশেষ। জানা যায় প্রাগৈতিহাসিক যুগেও সুর ছিল; সঙ্গীত ছিল।
মানুষ যেমন তার নিজের প্রয়োজনে ভাষা সৃষ্টি করেছে তেমনি সঙ্গীতও সৃষ্টি করেছে। আদিম মানুষ তাদের আনন্দ উল্লাস প্রকাশ করতো বিভিন্ন শব্দ, আওয়াজ বা ধ্বনির মাধ্যমে। পরবর্তীকালে সঙ্গীত শাস্ত্রবিদগণ সেই শব্দ, আওয়াজ বা ধ্বনিকে ‘নাদ’ নাম দিয়ে একে সঙ্গীতের আদি উৎস হিসেবে অভিহিত করেছেন। নাদ থেকে স্বর, স্বর থেকে সুরের উৎপত্তি। সুরের সঙ্গে কথা, তাল ও লয়ের সমন্বয়ে গীত বা সঙ্গীতের উৎপত্তি। প্রাচীনকালে সমগ্র বিশ্বের অসংখ্য জাতি ও দেশের মধ্যে সঙ্গীতের প্রচলন ছিল এবং তা বিকাশ লাভ করেছে স্ব স্ব দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মজীবনের ভেতর দিয়ে।
উপমহাদেশীয় সঙ্গীত উৎপত্তির প্রথম দিকে সামগান, নাথগীতি, চর্যাগীতি প্রভৃতি গাওয়া হতো মূলত মন্দির ও চার্চে উপাসনার মাধ্যমে। এক সময় প্রাচ্যের হিন্দু সন্ন্যাসী ও বৌদ্ধ ভিক্ষুরা রাজকীয় অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। এ রেওয়াজ পাশ্চাত্যের ধর্মযাজকদের মাঝেও চালু ছিল। অনেক প্রাণিবিজ্ঞানী মনে করেন, বিপরীত লিঙ্গের প্রাণীকে যৌনাসক্ত করার প্রচেষ্টা থেকেই সঙ্গীতের সৃষ্টি। সঙ্গীত শিল্পী গেব্রিয়েল অর্কেস্ট্রা-সঙ্গীত এবং গুক ও মোজার্ট অপেরা সঙ্গীতের যথেষ্ট উৎকর্ষ সাধন করেন। এই অপেরার মাধ্যমে রাশিয়ার সঙ্গীত নবজীবন লাভ করে।
প্রাচ্যসঙ্গীত-এর সূতিকাগার হলো আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশ। কারণ প্রাচ্যের দেশগুলো বিশেষ করে চীন, জাপান, কম্বোডিয়া প্রভৃতি দেশের সঙ্গীত সমৃদ্ধি লাভ করেছিল ভারতবর্ষের স্বরগ্রাম ব্যবহারের মাধ্যমে। সিন্ধু সভ্যতায় প্রাপ্ত প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন অবলোকন করে সিন্ধু সভ্যতাকেই উপমহাদেশীয় সঙ্গীতের প্রারম্ভিক কাল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।
পঞ্চম শতাব্দীর পরই আসে বাংলাভাষার প্রথম নিদর্শন নাথগীতি এবং চর্যাগীতি। এ থেকে উদ্ভব লৌকিক সঙ্গীত। পরবর্তীতে লৌকিক সঙ্গীত থেকেই জন্ম নেয় রাগসঙ্গীত। দ্বাদশ শতকে সঙ্গীত শৈলীর অন্যতম নিদর্শন হিসেবে আবির্ভূত হয় রাজা লক্ষণ সেনের সভাকবি জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’। এ সময় সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিশেষ করে সঙ্গীতের ক্ষেত্রে মুসলমান সম্প্রদায়ও বেশ অগ্রগামী ছিল। খাজা মঈনউদ্দিন চিশতী ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচারকালে মুরিদগণকে নিয়ে ‘সামা’ নামক গান গেয়ে খোদার প্রেমে তন্ময় হয়ে যেতেন। উপমহাদেশে বহু পীর, আউলিয়া, সুফি, দরবেশ, ফকিরদের মাজার শরীফ, হুজুরা ও খানকায় সঙ্গীত অনুশীলন করা হতো, যা এখনও প্রচলিত আছে। কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ আমীর খসরু গায়ন-শৈলীকে ভেঙ্গে সহজ-সরল রূপ দিয়ে সর্বপ্রথম ‘খেয়াল’ ‘গজল’ এবং ‘কাওয়াল’ রীতির প্রবর্তন করেন। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মুসলিম সঙ্গীতজ্ঞরা সর্বপ্রথম এ উপমহাদেশীয় সঙ্গীতকে ধর্মীয় বলয় থেকে মুক্ত করে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা চালায়। বাংলা সঙ্গীতের আরও একটি উল্লেখযোগ্য ধারা হলো কীর্তন। বড়ু চ-ীদাসের শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন শ্রীচৈতন্যের হাতে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। পরবর্তীতে ‘মঙ্গলগীতি’ ‘ধামালি’ ও ‘টপ্পা’ গানের প্রচলন শুরু হয়। রামনিধি গুপ্ত বাংলা টপ্পা রচনা করেন। উনিশ শতকের প্রথম দিকে আসে বাউল গানের যুগ। লালন ফকির, কাঙাল হরিনাথ মজুমদার, গগন হরকরা, রাধারমন, হাছন রাজা প্রমুখ মরমী সাধকদের গান বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। বাউল গানের পাশাপাশি লোকগীত, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, পল্লীগীতি প্রভৃতি মাটি ও মানুষের গানে এদেশের মানুষ তাদের শেকড়ের সন্ধান খুঁজে পায়। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনকালে রাখিবন্ধন উৎসবকে কেন্দ্র করে রচিত হলো অসংখ্য স্বদেশী গান, জেগে উঠে বাংলা গানে দেশভাবনার অনুচ্চ ইঙ্গিত, সূত্রপাত হয় স্বদেশী আন্দোলন। গিরিশচন্দ্র, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ বাংলা নাটকে ব্যবহার করতে থাকেন সমসাময়িক কালের চাহিদা অনুযায়ী প্রাণবন্ত বাংলা গান। এছাড়া ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বাংলা গানের পরিপূর্ণ রূপ লাভ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্র-রজনী,অতুল প্রসাদ এবং কাজী নজরুল ইসলাম-এর মাধ্যমে।
সুর এবং সঙ্গীত মানুষের মনন সংস্কৃতির একটি উপাদান। মানব জীবন ও সংস্কৃতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ‘সংস্কৃতি’ মানব জীবনে সমৃদ্ধি আনে। সংস্কৃতিই মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে এবং সংস্কৃতিবোধের কারণে একটি মানব সমাজ অন্য যেকোনো সমাজ থেকে নিজেকে পৃথক ভাবতে শিখে, জাতি হিসেবে ঐক্যবদ্ধ হতে সহায়তা করে। বিশ্বের অপরাপর মানুষের ন্যায় বাংলাদেশে বসবাসকারী মানুষেরও রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি। প্রাচীনকাল থেকে রূপান্তরের ধারাবাহিকতায় পারস্পরিক গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে নানা ধর্ম-বর্ণ, গোত্র-সম্প্রদায় ও নৃ-গোষ্ঠীর সংস্কৃতির মিশ্রণে বাংলাদেশের মানুষের নিজস্ব সংস্কৃতি পরিপূর্ণতা পেয়েছে। এই সাংস্কৃতিক চেতনাই ১৯৫২ সালে বাঙালিকে শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে প্রেরণা যুগিয়েছিলো। তাই সাংস্কৃতিক চেতনা বাংলাদেশের মানুষের জাতীয় চেতনার অন্যতম উপাদান। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনা প্রমাণ করে-এদেশের রাষ্ট্র চিন্তা সংস্কৃতি প্রভাবিত।
এদেশের ভৌগোলিক সীমানায় বসবাসকারী জনগণের জীবনযাত্রা, জীবনমান, চিন্তাধারা, অভ্যাস, রীতি-নীতি, ক্রিয়াকলাপ, আচার-প্রথা ইত্যাদির মধ্যে একটি বিশেষ সাংস্কৃতিক পরিচয় খুঁজে পাওয়া যায়। এ সমাজের প্রতিটি মানুষের চিন্তা-চেতনা, আচার-অনুষ্ঠান, পোষাক-পরিচ্ছদ, মূল্যবোধ, জীবন দর্শন ও শিল্পকলা অন্য যেকোনো জনসমাজ থেকে বৈচিত্র্যপূর্ণ। প্রত্যেক সমাজে বসবাসকারী মানুষের জীবন যাপন প্রণালীতে একটা স্বাতন্ত্র্যবোধ থাকে; বাংলাদেশের জনসমাজে বসবাসকারী মানুষের জীবন যাপন প্রণালীতেও আছে। এ স্বাতন্ত্র জীবনধারা বা জীবন প্রণালীই বাংলাদেশি সংস্কৃতি হিসেবে আখ্যায়িত। বাংলাদেশের নাগরিকদের জাতিগত পরিচয় নির্মাণের মৌলিক উপাদান হিসেবে সাংস্কৃতিক চেতনাবোধ বিশাল ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশে বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বসবাস করলেও তাদের আলাদা ভাষা থাকলেও এরা সকলে বাংলা ভাষা বুঝে। তাই বাংলা ভাষা-সাহিত্য; ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য, একই উৎপাদন ব্যবস্থা ও একই সামাজিক মূল্যবোধগত ঐক্যই বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতির মূল সুর। জাতি-ধর্ম-শ্রেণী নির্বিশেষে আমরা সকলেই সমভাবে বাংলাদেশের নাগরিক। দেশের নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকেরই সমান অধিকার রয়েছে এবং মানুষ হিসেবে প্রত্যেকেরই রয়েছে সমান মানবাধিকার।
ইংরেজ শাসনামলে শোষণ-বৈষম্য ও জুলুম নির্যাতন ভোগ করতে হয় এ অঞ্চলের জনসাধারণকেই সর্বাধিক। এ সময়ই তারা ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও অধিকারবোধের সংস্পর্শে এসে জাতি চেতনাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। তাই ইংরেজবিরোধী আন্দোলনেও এ অঞ্চলের মানুষের ভূমিকা সর্বাধিক। ইংরেজবিরোধী আন্দোলনের পথ ধরে ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। বাংলাদেশ পশ্চিম পাকিস্তানের অংশ হিসেবে প্রথমবার স্বাধীনতা পেলেও তা প্রকৃত স্বাধীনতা ছিল না। ৪৭ পরবর্তী সময়ে ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং ভৌগোলিক দিক থেকে এদেশ পরিণত হয় কায়েমী স্বার্থবাদীদের লুণ্ঠনের উর্বর ক্ষেত্রে। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বুঝতে চেষ্ঠা করেনি যে, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিক ঐক্য উপেক্ষা করে রাজনৈতিক ঐক্য সম্ভবপর নয়। তাঁরা জাতিগত নিপীড়ন, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং রাজনৈতিক অধিকার হরণের মধ্যদিয়ে নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে চাইলেন। পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক শাসক গোষ্ঠী কর্তৃক প্রথম যে আঘাতটা আসে, তা বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর। ফলে সে আঘাত প্রতিহতের অস্ত্রটাও ছিল সাংস্কৃতিক। ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনা। আত্মরক্ষার প্রচ- তাগিদ থেকে, নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকেই প্রতিবাদের অস্ত্র হিসেবে ধারণ করে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর নিত্য ব্যবহার্য খাম, ডাকটিকেট, রেলগাড়ির টিকেট ও বিভিন্ন ধরনের ফরম প্রভৃতিতে ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় প্রয়োজীয় কথা লেখা থাকতো। বাংলা ভাষার কোনো গুরুত্ব না থাকায় পূর্ব বাংলার শিক্ষিত ও সচেতন মহল বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। অবশ্য বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রটি শুরু হয় ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কিছুদিন আগে থেকে। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভি. সি. জিয়াউদ্দীন আহম্মদ দাবি করেন যদি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা উর্দু হবে। তাঁর এ অমূলক বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। প্রতিবাদ আসে ১৯৪৭ সালের ২৯ জুলাই ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি যুক্তিপূর্ণ প্রবন্ধের মধ্যদিয়ে। অবশ্য ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর গঠিত সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘তমুদ্দুন মজলিশ’ই প্রথম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিকে সভা, সমাবেশ, মিছিল ও বিক্ষোভের মাধ্যমে আন্দোলনে পরিণত করে। বিশেষ করে ১৯৪৭ সালের ২৭ নভেম্বর পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ গৃহীত হওয়ার মধ্যদিয়ে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির পুরোপুরি বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ রেস্কোর্স ময়দানে ভাষণ দানকালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ বলেছেন, আমি সুস্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই যে, ‘উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইবে,… পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইবে উর্দু, …।’ তিনি পুনরায় ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে ছাত্রদের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ভাষণদানকালে ‘একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ ব্যক্ত করার সাথে সাথে উপস্থিত ছাত্রদের মধ্যে ‘নো’ ‘নো’ বলে প্রবল প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়। ঢাকা ত্যাগ করার আগে ২৮ মার্চ জিন্নাহ তাঁর রেডিও ভাষণে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে বহাল করার পুনরুক্তি করেন। এছাড়া ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দীন এক জনসভায় ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ বলে ঘোষণা করলে, আবার শুরু হয় প্রদেশব্যাপী হরতাল, ধর্মঘট ও ছাত্র বিক্ষোভ। ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি তারিখে ঢাকা বার লাইব্রেরি মিলনায়তনে মাওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। উক্ত পরিষদের প্রথম বৈঠকে ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আর এই ২১ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচিকে বানচাল করতে সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে একমাসের জন্য ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে। তারপরও ২১শে ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের শপথ নিয়ে প্রতিবাদ মিছিল শুরু করে। এ সময় পুলিশ ও সেনাবাহিনী নির্বিচারে গুলি চালায় মিছিলের ওপর। হতাহত হয় বহু ছাত্র জনতা। শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিকসহ আরো অনেকে। এ হত্যাকা-ের প্রতিবাদে প্রথম কবিতা লিখে জাতীয় চেতনার মর্মমূলে যিনি স্পর্শ করেছেন, তিনি হলেন কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী। ২৩ ফেব্রুয়ারি লালদীঘির ময়দানের জনসভায় ‘আমি কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ নামে তাঁর কবিতাটি পাঠ করে শোনালে জনতা খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়ে এবং শ্লোগান ওঠে ‘চল চল ঢাকা চল’। উক্ত কবিতায় কবি আরো বলেছেন, যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে/ একটি দেশের মহান সংস্কৃিতর মর্যাদার জন্য/আলাওলের ঐতিহ্য/কায়কোবাদ, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য ও কবিতার জন্য। প্রথম শহীদ মিনার পুলিশ কর্তৃক ধ্বংস করা হলে আলাউদ্দিন আল আজাদের লেখনীতে আসেÑস্মৃতির মিনার ভেঙ্গেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু,আমরা এখনো/চারকোটি পরিবার/খাড়া রয়েছি তো। ছাত্র হত্যা ও পুলিশী নির্যাতনের প্রথম ছাপচিত্র এঁকে প্রতিবাদ করেছিলেন চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর। এছাড়া বাংলা ভাষায় রচিত আবদুল গাফ্ফার চৌধুুরীর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি’ গানটি একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনকে প্রাণবন্ত করেছে। এতে সহজেই প্রমাণিত হয়, এই ভাষা আন্দোলন সাংস্কৃতিক কর্মীদের প্রাণ সঞ্চার করেছিলো। এই ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই বাংলা ভাষায় রচিত হয়েছে অসংখ্য গান, কবিতা; লিখিত হয়েছে গল্প উপন্যাস। সাংস্কৃতিক চেতনাবোধ থেকে ভাষা আন্দোলনের শুরু হয়। এটি পর্যায়ে রাজনৈতিক চেতনায় পরিণতি লাভ করে। ভাষা আন্দোলনই এ জাতির সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক চেতনা একসূত্রে গেঁথে দিয়েছিলো। এই সাংস্কৃতিক চেতনার ঢেউ ১৯৫৪ সালের নির্বাচনকে প্রভাবিত করে। পথ তৈরি হয়েছে পরবর্তী সকল সফল গণ-আন্দোলনের, যেপথে ১৯৭১ সালে জন্মলাভ করেছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। সাংস্কৃতিক চেতনার বাংলাদেশই আজ সকল মানুষের দেশ।
ড. মোহাম্মদ সফিউল্লাহ্ মীর,
সহকারী রেজিস্ট্রার, সাদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।
mirshafiullah@gmail.com