মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন তরুণরাই গড়ে তুলবে শোষণ-বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ

0
1499

সকল অন্যায়-অবিচার, অনিয়ম-বৈষম্য, অশুভ-অসুন্দরের বিরুদ্ধে এবং দেশ মাতৃকার সকল সংকটময় মুহূর্তে বারবার গর্জে উঠেছে তরুণ-যুবকরা। বাংলাদেশ সৃষ্টির অনেক আগে থেকেই এ ভূ-খন্ডের তারুণ-যুবকরাই পথ দেখিয়েছে সাধারণ মানুষকে। বারবার রাজপথে ঢেলে দিয়েছে বুকের তাজা রক্ত, উৎসর্গ করেছে প্রাণ। দেশের সকল রাজনৈতিক সংকটে সোচ্চার ভূমিকা রেখে চলেছে তরুণ-যুবকরা।
বাঙালি জাতির গৌরবময় ও ঐতিহ্যবাহী সকল আন্দোলনেরই মূল শক্তি ছিল এই উপমহাদেশের তরুণ-তরুণীরা। তারা ঐক্যবদ্ধও ছিল। নানা প্রশ্নে তাদের মধ্যে মতানৈক্য থাকলেও জাতীয় স্বার্থে সকলেই ছিল এক কাতারে-ঐক্যবদ্ধ। তরুণরাই জানে সকল অসুন্দরকে ভেঙে নতুন করে গড়তে। তারুণ্য এমন এক শক্তি যার বিরুদ্ধে কখনো কোন শক্তি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে টিকতে পারে না। তারুণ্য যেমন গড়তে জানে তেমনি মহাপ্রলয়ের রূপ নিয়ে ধ্বংস করে দিতে পারে অনিয়মের সকল শৃংখল, সকল অসুন্দরকে। এই তারুণ্যই জাতিকে সঠিক দিক-নির্দেশনা দিয়ে সত্য-ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করার গুরুদায়িত্বটিও পালন করে আসছে। ভাষা আন্দোলন, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ- বিশেষ করে বাঙালি জাতিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সকল আন্দোলন-সংগ্রামে এই তরুণরাই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। তারা দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনে যেমন অবদান রেখেছে তেমনি সাংস্কৃতিক, সামাজিক আন্দোলনে, জাতির মননে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদের দীর্ঘ শাসনামলে অতি গৌরবদীপ্ত আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তুলে ঐতিহাসিক বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল তরুণ-যুবকরাই। পাকিস্তানী শোষকগোষ্ঠীর লাল চোখ উপেক্ষা করে বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করতেই ৫২’তে তরুণেরা দুর্বার সাহস নিয়ে পাকিস্তানীদের বুলেটের সামনে পেতে দিয়েছিল বুক। ভাষার জন্য রক্তদানের ইতিহাস রচনা করেছিল এ অঞ্চলের তরুণ-যুবকেরা। ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ৬ দফা আন্দোলন, ’৬৯ এর গণঅভ্যূত্থান, স্বাধীনতা সংগ্রাম, ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ, ৯০’র স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, সর্বশেষ ২০১৩ সালের মানবতা বিরোধী অপরাধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার আন্দোলন কোথায় নেই তরুণ-যুবকদের ঐতিহাসিক ভূমিকা। শত বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও তরুণ্যের জয় রুখবে এমন সাধ্য কার ? যুগে-যুগে অত্যাচারীদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তরুণরা শুধু তাদের বিষদাঁত উপড়ে ফেলেনি বরং এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে যা স্মরণ করে পরবর্তীতে অনেক শাসক অন্যায় করার সাহস পায়নি।
তারুণ্যের পিঠে চেপেই ১৯৭১ সালে জন্ম হয়েছিল একটি স্বাধীন দেশের, নাম বাংলাদেশ। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় এ দেশের মানুষকে স্বাধীনতার মুখ দেখাতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে নেতৃত্ব দেয়া শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কমরেড মনি সিংহ, মোহাম্মদ ফরহাদসহ অনেকের যোগ্য এবং দক্ষ নেতৃত্বকে আদর্শ হিসেবে সামনে রেখেই লড়ে গেছেন বাঙালি তরুণ প্রজন্ম। যার পরিপ্রেক্ষিতে আজ আমরা নিজেদের মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলতে পারছি। গর্ব করে উচ্চারণ করতে পারছি, আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন নাগরিক। অর্থাৎ বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই তারুণ্যের গুরুত্বপূর্ণ অবদান অব্যাহত ছিল। আর সেই একই ধারা যে বর্তমানে ম্লান হয়ে গেছে তা বলাটা ঠিক হবে না। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কাজ করে চলেছে আজকের তরুণ প্রজন্ম।
নিরক্ষরতামুক্ত বাংলাদেশ গড়তে দেশের তরুণ-যুবকরা স্বপ্রনোদিত হয়ে দল বেঁধে পথশিশুদের নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় স্কুল পরিচালনা করছে। অভুক্ত শিশুরা যেন জীবিকার সন্ধান করতে গিয়ে স্কুলে পড়তে আসা বন্ধ না করে দেয়, সেজন্য নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে ব্যবস্থা করছে খাবারেরও। পাশাপাশি বিনা পয়সায় দরিদ্রদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের ব্যবস্থা, বন্যা এবং দুর্যোগে অসহায়দের সহায়তায় এগিয়ে আসা, রক্তদান ক্যাম্প, শীতের সময় বস্ত্র বিতরণসহ নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করছে দেশের তরুণ-যুবকরা। এই তরুণরাই ২০১৩ সালে গড়ে তুলেছিল ‘গণজাগরণ মঞ্চ’। অসংগঠিত তরুণ-যুবকদের আহবানে গঠিত গণজাগরণ মঞ্চ পুরো বাংলাদেশেই এর জাগরণের জ্যোতি ছড়িয়ে দিয়েছিল। তারুণ্য প্রতিবাদের মাধ্যমে জানিয়েছিল- যে রাজনীতি চলছে তা জীর্ণ, ব্যর্থ। এই গণজাগরণ মঞ্চ ছিল সাধারণ তরুণদের মঞ্চ।
তবে এখন প্রশ্ন আসতে পারে চরম অবক্ষয়ের এ সময়ে, মাদকের আগ্রাসন, মানবিক মূল্যবোধহীনতার চর্চা, আদর্শচ্যুত এ সমাজে তরুণ-যুবকদের ঐতিহাসিক ভূমিকা বর্তমানে কতটুকু প্রাসঙ্গিক। তারুণ্যের একটা বড় শক্তি ঘুমিয়ে রয়েছে। ক্ষুদ্র একটি অংশ একটি অপরাধ কর্মকান্ডে জড়িত আরেকটি অংশ অন্যায়ের প্রতিবাদে সরব সকল অশুভর বিরুদ্ধে সত্য-ন্যায়ের ঝান্ডা উর্ধ্বে তুলে ধরতে সোচ্চার। এটি একদিনে হয়নি। দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা এই অবস্থা এখন সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘুমন্ত তারুণ্যকে জাগ্রত করা এবং তারুণ্যের প্রতিবাদী শক্তিকে কাজে লাগিয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা জরুরি।
সংগঠিত তারুণ্যের শক্তি একটি দেশের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে। তারাই সমাজের বৃহৎ অংশ। একটি সুখী সমৃদ্ধ দেশ গঠনে দৃঢ় ও দৃপ্ত এই শক্তিই প্রধান হাতিয়ার। তারুণ্যের জাগরণ, তারুণ্যের উত্থান, তারুণ্যের জাতীয় ঐক্যই হল বাঙালি জাতির সার্বিক উন্নয়নের একমাত্র মাধ্যম। তাদের সচেতন, দায়িত্বশীল, ইতিহাসনিষ্ঠ, দলীয় সংকীর্ণতামুক্ত অবস্থানের উপরই নির্ভর করে আমাদের জাতীয় অগ্রগতি। গণস্বার্থ সংরক্ষক, সভ্য ও রুচিশীল মানবিক মূল্যবোধের দেশ গড়তে তরুণ-যুবকরা স্বপ্ন দেখবেন ও দেখাবেন। আমরা চাই, মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন চিন্তাশীল উদ্যমী তারুণ্যের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই গড়ে উঠুক মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে শোষণ-বৈষম্যমুক্ত সুখী-সুন্দর আগামীর বাংলাদেশ।
সমাজের নানা অসঙ্গতি, সহিংসতা এবং জঙ্গিবাদকে তারুণ্যের শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করতে হবে, প্রতিহত করতে হবে। তারুণ্যের শক্তি দিয়ে জাতিকে কন্টকমুক্ত করতে হবে, জঙ্গিমুক্ত করতে হবে দেশকে। তারুণ্যের অদম্য শক্তিকে কাজে লাগিয়ে গড়তে হবে শঙ্কামুক্ত, নিরাপদ ও সুন্দর আগামী। বিপ্লবী কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের লেখা ‘ছাড়পত্র’-এর সেই গুরুদায়িত্বই আমাদের কাঁধে তুলে নিতে হবে। ‘এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান, জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তুপ-পিঠে/ চলে যেতে হবে আমাদের। চলে যাব-তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ/ প্রাণপনে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল, এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি- নব জাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’ অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ গড়ে তোলার শপথ নিয়ে দেশের তরুণ সমাজ সামনের দিকে প্রসারিত হোক, এগিয়ে চলুক দৃপ্ত পদক্ষেপে।
প্রীতম দাশ : সাংবাদিক, ভোরের কাগজ।
pritom_bsu@yahoo.com