আকাশ জুড়ে আলোর কুসুম ফুটছে মুহুর্মুহু। বাজির শব্দ মনের ভেতর তীরের মতো ছুটছে। সন্ধ্যার অন্ধকারে মানুষের হƒদয়কে আলোকিত করে গ্রামীণ জনপদে এক আনন্দধারা বইয়ে দিতো ‘বাজি পোড়ানোর মেলা’। পশ্চিম পটিয়ার চরকানাই গ্রামের বিখ্যাত সেই মেলা কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।
পশ্চিম পটিয়ার চরকানাই গ্রামের শাহ মুন্সির হাট। বিভিন্ন গ্রাম থেকে এঁকে বেঁকে অনেকগুলো রাস্তা এই হাটে এসে মিশেছে। চারপাশে ছিল বিশাল বিল। শীতকালে ধানকাটা হয়ে গেলে দিগন্ত বিস্তৃত সেই বিলটিতেই জমতো বাজি পোড়ানোর মেলা। আর এই মেলা এলেই আনন্দ, ভয়, রোমাঞ্চ মিলিয়ে এক অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া হতো আমাদের ভেতর। সারা বছর এই মেলার জন্য অপেক্ষা করতাম। মেলা দুই-তিনদিন ধরে চলতো। সারাদিন শত শত দোকানে নানা রকমের পণ্য বেচাকেনা হতো। নাগরদোলা, যাত্রা, সার্কাস এসবতো ছিলই। কিন্তু এই মেলার একটা বিশেষ দিক ছিল। সন্ধ্যা হলে চারদিক যখন অন্ধকারে ছেয়ে যেত তখনই জ্বলে উঠত বাজির আলো। বিচিত্র সব বাজি। কোন বাজি আকাশে আলোর ফুল ফোটাচ্ছে। কিছু বাজি রকেটের মতো উপরে উঠে প্রচন্ড শব্দে বিষ্ফোরিত হতো। কোনটা অনেকক্ষণ আলোর ফুলকি ছড়িয়ে ফুটিয়ে তুলতো বড় বড় মনিষীর ছবি। আগুনের গোলার ভেতর থেকে কী করে মানুষের ছবি ভেসে আসতো সে এক আশ্চর্য ব্যাপার ছিল গ্রামের মানুষের কাছে। আলোর সেই শিল্পীত রূপ দেখে হাজার হাজার মানুষ তুমুল করতালি আর হর্ষধ্বনিতে মাতিয়ে রাখতো পুরো এলাাকা। আলোর খেলা দেখে বিস্ময়ে আনন্দে ঘরে ফিরত মানুষ। আর আরো একটা বছর অপেক্ষা করতো পরের বছরের মেলার জন্য। এখন আর সেই অপেক্ষা কেউ আর করে না। চট্টগ্রামের অনেক মেলার মতো এটিও হারিয়ে গেছে।
আমাদের চেনাজানা চারপাশের সবকিছু প্রতিদিন একটু একটু করে বদলায়। বারো মাসে তেরো পার্বণের এই বাংলার মুখের আদলও পাল্টে গেছে অনেক। গত কয়েক দশকে আমরা বহু নাগরিক মেলার সাথে যুক্ত হয়েছি। বইমেলা, বিজয়মেলা, কম্পিউটার মেলা, ল্যাপটপ মেলা, আবাসন মেলা, বাণিজ্যমেলা, শিল্পমেলা, একুশে মেলা, বস্ত্রমেলা নাট্যমেলা, তাঁতমেলা, স্বাধীনতার মেলা এরকম আরো কত কী। কিন্তু আমাদের সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ গ্রামীণ মেলাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে বা ক্রমে জৌলুস হারিয়ে ফেলছে। গ্রামের মেলার সবচেয়ে সুবিধার দিক ছিল মেলার আঙিনাকে ঘটা করে সাজাতে হত না। প্রকৃতি নিজেই একে সাজানোর দায়িত্ব নিত। এই সাজ বহু বিচিত্র। একেক ঋতুতে একেক রকমের সাজ। গ্রামের মানুষের অন্তরে যে সৌন্দর্য বোধ আছে আর মানুষে মানুষে যে মিলনেকাক্সক্ষা আছে তাই প্রকাশ পেত মেলায়। এই মেলাকে তাই সে নিজের মতো সাজাতো। আমাদের গ্রামীণ জনপদের মানুষের অন্তরের শিল্পবোধ প্রকাশ ঘটত মেলার মাধ্যমেই। তাই মেলায় আমরা দেখি গ্রামের যত রকমের চারু ও কারু শিল্পের আয়োজন। বলতে গেলে বৃহত্তর গ্রামীণ সমাজের একমাত্র জৌলুস ছিল এই মেলা। মেলা মানেই নানা শিল্পের সমাহার। মেলা মানেই যাত্রা, সার্কাস, খেলনাপাতি, মিঠাই মন্ডা, আরো কত কী। নববর্ষ বা বৈশাখ এলেই এই মেলা জমতো বেশি করে।
চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানের বারুণী স্নান মেলা, রাউজানের মহামুনি মেলায় মিলন ঘটতো নানা এলাকার মানুষের, তেমনি করে সীতাকুন্ডের আদিনাথ মেলা, শিবচতুর্দশী মেলা, পটিয়ার ক্ষেত্রপাল মেলা, চৈত্র সংক্রান্তি, বাঁশখালীর কুম্ভ মেলা, বৈশাখী মেলা, সূর্যখোলা মেলা, বকশী মিয়ার বলিখেলার কথা আজো প্রবীন মানুষের মুখে। এছাড়াও বিভিন্ন পূজা পার্বন, ওরশ শরীফ, মহরম ও ঈদ উপলক্ষেও মেলা হতো। দিন বদলের সাথে সাথে সেইসব মেলা হারিয়ে ফেলেছে তার আসল চেহারা। এইসব মেলার ছিল আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য। কোন মেলা বিশিষ্ট ছিল পালাগানের জন্য, কোনটা যাত্রার জন্য, কোথাও চলতো কবিয়ালদের লড়াই, গরু মহিষের লড়াই হতো কোন মেলায়, মোরগের লড়াই চলতো কোথাও কোথাও, এসবের মধ্যে উত্তেজনার বলী খেলা ছিল খুব জনপ্রিয়।
মাল্টি স্টোর, মেগা মার্কেট, শপিং কমপ্লেক্স এর এই যুগের তরুণরা ভাবতেই পারবে না তখনকার যুগের মানুষরা এইসব মেলায় বিকিকিনির জন্য সারাবছর অপেক্ষা করত। সংসারের যাবতীয় প্রয়োজনীয় পণ্যগুলো বেশির ভাগ মানুষ মেলা থেকেই কিনত। একেকটা মেলা এক একটা পণ্যের জন্য বিখ্যাত ছিল। ছোটদের সবচেয়ে প্রিয় ছিল মেলাগুলো। এখন যেমন হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় নানা ইলেট্রনিক্স খেলনা। আগের দিনেতো তা ছিল না। তখন মেলার খেলনাপাতিই ছিল ছোটদের প্রধান আকর্ষণ। প্রায় প্রতিটি মেলায় পাওয়া যেত তালপাতার সেপাই, টমটম গাড়ি, মাটির পুতুল, ঘুড়ি, বেলুন।
শত বছরের পুরোনো চট্টগ্রাম শহরের জব্বারের বলী খেলার মেলা আজো তার ঔজ্জ্বল্য ধরে রেখেছে। এই মেলা এখন শুধু চট্টগ্রামের নয়, সারা দেশের এক ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে তরুণদের উদ্দীপ্ত করার জন্য ১৯০৯ সালে বদর পাতি এলাকার বাসিন্দা আবদুল জব্বার এই মেলা চালু করেন। আজো চলছে। প্রতিবছর ১২ বৈশাখ চট্টগ্রামের লালদীঘির পাড়ে এই মেলা হয়। সারা দেশ থেকে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের নানা পণ্যের পসরা বসে এই মেলায়।
আামদের বাজি পোড়ানোর মেলা থেকে প্রতিবছর বাঁশি কিনতাম। বাঁশিতে ফু দিয়ে সুর তোলার চেষ্টায় সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখতাম। একসময় বাঁশিটি পুরোনো হতো। আমি আবার অপেক্ষায় থাকতাম কবে মেলা বসবে। নতুন বাঁশি কিনব। এখন আর অপেক্ষায় কাজ হয় না। বাজি পোড়ানোর মেলাও শেষ। আমার বাঁিশ বাজানোর দিনও শেষ। সেই বাঁশি বাজানোর দিনগুলো, সেই মেলাগুলো সত্যিই সুন্দর ছিল।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক, প্রথম আলো।