স্বাধীনতার প্রথম প্রহর: তখন আমি গলির মুখে

0
707

স্বাধীনতার প্রথম প্রহর: তখন আমি গলির মুখে

সম্ভবত: সকাল ৮টা; প্রায় প্রতিতিনের মত গলির মুখে দাড়িয়ে ছিলাম অনেকখন। দাড়িয়ে থাকাটা প্রতিদিনের কাজের একটা অংশ বলা চলে ।আর এই দাড়িয়ে থেকে স্বাধীনতার প্রথম প্রহর দেখা এবং এই সংবাদ দেওয়ার মত চমৎকার আর কি হতে পারে?  সকাল-দুপুর-বিকেল, যখন দাড়াতাম, একটানা ২/৩ ঘন্টাতো বটেই ।খুব কম সময়ই ছিল অল্প সময়ের জন্য দাঁড়াতাম । অবশ্য সন্ধা বা রাতে কখনও দাঁড়াতাম না । লক্ষ্ উদ্দেশ্য ছাড়াই দাঁড়িয়ে থাকতাম । হরেক রকম মানুষের চলার পথ । কত রকমের যান চলাচল । কত মানুষের কত রকম কথা, কতধরণের যে শব্দ । এখনকার মত এত যান চলাচল ছিল না তখন, এত মানুষও ছিল না । এমনও সময় ছিল রাস্তায় কোন বাহনই দেখা যেত না । মাঝে মাঝে ব্যক্তি মালিকাধিন গাড়ী দেখে খুবই পুলকিত হতাম । কারন রিক্সা, গরুর গাড়ী, ঠেলার গাড়ি, এই ছিল মোটামুটি সচল যান-বাহন । বাকী সব ছিল ।অনেকটা আচমকা! এই দেখলাম আবার ১০/১৫ মিনিট পর হয়ত অরেকটা আসতো ।

দলে দলে স্কুলের মেয়েরা ঝিকে অনুসরন করে সারিবদ্বভাবে হাঁটাটা এখনও মনে আছে । ঝি-এর কাঁধে বা হাতে একটি কালো ছাতা নিয়ে দাপটের সাথে এক পাল মেয়েদেরকে স্কুলে পৈাঁছে দেওয়া , আবার বাড়ী উদ্দেশ্যে পথ চলা । মেয়েদের মধ্যে কেউ বা বাহিরের কেউ কোন বাজে আচরন করলে তার উচিৎ শিক্ষা এই দাপটে মহিলা দিতে জানে । গলির উত্তর পাশটা কেন জানি দাঁড়ানোর সুবিধে ছিলনা । তবে, আমি সবসময়ই ডান র্প্বা্শে বা গলির দক্ষিনেই দাঁড়াতাম । গলির উত্তর পাশে ছিল একটা পান দোকান কোন সময় খোলে আবার কোন সময়ে বন্ধ থাকে । দক্ষিনে ছিল একটি মুদি দোকান ।

গলির মুখে দাড়িয়ে থাকার সব স্মৃতি মনে নেই; তবে বিশেষ বিশেষ কিছু ঘটনা এখনো মনে আছে । গলির মুখেই ছিল চট্টগ্রামের শাহী জামে মমজিদের পিছনের অংশ, পাশে ছিল এম.ই.এস স্কুল আর সন্ধায় ছিল এম.ই.এস কলেজ এবং ল’ কলেজ । দিনের চেয়ে মাঝে মাঝে সন্ধ্যায়ই থাকতো লোকে লোকারন্য ।

এই গলির মুখে দাড়িয়েই আমি দেখেছি কত আর্তনাদ; কত রং কত তামাশা, কত মজার মজার দৃশ্য । যা বাসায় এসে কিছু শব্দ বা দৃশ্য সংযোজন-বিয়োজন করে আমারি অনুকুলে গল্প সাজাতাম ।অনেক দৃশ্যাবলীর মধ্যে ছিল যুদ্বের আগের কিছু স্মৃতি, মশাল মিছিল, আন্দোলনের মিছিল,  একবিকেলে দেখি, স্কুল মাঠে কে বা কাহারা জনসভা ডেকেছে, উৎসুক দশকের মত গলির র্পাশ্বে আমিও হাজির । প্রচুর লোকসমাগম আর প্রচুর পুলিশও ছিল। আর তা ছিল যুদ্বের আগে । যুদ্বেরসময় জমজমাট গলির মুখের মুদি দোকানটি আগের মত খোলা দেখা যায় না, যখনখোলে একজন মানুষ  কোনরকম ঢুকতে বেরুতে পারে । চোখেমুখে শংকা, বিরক্তির ভাব লক্ষ করা যেত। একবার এক ট্রাকর্ভতি সেনাবাহীনীর গাড়ী বিকল হয়ে ছিল।সেকি ব্যস্ততা তাদের, সবাইকে তাড়িয়ে রাস্তা ফাঁকা করে দিল। আর এর্ই মধ্যে বেজে উঠলো যুদ্বের দামামা । যুদ্বের সময় আমার বয়স বেশী ছিলনা; ১২/১৩ বৎসর মাত্র । তবে যুদ্বের অনেক কিছুই মনে আছে ।

যুদ্বের সার্বিক ভয়াবহতা যখন চরমে, আমার মনও দোলা দিয়ে উটলো যুদ্বের দামামায় । পাড়ার বড় ভা্ইয়েরা প্রতিহিংসার আগুনে টগবগ করছে বিভিন্ন কলাকৌশল নিয়ে; তোড়জোড় চলছে কিভিাবে কি করা যায়। ৭ই র্মাচ-এর জ্বালাময়ী ভাষণের তেজ তরুনদেরকে ধরে রাখে কে? আমিও ব্যতিক্রম ছিলাম না । পাড়ার বড় ভা্ইয়েরা যুদ্বের প্রশিক্ষনের তোড়জোড় করছে । আর এ্ই দৃশ্য দেখার জন্য আমার মধ্যে চলছে ব্যকুলতা । আর  এ্ই ব্যকুলতা ধরে রাখে কে । বড় ভাইদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বাচ্চু ভা্ই । এলাকার প্রায় সকল সামাজিক কাযর্ক্রম  তিনিই দেখতেন । অনেকের নাম মনে নেই । আবার অনেকের নাম মনে আছে তবে সক্রিয়তার কথা মনে নেই । যেমন বর্তমান মেয়রের ভা্ই সাহাবুদ্দিন, আলী আশরাফ, ইকবাল , কুরবান আলী, ইত্যাদি। আমার সাথে আমার পরিচয়ের মধ্যে আমার ক্লাস বন্ধু ডা: আব্বাস উদ্দিনের ছোট ছেলে ওয়াসিম ছিল অন্যতম ।বর্তমানে আমেরিকায় বসবাস করছে । যতদুর মনে পড়ে প্রতিদিন দুইবার যুদ্বের প্রশিক্ষন চলতো, সকাল ১০/১১টা আর বিকেল ৩/৪টার দিকে । বড় ভা্ইদের অনুপ্রেরনায় সমবয়সী কয়েকজনের নাম অর্ন্তভুক্তি করে দিলাম । বেশ কয়েকদিন প্রশিক্ষনও নিলাম, আমার ব্যকুলতা দেখে বাবা অস্থির হয়ে গেলেন ।

যুদ্বের ভয়াবহতা, প্রশিক্ষনে আমার সক্রিয়তা আর পারিবারিক নিরাপত্তা বিধান ছাড়াও ব্যবসার দিকে নজর দেওয়া বাবার একার পক্ষে বেশ কঠিন ছিল । বাবা সিদ্বান্ত নিলেন পরিবারের সদস্যরা দুইভাগে ভাগ হয়ে যাবে । এক অংশ চট্টগ্রামে থাকবে অন্য অংশ গ্রামের বাড়ী চলে যাবে । তখন তিন ভাই এক বোনের পরিবার আমাদের । আমি বড় ভাই আর ছোট মামা গ্রামের উদ্দেশ্যে সকাল ৬টার দিকে রিক্সা করে রওনা হলাম । পাক বাহীনীর হাতে প্রথম বাধা পেলাম পাহাড়তলীতে, রিক্সা থামিয়ে কি কি জিগ্গেস করেলো আমরা কেউ বুঝলাম না, অবশ্য রিক্সাওয়ালা মামাকে বুঝিয়ে দিল মামা কি যেন বল্লেন আর আমরা ছাড়া পেলাম ।রাস্তায় তেমন কোন গাড়ী ছিলনা, তবে রিক্সা চলাচল ছিল চোখে পড়ার মত। এছাড়াও রাস্তার দু্ই পাশেই ছিল সারি সারি মানুষ । রিক্সা করে কিছুদুর যাওয়ার পর রিক্সাওয়ালা অপারগতা প্রকাশ করলো, এাবার শুরু হলো পায়ে চলা । প্রায় ২/৩ ঘন্টা পায়ে হাঁটার পর অনেক কষ্টে একটি বাসে আমরা ঠাঁই পেলাম ২০/৩০ মিনিট  বাসে চলার পর শুরু হলো আবার পায়ে হাঁটার; এবার নদী পার হতে হবে ।

চট্টগ্রামের লোকেরা ফেণী-নোয়াখালী লোকদেরকে সাধারনত: বানভাসা মানুষ হিসেব্ই ঢাকে, আমার মাও বলতেন, বৃষ্টি-বাদলের দিনে দাদার বাড়ী থেকে মা নৌকায় করে নানার বাড়ী যেতন । আর শুকনো মৌসুমে যেতেন গরুর গাড়ী করে । নৌকা বা গরুর গাড়ী আমার কিন্তু কোনটা্ই মনে নেই, যে কারনে নৌকায় চড়াটা যেমনি ভয় ছিল সাথে ছিল শিহরনও । বাসে, নৌকায় পাঁয়ে হাটার সময় কতজনের কত অভিÁতা, কত গল্প, কত আহাজারী শুনে শুনে ভয়ে ভয়ে ক্লান্ত ক্ষুদা দেহ কিছুক্ষণের জন্য হলেও অবসর নিতে চা্ইলেও মামার বকুনি, সন্ধার হাত ছানি মাথায় রেখে পথ চলতে হয়েছে । প্রতিমধ্যে এক দলছুট নিরুপায় বিডিআর সদস্য রাস্তার র্পাশ্বে দাড়িয়ে হাতপেতে আছে। এতে অবশ্য এই বিডিআর সদস্যকে অনেক তিরষ্কারও শুনতে হচ্ছে ।তেমন কোন অম্বাভাবিক বিড়ম্বনায় আমাদেরকে পড়তে হয়ইনি । তবে কোন বাধারও সম্মুখীন হতে হয়নি । তবে হাঁটার পথে কোন কোন সময় লাশের গন্ধ পেয়েছি । মামা তখন বলতেন ধ্রূত পথ চালাতে । রিক্সা-পায়ে হেঁটে-বাসে চড়ে- নৌকায় উঠে আবার পায়ে হেঁটে অবশেষে সন্ধা প্রায় ৫/৫.৩০ টায় দাদার বাড়ীতে হাজির ।

শীতের আমেজ, গ্রামের বাড়ীতে পাকা বাড়ীর কাজ চলছে। যুদ্বের ভয়াবহতা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে । চট্টগ্রামে বাবার শংকাও বাড়ছে। এতকিছুর মাঝেও, সব কথা বলতে না পারলেও গ্রামে দাদা-দাদীর বাড়ীর মজাটাই ছিল আলাদা। কোন পড়ালেখা নাই, শাসন করার কেউ নাই ।এই বাড়ী ওবাড়ী, এই হাঁট Hহাঁট, আর মাথায় শুধু একটাই এরপরের দুষ্টামিটা কি হবে । যুদ্বের ভয়াবহতা বুঝতে না পারলেও কারও কারও যে সর্বনাশ হচ্ছে তা বুঝতে কোন কষ্ট হতো না । যুদ্বের কোন বাতাস আমাদের গ্রামে বা আমাদের হাঁটে-বাজারে এসেছে আমি দেখিনি শুনিওনি । কোন ধরনের রাহাজানি, ধ©ষনের কথাও দেখিনি শুনিনি । তবে দুই একজন শান্তিবাহীনি এবং মুক্তিবাহীনীর সদস্য দেখেছি । দেখেছি হিন্দুদের লুটকরা সম্পদ নিয়ে আত্বতুষ্ট লোভী কিছু মানুষ । যুদ্বের ভয়াবহতা ও তীব্রতা দেখে সচারচর শহরমূখী আত্বীয়দেরকে দিয়ে বাবা আবার  চট্টগ্রামে ডেকে পাঠালেন । তাঁর মুখের কথা ”মরবোতো একসাথেই মরবো ।’’ মাস দিনক্ষণ কিছুই মনে নেই। উপায় না দেখে আবার ফিরে যেত হল চট্টগ্রামে ।

যুদ্ধ কারও জন্যে পৌষ মাষ কারও জন্য সর্বনাশ । আমার কোনটা তা আমি জানিনা, তবে আরেকটু পরির্মাজিত বয়স হলে ভালই হতো । আর আমার বাবার জন্যতো অবশ্যই বিপদজনক ভাবে পৌষ মাষ ছিল । যুদ্ধ অনেকটা সয়ে যাওয়ার মত অবস্থা, সন্ধা আটটার মধেই নিস্তবদতা, চারিদিকে অন্ধকার, বয়ষ্করা বিবিসি-ভয়েস আমেরিকা নিয়ে ব্যস্ত ।মহিলারা সনাতন কাজ আর নিরাপত্তা নিয়ে বেসামাল । যুদ্বের ভয়াবহতা কত প্রকট ছিল জানিনা, তবে দিনেরবেলায় জেট বিমানের গজ©ন শহরের সবাইকে বেশ ভালভাবেই ভয় পেয়ে দিয়েছিল ।বিমানগুলি মনে হচ্ছিল মাথার উপর দিয়েই যাচ্ছিল । শহরবাসী মনে করতে লাগলো এই বুঝি জীবনের শেষ ঘন্টা বেজে গেল । কেউ কেউ ভাবতে শুরু করলো কেন যে শহর ছাড়লামনা ।

গ্রাম থেকে আসার পর গলির মুখে দাড়ানো আরও বেড়ে গেল। স্কুল নেই, গৃহশিক্ষক নেই, সকালে হুজুর ছাড়া তেমন লেখাপড়াও নেই । যে পরিমান গাড়ী-মানুষজন দেখা যেত এখন তাও নেই । দিনক্ষণ কিছুই মনে নেই, ডিসেম্বরতো বটেই, প্রায় প্রতিদিনের মত আজও সকালে গলির মুখে দাঁড়ালাম । কেন জানি এখনও মনে পড়ে এই সকাল ছিল প্রচন্ড উজ্বল, অত্যন্ত তেজীস্ক্রীয় রোদ্রময় সকাল । পরিস্কার আকাশ । প্রচন্ড এক ভাললাগার সকাল । এই অনুভুতি এই শিহরন হয়তোবা বলা যাবে, লেখা যাবে তবে শেয়ার করা যাবে না । হজুর চলে গেলেন । নামাজ কোরান পড়ে বাবা গেলেন সকালের ন্যাপ নিতে, মাও নামাজ কোরান পড়ে অসুস্ততা নিয়ে চলেগেলেন তাঁর প্রতিদিনের নিয়মিত কম©জগে ।সকাল সাতটা আটটার বেশী হবে না । হঠাৎ চোখে পড়লো উত্তর দিক থেকে কে বা কাহারা ৩০/৩৫ বৎসরের লোককে চোখ বেঁধে কোমরে মোটা দড়ি দিয়ে পিটাতে পিটাতে দক্ষিন দিকে ডালিম হোটেলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে । আশে পাশে লোকদের মুখে উৎকন্ঠা, সাথে হাসি আর জয় বাংলার স্লোগান । বেশ বড় দেহের অধিকারী, শ্যামলা রঙের মানুষটির অসহায়তা খারাপ লাগলেও তা ছিল বিজয়ের বাণী । এই র্দীঘ নয়মাস কোথাও কোন খারাপ কিছু দেখিনি এটিই একমাত্র আমার দেখা যুদ্ধ দৃশ্য । এর কিছুক্ষন পরই একটি আকাশী নীল গাড়ী করে এক জাঁক তরুন রাস্তায় নেমে পড়লো, জনতা জাপিয়ে পড়লো তাদের উপর। তারা চিৎকার করে বলছে , দেশ স্বাধীন হয়ে গিয়েছে। উত্প্ত জনতা শত্রু ভেবে তাদেরকে বিশ্বাস করতে চায়নি । তখন গাড়ীর আরোহীরা শুনিয়ে দিল..‍

সোনা সোনা সোনা
লোকে বলে সোনা
সোনা নয় তত খাঁটি
বলো যত খাঁটি
তার চেয়ে খাঁটি বাংলাদেশের মাটি রে
আমার জন্মভূমির মাটি ।।

সমস্বরে সবাই বলে উঠলো জয় বাংলা ।।

আর কি ধরে রাখা যায় নিজেকে ! ভাবতে গেলে এখনই যেন ফিরে যাই সেই দিনে । এক দৌড় দিয়ে বাসায় চলে এলাম । আর চিৎকার করে করে আসছিলাম জয় বাংলা বলে বলে । সবার আগে আম্মাকে বল্লাম, আম্মা বাবাকে জাগিয়ে দিলেন ।আর আমি বাবাকে বলি “আব্বাজী দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে!”  বাবার মুখের অবিশ্বাসের হাসি ছিল। র্পাশ্বের বাসায় বাবার সমসাময়িক শিক্ষককে ডেকে সত্যতা যাচাই করলেন । আমি সুযোগ পেলেই বলি, ’আমার বাসায় আমিই দেশ স্বাধীন হওয়ার সংবাদ এনে দেই’ । স্বাধীনতার ছিছল্লিশ বৎসরে বিজয় মাসের প্রথম দিনে বিজয়ের কথা স্মরন করতে পেরে ভালই লাগছে ।

অধ্যাপক সরওয়ার জাহান; ডিসেম্বর ০১, ২০১৭