গবেষনা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ২০১৯–২০২০ সালের বাজেট
বরাবরের মতো এবারও ২০১৯-২০২০ সালের বাজেট জুন মাসে উপস্থাপিত হতে যাচ্ছে । বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, টেলিভিশন শোতে বক্তারা কর, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বান্ধব বাজেট প্রণয়নের যে তাগিদ প্রতি বৎসর দিয়ে থাকেন এইবারও তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার জন্য বলবেন সরকারও আশ্বাস প্রদান করবেন প্রতিশ্রুতি দিবেন ।ইতোমধ্যেই বিভিন্ন ব্যবসায়িক সংগঠন গণমাধ্যমে বাজেটের সম্ভাব্য আয়তন, কর, ভুর্তুকি, বিনিয়োগ, অর্থায়ন, দ্রব্যমূল্যের ওপর প্রভাব এবং গতিপ্রকৃতি নিয়ে আলোচনা এবং প্রচার চালাচ্ছেন।
অনেক বৎসর পর এইবার একজন ব্যবসায়ী, বর্তমানে ১১তম অর্থমন্ত্রী। ১৯৭০ সালে তদানিন্তন পাকিস্তানের চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় ১ম , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কমার্সে সম্মান স্নাতক ডিগ্রি ও অ্যাকাউন্টিংয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন বর্তমান অর্থমন্ত্রী। এ ছাড়াও আইন শাস্ত্রেও তাঁর স্নাতক ডিগ্রি রয়েছে। সকলেই আশাবাদী বর্তমান অর্থমন্ত্রীর উপর। মন্ত্রিমহোদয় যতই গুনী হউন না কেন, র্আথিক প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা, সততা, স্বচ্ছতা, রাজস্ব আহরণ পরিকল্পনা প্রণয়ন, বিনিয়োগের গতিশীলতা আনতে না পারলে তাঁকেই আবার ব্যর্থতার দায় নিতে হবে। কারন রাজস্ব আহরণ, ব্যয় নিয়ন্ত্রণ ও ব্যয়মান বৃদ্ধি ও অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা আমাদের মত জনবহুল দেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক যে নীতি-কৌশল বাজেটে ঘোষণা করা হয়, সে সম্পর্কে একটি ঐক্যমতের বাজেট হলে অনেক ফলপ্রসু হতো। আমাদের কর্মকর্তা, পরিকল্পনাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বিশ্বের কত দেশে সফর করেন , তা সহজে অনুকরনীয় হতে পারে । বাজেট ঘোষনার পর গতানুগতিক একপক্ষ দেশের মানুষকে ক্ষমতাসীন দল কর্তৃক অবাস্তব স্বপ্ন দেখানো ও তাদের পকেট কাটার একটা দলিল বলে মনে করবে আর অন্য পক্ষ অর্থনীতির চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলার লক্ষ্যে বাস্তবভিত্তিক দিকদর্শনামুলক উন্নয়ন বাজেট বলে প্রচারনা চালাবে। এইটা এখন আমাদের সংস্কৃতির অংশ।
গতানুগোতিক বাজেট না দিয়ে বাস্তবায়ন যোগ্য বাজেট বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন খাতে কর কমিয়ে করের পরিধি সম্প্রসারণ হলে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে অনেকে। প্রথম বছরে রাজস্ব আদায়ে হয়তো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে কর আদায় বাড়বে, যা দেশের উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বাস্তবায়ন যোগ্য বাজেট না হওয়ার কারনে দেশে বাজেটের সুফল পাওয়া যাচ্ছে না । মাঝপথে সংশোধিত বাজেট দেওয়া হয় তাও বাস্তবায়িত হয় না।আমাদের দেশে বাজেট ঘোষনা হয়, কিছু বাস্তবায়িত হয় বাকিটা হয়না বা কতটুকু হয় তাও বিশ্লেষন হয় না তবে বিভিন্ন আলোচনা-সমালোচনায় তা কিছুটা বের হয়ে আসে । বাস্তবায়ন যোগ্য বাজেট প্রয়োগ না হওয়ার মূল কারন হচ্ছে সর্বত্র পেশাদারিত্বের অভাব এবং অধিকাংশে ক্ষেত্রেই অপেশাদারি ও অপরিপক্ষতা দেখা যায় । অনেকাংশে পেশাজীবিরাই অপেশাদারির পরিচয় দেন । আবার এই অপেশাদারির কারন নীতি নৈতিকতার অধ:পতন ।
মৌলিক চাহিদার ওপর কর আরোপের ফলে মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষের ওপর এর তীব্র প্রভাব পড়ে, মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষেরই কষ্ট সবসময় বেশী । যার ফলে সার্বিকভাবে সমাজে আয়বৈষম্য হয় ও অনৈতিকতার দিকে সমাজ ধাবিত হয় এবং দুর্নীতি প্রসারিত হয়।
এবারও সরকার লক্ষ্ কোটি টাকার বাজেট দিবে। তার মধ্যে কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেটও থাকবে। একথা সত্য বাজেটের আকারের প্রবৃদ্ধি আমাদের জাতীয় প্রবৃদ্ধিরই প্রকাশ । ফলে বড় বাজেট বড় স্বপ্নেরই প্রকাশ ঘটায়। এই স্বপ্নময় বড় বাজেট বাস্তবায়নের কঠিন বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের প্রতিটি সেক্টরের কর্তা ব্যক্তিরা মনে করেন তাঁদের সেক্টর দেশের সেবা প্রদানকারি সেক্টর সুতরাং এই সেক্টরের কর রেয়াত বা প্রনেদনা দেওয়া উচিৎ । মূল্য সংযোজন কর এবং আয়কর নিয়ে অনেকের মধ্যে বিভ্রান্তি আছে।পাঠ্য পুস্তক থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রমোশনাল কার্য্যক্রম সারা বছর ব্যাপি নিলে এই ধোঁয়াসে ভাবটা কেটে যেত। এখন কর প্রদান করার সময় ছাড়া অন্যসময় প্রচারনা খুব একটা দেখা যায় না ।আর কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানে নীতি বাক্যের পোস্টার দেখা যায়। জনগনকে বুঝাতে হবে রাস্ট্র চলে করের টাকায়।
আমাদের দেশে শিক্ষার ও স্বাস্থ্য খাতের মান নিয়ে ব্যাপক আলেচনা সমালোচনা আছে ।সবাই বলে ”এ দেশে দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরি হচ্ছে না”। ”শিক্ষার মান নাই” । কিন্তু এর মান বাড়ানোর জন্য বাজেট বাড়ে না । দেশে দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরি না হওয়ার কারনে বিদেশিরা এখন বাংলাদেশের কারখানাগুলোতে কাজ করছে । এদেশে অনেক সময় গবেষনার টাকা ফেরত যায় । সঠিক মানের গবেষনা করার জন্য উৎসাহিত করা হয় না । বাংলাদেশে এখন একশটির উপরে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় এবং চল্লিশটিরও উপরে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে । এছাড়াও রয়েছে বেশ কটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় এবং আন্তরজাতিক বিশ্ববিদ্যালয় । সব সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের কি ভাল শিক্ষা দিচ্ছে ? সব সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগে কি অধ্যাপক আছে ? অধ্যাপকতো রাতারাতি তৈরী হয় না বা হওয়ার জন্য কোন ব্যবস্থা কি কেউ ভাবেন ? কিছু সরকারী বিশ্ববিদ্যাল বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়রে শিক্ষার্থিদেরকে পিএইচডি করার সুযোগ দিলেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্ষ্টাসে ভর্তি হতে বেগ পেতে হয়, অথচ কলেজ থেকে পাশ করা যে কেউ পিএইচডিতে ভর্তি হতে পারে ।এ এক চরম বৈষম্য ।অথচ বেসরকারী এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সরকার অনুমোদিত। সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা তিন বৎসরের পিএইচডি সাত-আট-নয় বৎসরে বের হচ্ছে, র্সাবিক বিবেচনায় তার কয়টি মান সম্পন্ন ? কেবল ঢালাও ভাবে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়রে নৈরেজ্যের কথা শুনি । তাদের কখা কেউ বলে না । তাই মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিদেশে পড়াশোনা করতে গিয়ে আর দেশে ফিরছেন না। আমাদের সমস্যা আমাদেরকেই সামাধান করতে হবে । আমাদের গবেষনারে প্রতি জোর দিতে হবে । বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়েও সত্যিকার অর্থে গবেষনার কাজ করতে হবে । সরকার বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে কোন আর্থিক সহযোগিতা দেয় না , তারা সমর্পূণ ভাবে শির্ক্ষাথীদের ফী দিয়েই চলে । গবেষণাহীন শিক্ষা কোনোদিন কাঙ্ক্ষিত ফল উপহার দিতে পারে না। বরং গবেষণাহীন শিক্ষায় প্রায়োগিক ক্ষেত্রে বিপরীত ফলের আশঙ্কা থাকে। উন্নয়ন যদি টেকসই করতে হয়, তাহলে সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে গবেষনায় , শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে।
স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়নের জন্য আমাদেরকে দেশের বাহিরে যাওয়রে প্রবনতা রোধ করতে হবে । এক্ষেত্রে সংসদ সদস্য, মন্ত্রী এবং উচ্চপদস্থদের দেশের চিকিৎসায় প্রতি আস্থা ফিরে আনার সকল ব্যবস্থা নিতে হবে । উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ হতে হলে দক্ষ শ্রমশক্তি নিশ্চিত করার জন্য গবেষনা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে যথাযত বাজেট প্রয়োজন ।বর্তমানে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৫২টি দেশের দ্বিতীয় সর্বনিম্ন শিক্ষা বাজেট বাংলাদেশের । বাংলাদেশের চেয়ে শিক্ষা খাতে কম ব্যয় করে শুধু কম্বোডিয়া। আর স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের মতো আর কোনো দেশ এত কম হারে ব্যয় করে না। এই চিত্রটি উঠে এসেছে জাতিসংঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিকের (এসকাপ) অর্থনৈতিক ও সামাজিক জরিপে। ২০১৮ সালের প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
বাজেট আসে, বাজেট যায়, প্রতি বছরের মতো এবারেও অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করা হবে । লক্ষ কোটি টাকার সুবিশাল বাজেট হবে। বিশাল আকার আর আয়তনের জন্য বাজেট বিভিন্ন মহলে বেশ আলোচিত কিংবা সমালোচিত হবে । যাদের জন্য দেশ, সেই সাধারণ জনগণ সরকারের এই বাজেট নিয়ে কতটুকু মাথা ঘামান! তবে কেউ বলবে দেশের উন্নয়ন, বিদেশের সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন, জীবনযাত্রার মানউন্নয়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, জিডিপি ইত্যাদি কঠিন কঠিন কিছু শব্দ সহকারে বক্তব্য দেবেন । কেউ আবার এমন করুণ ও বিরক্তিকর বর্ণনা শুনিয়ে দেবেন । আসলে বাস্তবতার আলোকে, আমজনতার ভাগ্যের উন্নয়নের জন্য হওয়া উচিত। সমস্যার আবর্তেই থেকে যাই আমরা। দিনের পর দিন। যুগের পর যুগ। সরকারের পর সরকার। কারণ বাজেটে যা কিছু কল্যাণকর, সে শুধু উচ্চশ্রেণির মানুষ কিংবা বিশেষ এক শ্রেণির জন্যই। আশাকরি ২০১৯-২০২০ সালের বাজেট গবেষনা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে যথাযত বাজেট দিয়ে দেশে দক্ষ মান সম্পন্ন সুস্বাস্থ জনশক্তি তৈরিতে সহায়ক ভুমিকা রাখবে ।