প্রশাসকের পরিবর্তে কেন গবেষক তৈরি হবে!

0
162

প্রশাসকের পরিবর্তে কেন গবেষক তৈরি হবে!

 জি এম আরিফুজ্জামান

বাংলাদেশের শিক্ষার সার্বিক চিত্র নিয়ে গত ৬ জানুয়ারি জাগো নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, “কোনো বিজ্ঞানী নেই, গবেষক নেই, দার্শনিক নেই। যেদিকে তাকাবেন, শুধুই প্রশাসক”।

বর্তমান বাস্তবতায় এই উক্তিটি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করার কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হরো, কেন মেধাবীরা গবেষণাকে পেশা হিসেবে বেছে নেবেন? সচরাচর দেখা যায়, আমাদের দেশে কোনো বিশিষ্টজন বিশেষত শিক্ষক-গবেষক যখন কোনো গবেষণার ভাষায় নীতিনির্ধারণীদের নেয়া সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন, নানা অসঙ্গতির কথা তুলে ধরেন, তখন দেশের উচ্চপর্যায়ের চেয়ারে বসে থাকা ক্ষমতাবান, প্রশাসনের কর্তারা এমন আচরণ করেন যেন এ বিষয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই, বিষয়টি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

বাস্তবে দুটি উদাহরণ দিতে চাই। প্রথমটি, ২০১৯ সালের জুনের ঘটনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন স্বনামধন্য গবেষকের নেতৃত্বে বাংলাদেশের বাজারে থাকা দুধে অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়ার গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করে দেশব্যাপী ব্যাপক সাড়া ফেললেন। এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশের পরদিনই বাংলাদেশ সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রী এই গবেষণাকে মিথ্যা বলে দাবি করেন। পরে ০৯ জুলাই একজন অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার প্রশাসক এই গবেষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দেন। এক কথায় এই ঘটনাকে একটা রাজনৈতিক এবং ষড়যন্ত্রের মোড়কে মুড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্ঠা তখন আমরা দেখেছি।

কি উপায়ে গবেষণার তথ্য নিয়ে পুনঃমূল্যায়ন বা সমালোচনা করতে হবে, সেটাকে গবেষণার ভাষায় প্রকাশ করতে হবে, প্রশাসকের ভাষায় নয়। অন্য ঘটনাটি ২০২০ সালের ১৭ মার্চ বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের শিক্ষাব্যবস্থার বিষয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকার। তার ভাষ্যে, “আমি বলেছি যে, শিক্ষার মান নিম্নমুখী, মন্ত্রীরা চটে যান। একজন একদিন আমাকে বললেন, আপনারা জানেন না। আমি বললাম, কী জানি না? মন্ত্রী হলেই সবাই সব জানে? একটা দেশে ১১টা শিক্ষাব্যবস্থা চলতে পারে নাকি? এখন যত কথাই আমরা বলি, একটা জিনিস বুঝেছি, আমলারা যদি না বলেন, তাহলে কোনোকিছুই গৃহীত হবে না। দেশে এখন আমলায়ন চলছে, নাগরিকায়ন হচ্ছে না”।

এই দুটি ঘটনা থেকে স্পষ্ট, প্রশাসকদের দাবি গবেষকরা কিছুই জানেন না। মনে রাখা দরকার, একজন গবেষকের কাজ গবেষণা করা, নতুন জ্ঞানের সন্ধান করা, ভবিষ্যৎ এবং বর্তমান সংকট মোকাবিলার সর্বোত্তম পথের অনুসন্ধান করা। পাশাপাশি আরও একটি বিষয় মাথায় রাখা দরকার, গবেষক এবং প্রশাসক কেউ কারও প্রতিদ্বন্দ্বী নন। একটা রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য দুই ধরনের পেশার লোকের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু কিছু প্রশাসক তাদের ওপর অর্পিত রাষ্ট্রের দায়িত্বকে পুঁজি করে গবেষণার ফলাফল এবং গবেষকদের অবমূল্যায়ন করছেন। এটা একটা রাষ্ট্রের জন্য অশনিসংকেত।

এই অধিক জনসংখ্যার বাংলাদেশে এখন খাদ্যে অনেকটা স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পেছনে গবেষকদের অবদান অনেক বেশি। কৃষি বিষয়ে গবেষণার নতুন নতুন ধানের উদ্ভাবন এবং ফসলের নানা বিষয়ে উন্নত কারিগরি দিককে সামনে আনার জন্য বাংলাদেশে পর্যাপ্ত খাবারের সংস্থান হচ্ছে, জোগান হচ্ছে। বাংলাদেশে কৃষি বিষয়ে গবেষণা, ফসলের উৎপাদন বাড়লেও যারা গবেষক তাদের জীবনমান নিয়ে খোঁজখবর নিন। তাদের জন্য কি আছে পর্যাপ্ত আবাসন সুবিধা, যাতায়াতের জন্য গাড়ি, উদ্বৃত্ত গবেষণা ভাতা? প্রশ্ন থেকে গেল।

যে বেতন পান সেই বেতনই তাদের সম্বল। যারা বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য নিরলস গবেষণা করে যাচ্ছেন, তারা যখন দেখেন তাদেরই একজন বন্ধু বা পাড়া প্রতিবেশী শুধু প্রশাসক হওয়ার কারণে গাড়ি হাঁকাচ্ছেন, টাকার সুবিধায় নির্মাণ করছেন সুউচ্চ বাড়ি, ক্ষমতার দাপটে তামিল সিনেমার মত ধরাকে সরাজ্ঞান করছেন, তখনই সেটা তাদের জীবনের জন্য কিছুটা হলেও কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। হয়তো ভাবছেন, একজন গবেষক কেন এগুলো খেয়াল করেন/ করবেন!

গবেষক খেয়াল করেন না কিন্তু প্রচলিত ব্যবস্থা তাকে খেয়াল করতে বাধ্য করে। মনে রাখবেন, গবেষককেও দিন শেষে ফিরতে হয় পরিবার, আত্মীয়স্বজন এবং সমাজের কাছে। গবেষণা করার পরও যখন দেখে, তার চেয়ে প্রশাসকরা অনেক অনেক গুণ ভালো আছে, তখন দৈন্যতাকে মুখ বুজে সহ্য করে তাকে শক্ত হয়ে নিজের কাজের ওপর অবিচল থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। যারা সেটা পারেন না, পাড়ি জমায় বিদেশে। আমরা অনেক বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশীয় গবেষকদের নিয়ে গর্ব করি, কিন্তু সেই একই ব্যক্তি যখন দেশে ছিলেন, তাকে কি আমরা গবেষণার পর্যাপ্ত সুবিধা ও চাকরির মর্যাদা দিতে পেরেছি! না পারিনি।

আন্তঃক্যাডার বৈষম্যের কারণে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার পাস করা একজন শিক্ষার্থীও ছুটছে প্রশাসক হওয়ার নেশায়। এই পরিস্থিতি দেখে মনে হয়, প্রশাসকদের সুবিধার কাছে মেধা ও দক্ষতা ম্লান। আমরা পত্রিকার পাতা খুললেই অনেক সময় দেখি, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারদের শাসন করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে প্রশাসকরা। এ বিষয়গুলো যার প্যাশন আছে, তিনি হয়তো মেনে নিচ্ছেন কিন্তু, তার পরিবারের সদস্যরা। মেধার সাক্ষরের চেয়ে কেন জানি অর্থ এবং ক্ষমতার জোরই বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

‘গবেষক’ বলে তো কোনো ক্যাডারই নেই। হয়তো বিভিন্ন দপ্তরে গবেষণা সেল চালু হচ্ছে, কিন্তু সেখানেও কাজ করছেন প্রশাসকরা। অথচ উচিত ছিল গবেষককে স্বতন্ত্র পদ্ধতিতে নিয়োগ দেয়া। যাদের কাজ হবে গবেষণা করা, প্রশাসনের কাজে নিজেদের সম্পৃক্ততা নয়। তবে মনে রাখতে হবে, গবেষকের যদি শুধু গবেষণার প্রয়োজনে প্রশাসনে সম্পৃক্ততার দরকার হয়, সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি অবশ্যই রাখতে হবে।

আরও একটি ঘটনার অবতারণা করা যাক, ২০২১ সালের ১৮ আগস্ট রাত সাড়ে ৯টার দিকের ঘটনা। মিডিয়ার বরাতে জানা গেলো, বরিশাল সিটি করপোরেশন এলাকায় সেই এলাকার মেয়র সমর্থকদের সাথে একজন ইউএন’র বাসভবনে সংঘর্ষ ঘটনা ঘটলো। কি কারণে ঘটলো, কেন ঘটলো বা কারা জড়িত সেটি এই লেখার মুখ্য বিষয় নয়। এই লেখার মুখ্য বিষয়টি হলো, মেয়র এবং ইউএন’র পক্ষে অবস্থান নিয়ে পরস্পরের দুই পক্ষ থেকে তাদের সমর্থক এবং অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বিবৃতি। এই বিবৃতির দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে অন্যায় বা ন্যায় যাই হোক না কেন, স্বগোত্রীয় শ্রেণির পক্ষ অবলম্বন করতেই হবে।

এখন ফিরে যাই, ২০১৯ সালের জুন মাসের ঘটনায়। দুধ বিষয়ক গবেষণায় গবেষকের বা গবেষণার বিষয়ে পক্ষ হয়ে কোনো কোনো গবেষক হয়তো কথা বলেছেন মিডিয়ায় কিন্তু সংশ্লিষ্ট অ্যাসোসিয়েশন বা বিভাগ বিবৃতি দিলেও সেই বিবৃতির সুর ছিল গবেষণার নয়, প্রশাসকের- রাজনীতির ভাষার। এমনকি দেশের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকেও আসেনি গবেষণার পুনঃমূল্যায়নের বিষয়টি। এ ধরনের ঘটনা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে গবেষণাকে অবমূল্যায়নের একটি উদাহরণ হিসেবে থাকবে।

ফিরে যাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর দেয়া গত ১৬ ডিসেম্বর ২০২১ সালে ‘সমকাল’ পত্রিকাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে। বাংলাদেশের বড় কয়েকটি সমস্যা চিহ্নিত করুন বিষয়ক প্রশ্নের উত্তরে তিনি প্রথম সমস্যাকে দেখিয়েছেন বৈষম্য এবং দ্বিতীয় জ্ঞানচর্চার অভাব। তার ভাষায়, ‘জ্ঞান ক্রমাগত মূল্য হারাচ্ছে। অথচ জ্ঞান ছাড়া তো প্রকৃত অগ্রগতি সম্ভব নয়। সেই জ্ঞানের চর্চা দরকার, যা মানবিক উন্নয়নে কাজ দেবে’। জ্ঞান চর্চার মূল কারিগর হিসেবে ধরা হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে। বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ের মাপকাঠিতে, ক্রমাগত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণার মানের নিম্নগামিতার চিত্র ফুটে উঠেছে। আমাদের দেশে স্বতন্ত্র গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় নেই। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষকদের কর্মপরিধি বা মর্যাদা নিয়ে নীতিমালা নেই, নেই পর্যাপ্ত আবাসন সুবিধা, গবেষণা ভাতা।

যেখানে গবেষকদের গবেষণার মূল্যায়ন হয় না, নেই মর্যাদার নীতিমালা, নেই গবেষণার বা গবেষকের পক্ষে কথা বলার মতো সংগঠন, নেই সুযোগ-সুবিধা, নেই ক্ষমতা, নেই অর্থ, নেই আবাসন সুবিধা, নেই পর্যাপ্ত যাতায়াত সুবিধা, বলুন সেখানে প্রশাসকের পরিবর্তে কোন দুঃখে একজন গবেষক তৈরি হবে!

jagonews
লেখক : রিসার্স অ্যাসোসিয়েট, সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। gmarif.cgs@du.ac.bd