বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারক ও নির্বাহীদের আন্তঃসম্পর্ক

0
146

বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারক নির্বাহীদের আন্তঃসম্পর্ক

১৯৯২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরুর পর ৩০ বছরের ব্যবধানে দেশে বর্তমানে ১০৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় । উচ্চ শিক্ষার প্রসারে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুরুত্ব অনস্বীকার্য। যারফলে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বর্তমানে একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়েছে। বেসরকারি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ হয়ে গ্র্যাজুয়েটরা বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস, জুডিসিয়াল সার্ভিস থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আকর্ষণীয় চাকরিতে নিজেদের স্থান করে নিচ্ছে । শির্ক্ষাথীদের সেশনজটের কোনো ঝামেলাও পোহাতে হয় না । তাই এখন অনেকের পছন্দের তালিকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এসব প্রতিষ্ঠানের বিকাশের সূত্র ধরে উচ্চশিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের বিদেশে যাওয়ার হার কমেছে।বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে। বিদেশী শির্ক্ষাথীরাও দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতি আগ্রহী হয়ে লেখা-পড়া করছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটরা জাতীয় উন্নয়নে সর্বক্ষেত্রে অবদান রেখে চলেছেন। উচ্চশিক্ষায় দেশের প্রায় চার লাখ শিক্ষার্থী বিভিন্ন প্রোগ্রামে অধ্যয়নরত।

সম্ভাবনাময় খাত দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিপুলসংখ্যক শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর কর্মসংস্থান হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ইউজিসির সূত্র বলছে, বর্তমানে ১৫ হাজার ২৭৭ জন শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন। এদের মধ্যে মহিলা শিক্ষক রয়েছেন ৪ হাজার ৯১৯ জন। শিক্ষকদের মধ্যে পূর্ণকালীন অধ্যাপক রয়েছেন ৮৪১ জন। এদের মধ্যে পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষক রয়েছেন ২ হাজার ৯৫০ জন। এছাড়া মোট ৫ হাজার ৪০০ কর্মকর্তা ও ৭ হাজার ১৮১ জন কর্মচারী কর্মরত রয়েছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এখন বাস্তবতা ।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহীর অনেকেই বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানিক ক্রিয়াকলাপের অভিজ্ঞতা না থাকায় নিজেকেই হারিয়ে ফেলেন। প্রধান নির্বাহীর একগূঁয়ে আাচরনে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তার অভিষ্ঠ লক্ষে পোচাঁতে পারছে না। নির্বাহীরা নীতিনির্ধারকদেরকে প্রাধান্য দিতে চান না । নীতিনির্ধারকদের চিন্তা-চেতনা নির্দেশনায়ই বিশ্ববিদ্যালয় চলার কথা। নীতিনির্ধারকরাও নির্বাহীদেরকে নিজেদের অধিন্যস্ত মনে করেন।। সকলকে মানিয়ে সকল নিয়ম মেনে দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থা মাথায় রেখে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যলয়কে চলতে হয় কর্পোরেট সংস্কৃতিতে। এটাই সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যলয়ের অন্যতম পার্থক্য । যদিও অনেক নির্বাহীরাই তা মানতে চান না।

কোন কোন নির্বাহী সুকৌশলে শিক্ষক, কর্মকর্তা এবং ট্রাস্টি র্বোডকে বিভাজন করে বিশ্ববিদ্যালয় ইচ্ছামত চালাতে চান। আবার কোন কোন বিশ্ববিদ্যলয়ের ট্রাস্টি র্বোডও এমন উপর্চায্ নিয়োগ দেন যা প্রধান নির্বাহীর পদকে সমালোচনা ফেলে। এধরনের নৈতিক বিবর্জিত কাজ উভয়ে সাময়িক ভাবে লাভবান হলেও প্রকৃতপক্ষে বিশ্ববিদ্যলয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রধান নির্বাহী বা ভাইস-চ্যান্সেলরদের উচিৎ নীতিনির্ধারক বা উদ্যোক্তাদের দেখে-শুনে যোগদান করা। তাহলে উদ্যোক্তা এবং ভাইস-চ্যান্সেলরদের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকবে।নীতিনির্ধারকদেরও উচিৎ মনোনয়ন দেওয়ার আগে উপর্চায সাথে খোলামেলা আলেচনা করে নেওয়া। তাহলেই অনেক সমস্যা সমাধান হয়ে যায়।

 আমাদের দেশের আইন প্রণেতা, নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা , উদ্দোগত্যা ও নির্বাহীদের মধ্যে এখনো বেসরকারিখাতে উচ্চ শিক্ষার ধারনা অভিজ্ঞতা পর্যাপ্ত নয়। তাঁরা এখনো সনাতন প্রক্রিয়া থেকে বের হয়ে আসতে পারেননি। গত কয়েক বছরে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা সম্পন্ন জনবল না থাকায় এবং জনবল তৈরীও না হওয়ায় বেসরকারী খাতে উচ্চশিক্ষা একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। সম্ভবত এইটিই একমাত্র খাত, আইন প্রণয়নের পর দুই বার সংশোধিত হয়ে তৃতীয় বারের প্রস্তুতি চলছে। অনেক সীমাবদ্ধতা থাকার পরও বেসরকারী খাতে উচ্চ শিক্ষা প্রসারে উদ্যোক্তা বা নীতিনির্ধারকগণ অগ্রণী ভূমিকা রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে আসছেন। ইউজিসিও উচ্চশিক্ষায় গুনগতমান উন্নয়নে বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়নে অব্যাহত প্রচেষ্টা করে যাচ্ছে ।

নীতি নির্দেশনায় সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞতার অভাবে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন একাডেমিক এবং প্রশাসনিক অঙ্গসংগঠনগুলো পুরোপুরি কার্যকর হয় না। বেসরকারী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যথাযত অভিজ্ঞতা না থাকায় অনেকের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। প্রধান নির্বাহীর পদে অনেক মেধাবী শিক্ষকরা অনেক সময় সকলকে বিব্রত করেন। একাডেমিক বা প্রশাসনিক এবং নীতিনির্ধারণী বিষয়সমূহের মধ্যে একটা পার্থক্য থাকা উচিত। নীতিনির্ধারণী বিষয়গুলো প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে পরামর্শক্রমে বোর্ড কর্তৃক নির্ধারণ করা দরকার। সঠিক ব্যবস্থাপনায় বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় হতে উত্তীর্ণ স্নাতকদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা এবং প্রতিভা দ্বারা দেশ, ব্যাপকভাবে উপকৃত হবে। এটা আশা করা যায় যে, ভবিষ্যতে গবেষণা, জ্ঞান সৃষ্টি এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ নেতৃত্ব প্রদানে সক্ষম হবে। মনে রাখা দরকার বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ম পদ্বতি কোন কলেজ বা সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের মত নয় ।

 বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় দুটি পক্ষ থাকে, একপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতা বা যাঁরা নীতিনির্ধারক এবং অন্য পক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী কর্মকর্তা। যদি সুসর্ম্পক থাকে এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, আস্থা ও সহযোগিতার হয় তবে নীতিনির্ধারক ও নির্বাহীকে নিয়েই পক্ষ হবে একটি । দু’পক্ষ দু’রকম চিন্তা করলে হবে না। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় দু’পক্ষেরই চিন্তা-ভাবনার বিষয় রয়েছে। অনেক ভালো উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে যায় উপযুক্ত নীতিনির্ধারক ও নির্বাহীদের সক্ষমতার অভাবে। গতিশীল এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোর উপর প্রশাসনের ভিত স্থাপিত হয় উপযুক্ত নীতিনির্ধারক ও নির্বাহীদের উপর।কারন আমলাতান্ত্রিক মানসিকতা, সন্দেহ প্রবনতা, একগুঁয়ে ও সময়ের সাথে না চলা প্রশাসনের স্বাভাবিক কার্যক্রমে স্থবিরতা, ভীতকর ও বিভাজন নিয়ে আসে।  সামাজিক মূলধন সৃষ্টিতে পারস্পরিক সহযোগিতাই হবে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারক ও নির্বাহীদের মূল দায়িত্ব এবং এ চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যমে তাঁরা গর্বিত হতে পারেন।

উদ্যেক্তাদের লালিত স্বপ্ন হলো সমাজ উন্নয়নে দেশে শীর্ষমানের বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা। সাধারনত: নীতিনির্ধারক বা ট্রাস্টিতে যারা থাকেন তাঁরা অনেকেই বিত্তবান । বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রদিষ্ঠাতারা বিশ্ববিদ্যালয়কে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান না ভেবে সামাজিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান মনে করা উচিৎ । বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তারা আইন অনুযায়ী বিভিন্ন কমিটিতে অবশ্যই বসবেন, কিন্তু তারজন্য কোন অর্থ গ্রহণ না করলে ভাল।যেহেতু সামাজিক প্রতিষ্ঠান তাই লভ্যাংশও আশা করতে পারেন না । তবে কেউ যদি শ্রম দেন তার প্রাপ্য অবশ্যই তাঁকে দিতে হবে।

যে কোন বাস্তব সম্মত পরিকল্পনা নতুন উদ্যোগ গ্রহনের ক্ষেত্রে নির্বাহীদের উচিৎ নীতিনির্ধারকদের জানানো। কিন্তু তিনি যদি নীতিনির্ধারকদের এড়িয়ে নতুন নতুন কিছু করেন বা তাঁর মত করে বিশ্ববিদ্যালয় চালান তবে এটা ন্যায়সংগত হবে না। প্রধান নির্বাহী বা ভাইস-চ্যান্সেলরদের অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে যে, নীতিনির্ধারকরাই সমাজ গঠনের জন্য অর্থ বিনিয়োগ করছেন , আইন অনুযায়ী নীতিনির্ধারক বা ট্রাস্টের চিন্তা-চেতনা নির্দেশনায়ই বিশ্ববিদ্যলয় চলবে।তাই নীতিনির্ধারকদের যথাযত সম্মান দিয়ে জানাতে হবে কি করা হচ্ছে, কিন্তু কিভাবে করতে হবে, তা নির্বাহী তাঁর অভিজ্ঞতার থেকে করবেন।

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়বদ্ধতার চেয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়বদ্ধতা অনেক বেশি। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সরকার থেকে ভর্তুকি নেওয়ার কারনে শির্ক্ষাথীদের কাছ থেকে অনেক কম অর্থ নেয় । অথচ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ভাইস-চ্যান্সেলরের যে ক্ষমতা এবং যতখানি সম্পৃক্ততা, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েরও একই । ভাইস-চ্যান্সেলর হচ্ছেন ‘কিং-পিন অব দ্যা ইউনিভার্সিটি’। একেবারে ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ পর্যন্ত প্রতিটি জিনিসের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে ভাইস-চ্যান্সেলরকে।

বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের জন্য জামানতের টাকার বাইরেও বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় উদ্যোক্তাদের অর্থ দিতে হবে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিপূর্ণভাবে দাঁড়ানোর পর্যন্ত এই প্রাথমিক অর্থ আস্তে-ধীরে এমনভাবে ফেরৎ নেয়া যেতে পারে, যাতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর চাপ না পড়ে। তাছাড়া প্রত্যেকটি কাজ যদি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আন্তরিকতার সাথে পরিচালিত হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন হয়, তবে উদ্যোক্তা ও ভাইস-চ্যান্সেলরদের সম্পর্ক ভাল থাকবে। ইউজিসি, প্রতিষ্ঠাতা এবং ভাইস-চ্যান্সেলরগণ যদি সমন্বিতভাবে কাজ করতে পারেন তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তার পূর্ণাঙ্গ মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য সফল হবে।

 বিমাতাশুলভ আচরনের পরও দেশে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা তারাই করবে যারা জ্ঞান অর্জনের পরিবেশ তৈরি করে দিবেন, কিছু পাওয়ার জন্যে নয়। তবে শিক্ষক, কর্মচারী, শির্ক্ষাথী এবং উদ্যোক্তাদের খুশি রাখার মূলে হচ্ছেন ভাইস-চ্যান্সেলর । ‍নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আসলেও তাঁর উপরই অনেক কিছু নির্ভর করে। বেশির ভাগ বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি এবং ভাইস-চ্যান্সেলরদের দ্বন্দ্বের কারনে বিশ্ববিদ্যালয় সঠিকভাবে পরিচালিত হয় না।

 বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে জ্ঞান আহরণ, জ্ঞান চর্চা এবং বিতরণের জন্য জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও আলোকিত জাতি গঠনের একটি উৎকৃষ্ট প্রতিষ্ঠান। যে কোন অব্যবস্থাপনা উচ্চ শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যহত   হবে, সমাজ হবে কুলশিত । একটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায়-গবেষনায় নেতৃত্ব দিয়ে জ্ঞানে বিজ্ঞানে নতুন নতুন তত্ত্ব ও তথ্য আবিষ্কার করার সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজ বিকশিত হয়। নীতিনির্ধারক বা ট্রাস্টি ও নির্বাহী বা ভাইস-চ্যান্সেলরদের সঠিক আচরনে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হবে৷ কারন তাঁরাই সমাজ উন্নয়ন ও সমাজ গঠনের প্রতীক।