মাদকাসক্ত ঝুঁকিতে তরুণ-যুবক!

0
151

মাদকাসক্ত ঝুঁকিতে তরুণ-যুবক!

বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে তৃতীয় শ্রেণির পরিশ্রমী এক কর্মচারী বাবার ২৩ বছরের এ সন্তান একজন মাদকসেবী। পড়াশোনার পাট চুকেছে এসএসসিতেই। এলাকায় আড্ডা, ঘোরাফেরা করেই সময় কাটত তার। বন্ধুর সঙ্গে মাদকের বেড়াজালে জড়িয়ে ছিনতাই-চুরিসহ বিভিন্ন অপরাধের অপরাধী এ তরুণ। সেবন করতেন গাঁজা-ইয়াবা-ফেনসিডিল। অন্যান্য নেশা তো রয়েছেই!

মাদক কেনার জন্য টাকা-কড়ি না পেয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার, মারধর- সব কিছুই ছিল তার কাছে সহজ। মাদক পেলে চুপচাপ, না পেলে ঘরের এটা-ওটা ভেঙে বেরিয়ে পড়তেন কোনো না কোনো আশ্রয়ে। এভাবে দিন পার করতে করতে তার ঠিকানা এখন ঢাকার একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্র।

এই মাদক সেবকের মতো অনেক তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী আজ মাদকের ভয়াল থাবায় পতিত। মাদকাসক্ত বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে তাদের জীবন ডুবে যাচ্ছে অথৈই তিমিরে। অথচ যাচাই করলে দেখা যাবে, এসব তরুণ-তরুণীর আগের জীবন অত্যন্ত সুন্দর। কেউ ভালো শিক্ষার্থী, কারও কারিগরি জ্ঞান ভালো। কেউ ভালো ছবি আঁকতেন, কেউ ভালো গান করতেন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, বন্ধুদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে ৫৯ দশমিক ২৭ শতাংশ তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছেন। আর মাত্র ৩৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ যুব সমাজ কৌতুহলবসত মাদক সেবনে ঝুঁকছে।

সমাজের ১৫-৩০ বছর বয়সীদের মাদকাসক্ত হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। অধিদফতরের ২০২১ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার ১৬-৪০ বছর বয়সীদের প্রায় ৮৪ দশমিক ২৭ শতাংশ মাদকাসক্ত। এই বয়স সীমার মধ্যে ২১-২৫ বছর বয়সী যুবকরা রয়েছেন ‘সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে’। ১৬-২০ ও ২৬-৩০ বছর বয়সীরা ‘মধ্য ঝুঁকি’; ৩১-৩৫ বছর বয়সীরা রয়েছেন ‘স্বল্প ঝুঁকিতে’।

একটি বেসরকারি হিসাব অনুসারে, বর্তমানে বাংলাদেশের মাদকাসক্ত রয়েছে ৭৫ লাখেরও বেশি। এদের মধ্যে ৮০ শতাংশ যুবক-যুবতী। ৪৩ শতাংশ বেকার, ৬০ শতাংশ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত। ৪০ শতাংশ অশিক্ষিত, ৪৮ শতাংশ মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং ৫৭ শতাংশ যৌন অপরাধী। মাদকাসক্তদের মধ্যে ৯৮ শতাংশ ধূমপায়ী।

সম্প্রতি মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার-বিরোধী আন্তর্জাতিক দিবসের এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আমাদের কাছে যে পরিসংখ্যান রয়েছে- বাংলাদেশে প্রায় ৭ দশমিক ৫ থেকে ৮ মিলিয়ন মাদকাসক্ত রয়েছে। কারও কারও পরিসংখ্যানে আরও বেশি। মোট মাদকাসক্তের মধ্যে ৪৮ শতাংশ শিক্ষিত। মাদকাসক্তদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ আবার যৌন অপরাধী। জেলখানায় যত মানুষ আছে এর বেশিরভাগই মাদক পাচারকারী কিংবা ব্যবসায়ী। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে মাদকসেবীদের ৮০ শতাংশই যুবক। আমরা কাউকে ছাড় দিচ্ছি না। প্রধানমন্ত্রী মাদকে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছিলেন। আমরা সেই লক্ষ্যে কাজ করছি। সবাই মিলে কাজ করলে আমরা এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাবো।

এদিকে, দিনের পর দিন মাদকাসক্তের সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছে। সমাজের উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের অধিকাংশ মানুষই মাদকের ভয়ানক ছোবলের কবলে রয়েছে। দিনকে দিন দেশে মাদকের চাহিদা তো বাড়ছেই, সঙ্গে বাড়ছে অধিক সরবরাহ। এতে দেশের মেধা ও উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় বড় বাধা হিসেবে মনে করছেন অধিদফতরের কর্মকর্তারা।

গাঁজা, মদ, ফেনসিডিলকে পেছনে ফেলে সারা দেশ এখন ইয়াবা ট্যাবলেটে টইটুম্বুর। এর সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের পরিচিত ভয়াবহ মাদকের বাজার বাংলাদেশে তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এক শ্রেণির অসাধু চক্র।

যদিও কোনো মাদক বাংলাদেশে উৎপাদন করা হয় না। তবুও বিমান, স্থল ও নৌপথে দেশের সীমান্ত এলাকায় চোরাচালানের মাধ্যমে দেশে মাদক প্রবেশ করছে। এসব সরবরাহ পাচার ও বাজার তৈরির কাজে সহযোগিতা করছে দেশের আভ্যন্তরীণ মাদক কারবারিরা। ব্যবহৃত হচ্ছেন নিম্ন আয়ের মানুষ, নারী ও শিশুরা। নতুন নতুন কৌশল খাটিয়ে প্রাইভেট-কারে, সবজি-বাহী ট্রাক, ফলের ঝুড়ি, ট্রাকের পাটাতনের নিচে বিশেষ কায়দায় মাদক সরবরাহ করা হয়।

এমনকি মানবদেহে পাকস্থলীতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাদক পাচার করছে কিছু মানুষ। রান্না করেও সরবরাহ হচ্ছে প্রাণের ঝুঁকি থাকা এসব পণ্যের।

গত ২৮ জুন রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর এলাকা থেকে ৭ হাজার ৮০০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ ২৭ বৎসরের এক নারী মাদক কারবারিকে গ্রেফতার করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। তার আগে গত ২৯ মে অভিনব কায়দায় গাঁজা সরবরাহের দায়ে রাজধানীর গুলশান থেকে এক নারীসহ মোট তিনজনকে হাতেনাতে আটক করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ।

তারা গাঁজা দিয়ে চকলেট, কেক, মিল্কশেকসহ খাদ্যপণ্য বানিয়ে ইন্টারনেটভিত্তিক মোবাইল অ্যাপ পাঠাওয়ের মাধ্যমে হোম ডেলিভারি দিয়ে আসছিলেন। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ জানতে পারে, কানাডা ও আফ্রিকার মাদক কারবারিরা ভার্চুয়াল মাধ্যমে মাদক দিয়ে তৈরি বিভিন্ন খাবারের রান্না দেখিয়ে থাকেন। সেখান থেকে জ্ঞান নিয়ে নিজেরাও গাঁজা দিয়ে খাবার রান্না শিখেছেন। উত্তরায় একটি বাসায় তারা এ কাজ করতেন।

এদিকে প্রতিনিয়ত অভিযানের মাধ্যমে মাদকসহ শতাধিক আসামি গ্রেফতার করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। ভয়ানক সব মাদকও জব্দ করা হচ্ছে। তবুও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি ও তৎপরতার মধ্যেও কারবার চালিয়ে যাচ্ছে এ সংশ্লিষ্ট কারবারিরা।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ঢাকা মেট্রো উপ অঞ্চলের (উত্তর) সহকারী পরিচালক (এডি) মেহেদী হাসান বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছি। আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে। সামাজিক এ ব্যাধি নির্মূলে আমরা বদ্ধ পরিকর। এসবের চাহিদা ও সরবরাহ কমাতে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে নাগরিকদের মাদক-বিরোধী সামাজিক আন্দোলনের নামার আহ্বানও জানান তিনি।