গহীন মহাশূন্যের ছবির অ্যালবাম প্রকাশ
পৃথিবীর জন্মেরও আগের গহীন মহাশূন্যের হাজারো ছায়াপথের ছবি তুলে পাঠিয়েছে নাসার ‘জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (জেডব্লিউএসটি)’।
নাসা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী স্পেস স্যাটেলাইটের তোলা ‘গহীন মহাশূন্যের’ ছবির অ্যালবাম প্রকাশ করার একদিন আগেই অ্যালবামের একটি ছবি হোয়াইট হাউজে দেখিয়ে বসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
গহীন মহাশূন্যের ছায়পথগুচ্ছ ‘এসএমএসিএস -৭২৩’ পৃথিবীর জন্মের আগে যেমন ছিল, সেটিই উঠে এসেছে জেডব্লিউএসটি-এর তোলা প্রথম ‘ডিপ ফিল্ড’ ছবিতে।
নিজস্ব ওয়েবসাইটে নাসা জানিয়েছে, ওয়েব টেলিস্কোপ ‘এসএমএসিএস -৭২৩’-এর যে ছবিটি তুলেছে, ছায়াপথ গুচ্ছটি সেই অবস্থায় ছিল ৪৬০ কোটি বছর আগে। মজার বিষয় হচ্ছে, বিজ্ঞানীদের হিসেবে পৃথিবীর বয়স আনুমানিক ৪৫৪ কোটি বছর (কম-বেশি পাঁচ কোটি বছর)।
এখন পর্যন্ত কোনো স্পেস টেলিস্কোপের তোলা মহাশূন্যের সবচেয়ে গহীন এবং সবচেয়ে ভালো মানের ইনফ্রারেড ছবি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে এই ছবিকে , কয়েক হাজার ছায়াপথ উঠে এসেছে ছবিটিতে।
মহাকাশ গবেষণা সংস্থাটি জানিয়েছে, পৃথিবীতে মাটিতে দাঁড়িয়ে কেউ যদি এক হাত দূরের একটি ধূলি কণার দিকে তাকান, পৃথিবীর আকাশে ঠিক ওই ধূলিকণার মতোই ক্ষুদ্র জায়গা দখল করে রেখেছে ছবিতে দেখানো ছায়াপথ গুচ্ছ।
নাসা জানিয়েছে, ছবিটি তুলেছে ওয়েব টেলিস্কোপের ‘নিয়ার-ইনফ্রারেড ক্যামেরা (এনআইআরক্যাম)। সাড়ে ১২ ঘণ্টায় বিভিন্ন তরঙ্গের ইনফ্রারেড আলো নিয়ে ‘কম্পেজিট’; ছবিটি ধারণ করেছে এনআইআরক্যাম।
ওয়েব যে ইনফ্রারেড তরঙ্গের ছবি তুলেছে তা হাবল টেলিস্কোপের ক্ষমতার অনেক বাইরে। বিভিন্ন ইনফ্রারেড তরঙ্গের এমন একটি ছবি তুলতে হাবল টেলিস্কোপের কয়েক সপ্তাহ সময় লাগতো বলে জানিয়েছে নাসা।
প্রেসিডেন্ট বাইডেন ১১ জুলাইতেই ওয়েবের একটি ছবি হোয়াইট হাউজে দেখালেও, নাসা ছবির পুরো অ্যালবাম প্রকাশ করে ১২ জুলাই মার্কিন পূর্বাঞ্চলীয় স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ১০টায়, বাংলাদেশের সময়ে যা ১২ জুলাই রাত সাড়ে আটটা। নিজস্ব ওয়েবসাইটে উন্মোচনী অনুষ্ঠান লাইভ প্রচার করে নাসা।
কোনো বস্তু থেকে আলো যখন আমাদের চোখে এসে পড়ে তখন আমরা ওই বস্তুটি দেখতে পাই। খুব সহজ এই কথাটির ব্যাখ্যা আমাদের সাধারণ বোঝাপড়ায় জটিল হতে শুরু করে যখন আমরা অনেক দূরের জিনিস দেখার চেষ্টা করি।
উদাহরণ হিসেবে বলা চলে, চাঁদের দূরত্ব পৃথিবী থেকে মোটামুটি তিন লাখ ৮৪ হাজার কিলোমিটার। আর আলোর গতি হচ্ছে, সেকেন্ডে প্রায় তিন লাখ কিলোমিটার। ফলে যে চাঁদটি আমরা ঠিক এই মুহূর্তে দেখতে পাচ্ছি তা আসলে এক সেকেন্ডের সামান্য আগের চাঁদ।
সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে লাগে প্রায় আট মিনিট ১৯ সেকেন্ড। এর মানে হচ্ছে, ঠিক সূর্যাস্তের সময় আমরা যে সূর্য দেখি তা আসলে আট মিনিট ১৯ সেকেন্ড আগেই অস্ত গেছে। এইভাবে, যতো দূরের বস্তু আমরা দেখি, সেগুলির আসলে তত আগের চেহারা আমরা দেখতে পাই।
নাসার জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ মহাবিশ্বের যে অংশের ছবি তুলেছে, সে অংশ থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে লাগে প্রায় চারশ ৬০ কোটি বছর। ফলে, যে ছবিটি টেলিস্কোপ তুলেছে, সেটি আসলে চারশ ৬০ কোটি বছর আগের চেহারা দেখাচ্ছে।
আজ তাহলে ওই অংশের চেহারা কেমন? সেটি জানা যাবে ওই একই নিয়মে চারশ ৬০ কোটি বছর পরে!
হোয়াইট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের হাতে এই ছবি তুলে দেয়া হয়। তিনিই প্রকাশ করেন জেডাব্লিউএসটি-র তোলা এই অসাধারণ ছবি, যেখানে অসংখ্য গ্যালাক্সি দৃশ্যমান। বাইডেন বলেছেন, ”আমরা ১৩ বিলিয়ান বা এক হাজার তিনশ কোটি বছর আগেকার ছবি দেখছি। কারণ, বিন্দুর মতো যে তারাগুলি রয়েছে, তার আলো আসতে এক হাজার তিনশ বছর সময় লেগেছে।”
প্রথম ছবি প্রকাশের আগে কিছু নমুনা ছবি প্রকাশ করে নাসা। এই ছবিটি গত ৬ জুলাইয়ে প্রকাশ করা হয়। এই টেলিস্কোপ এতটাই শক্তিশালী, যে দাবি করা হচ্ছে এর ফলে মহাকাশ-রহস্যের অনেক কিছুই জানা যাবে । কোন কোন গ্রহ বাসযোগ্য তাও বলে দিতে পারবে এই টেলিস্কোপের ছবি।
মহাকাশে ব্ল্যাক হোল এমনকি আলোও গিলে ফেলে৷ এমন রহস্যময় মহাজাগতিক বস্তু সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের কৌতূহলের সীমা নেই৷ মহাকাশে ভাসমান এই জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ ব্ল্যাক হোলসহ ব্রহ্মাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করতে পারে৷
জেডাব্লিউএসটি হলো সবচেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপ। জেডাব্লিউএসটি-কে মহাকাশে স্থাপন করা হয়েছে ২০২২-এর জানুয়ারিতে। উন্নত প্রযুক্তি ও সূর্যের কাছে এই টেলিস্কোপ থাকায় মহাবিশ্বের অনেক অজানা বিষয় জানতে পারবেন বিজ্ঞানীরা। ছবিতে নাসার তিন বিজ্ঞানীকে দেখা যাচ্ছে, যারা হোয়াইট হাউসে ছিলেন।
আমাদের গ্যালাক্সিতে আছে প্রায় ৮০ হাজার কোটি তারা। আমাদের মিল্কি ওয়ের সবচেয়ে কাছের ছায়াপথটি হল অ্যান্ড্রোমিডা। তাতে রয়েছে দেড় লক্ষ কোটি তারা। তবে নাসার টেলিস্কোপে ধরা পড়া ১৩০০ কোটি বছর পুরোনো এই গ্যালাক্সি আরও বড় বলে জানা গিয়েছে। বিজ্ঞানীদের আশা, এই নয়া তথ্যের সাহায্যে শীঘ্রই বিশ্বের জন্ম রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব হবে। এই আবহে বাইডেনের হাতে প্রকাশিত এই ওয়েব টেলিস্কোপের প্রথম ছবিটি সাড়া ফেলে দিয়েছে বিজ্ঞানী মহলে।
নাসার নয়া জেমস ওয়েব টেলিস্কোপটি আগের হাবল টেলিস্কোপ থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী বলে জানা গিয়েছে। গত বছর ২৫ ডিসেম্বর জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপটি মহাশূন্যের উদ্দেশে রওনা দেয়। পৃথিবীর কক্ষপথ ছাড়িয়ে বর্তমানে প্রায় ১৫ লক্ষ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে এই টেলিস্কোপটি। টেলিস্কোপের মূল লক্ষ্য দু’টি, ব্রহ্মাণ্ডে জ্বলে ওঠা আদি নক্ষত্রগুলির ছবি তোলা এবং দূর-দূরান্তের গ্রহগুলি প্রাণধারণের উপযোগী কিনা, তা খতিয়ে দেখা।
নাসা