৬৯টি দেশ সংকট নিয়ে লড়েছে, ১৭ টি দেশ দেউলিয়ার ঝুকিতে!!

0
156
৬৯টি দেশ সংকট নিয়ে লড়েছে, ১৭ টি দেশ দেউলিয়ার ঝুকিতে!

জাতিসংঘের উন্নয়ন ও বাণিজ্য সংস্থা ইউএনসিটিএডি-আঙ্কটাড সংকটগ্রস্ত দেশগুলো নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যেখানে বলা হয়েছে, বর্তমানে পৃথিবীতে ৬৯টি দেশ শ্রীলঙ্কার মতো সংকট মাথায় নিয়ে লড়ে যাচ্ছে। এসব দেশের সামনে মূলত তিনটি সমস্যা। খাদ্য সংকট, জ্বালানি সংকট ও অর্থনৈতিক মন্দা। ১০৭টি দেশ বসবাস করছে এই তিন সংকটের একটি নিয়ে। তিন সংকটের তিনটি নিয়েই লড়ছে এমন দেশের মধ্যে আফ্রিকায় আছে ২৫টি, এশিয়া-প্যাসিফিকে ২৫টি এবং ল্যাটিন আমেরিকায় ১৯টি। দ্য গার্ডিয়ান।

ইতোমধ্যেই মিশর এবং তিউনিশিয়ার সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে আইএমএফ। দেশ দুটিকে সংকট থেকে বাঁচাতে চায় সংস্থাটি। রাশিয়া এবং ইউক্রেনে উৎপাদিত গমের প্রধান আমদানিকারক এই দুই দেশ। ভারতের প্রতিবেশী পাকিস্তানও আছে শঙ্কার মুখে। বিদ্যুৎ সংকটে আছে দেশটিতে। চড়া দামে আমদানি করতে হচ্ছে বিদ্যুৎ।

এদিকে সাব-সাহারান দেশগুলোকে রাখা হচ্ছে বিশেষ নজরদারিতে। এর মধ্যে ঘানা, কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ইথিওপিয়া আছে তালিকার শীর্ষে। সম্প্রতি আইএমএফের সঙ্গে আর্জেন্টিনা প্রায় ৪ কোটি ৫০ লাখ ডলারের একটি ঋণচুক্তি সই করেছে। লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে এল সালভেদর এবং পেরু আছে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়।

তুরস্ক এখনও ঠিকঠাক দাঁড়িয়ে থাকলেও দেশটি এখন দেউলিয়ার ঝুকিতে। তীব্র অব্যবস্থাপনা আর ৭০ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি দেশটিতে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ভর্তুকি দিয়েই দেশ চালাচ্ছেন।রিজার্ভ কমে যাওয়ায় এমন অবস্থায় পৌছেছে দেশটি ।

ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটের আগে বিশ্বের নিম্ন আয়ের দেশগুলোর মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশই ছিল ঋণে জর্জরিত। যুদ্ধের কারণে দাম বেড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির সঙ্গে বেড়েছে ঋণের বোঝা। এ বিপদ লেবানন, শ্রীলঙ্কায় শুরু হলেও তা সহসা শেষ হচ্ছে না।

প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, একটু একটু করে বৈশ্বিক মন্দার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। দেউলিয়ার খাতায় নাম লেখানোর ঝুঁকিতে রয়েছে বিশ্বের নানা দেশ। পুঁজিবাদ বিশ্বের এই চরম অর্থনৈতিক অস্থিরতার শিকার হলো লেবানন এবং শ্রীলঙ্কা। ‘বৃষ্টির দিনে ছাতা সরিয়ে নেয় ব্যাংক’- লঙ্কার ক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটেছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা কেউই পাশে দাঁড়ায়নি শেষ বেলায়।

লেবানন এবং জাম্বিয়া দেউলিয়া হয়েছে। শ্রীলংকায় চলছে তুলকালাম।  কিছুদিন আগে ফিচ রেটিং প্রকাশিত হয়েছে। সেটি নিয়ে একটি ছোট লেখাও দিয়েছি। ফিচ রেটিং এ ১৭ টি দেশকে দেউলিয়া হবার ঝুকিতে রয়েছে বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।

তুরস্কের কথা না বললেই নয়। জুন ২৩ তারিখে সর্বশেষ রিপোর্টে দেশটির নেট ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ নেমে এসেছে মাত্র $৭.৩৮ বিলিয়ন ডলারে। অর্থনীতিতে ইগো চলেনা। তুরস্কের ক্ষেত্রে কথাটি প্রযোজ্য।  ২০২১ এর মে মাসে তুরস্কের রিজার্ভ ছিল $৮৮ বিলিয়নের বেশি। ২০২২ এর মে মাসেও গোল্ড রিজার্ভ সহ দেশটির রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ৪১.৫ বিলিয়ন ডলারে। সর্বশেষ জুনের ১৭ তারিখের তথ্য অনুযায়ী বিগত ২০ বছরের ভেতর সর্বনিম্ন অবস্থানে এখন তুরস্কের রিজার্ভ।  তুরস্কের CDS  ( Country Default Swaps) স্কোর ৮৩৭ বেসিস পয়েন্ট যা দেশটির ১৯ বছরের ভেতর সর্বোচ্চ। সর্বশেষ ২০০৩ সালে এরকম পরিস্থিতি দেখেছিল তুরস্ক। ২০০৮ এর বিশ্ব মন্দায় CDS পয়েন্ট এত বেশি ছিলনা।

শ্রীলংকার ক্ষেত্রে দেউলিয়া হবার পেছনে যেমন বন্ড গুলির ম্যাচিউরিটি দায়ি ছিল ঠিক তেমনি তুরস্কের ঋনের বৃহৎ অংশ এখন এই বন্ড। সবথেকে বেশি মাথাব্যথার কারন ও এই বন্ড। ১০ বছর মেয়াদি ডলার বন্ড ইয়েল্ড এখন ১০.৬%!

লিরাকে সাপোর্ট দিতে গিয়ে তুরস্ক গত ডিসেম্বর মাস থেকে এই পর্যন্ত প্রায় $৩০ বিলিয়ন ডলার বাজারে ছেড়েছে। এতে রিজার্ভ দ্রুত কমেছে। ২০১৯-২০ সালেও টার্কিস কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফরেক্স মার্কেটে হস্তক্ষেপ করে $১২৪ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছিল। কৃত্রিমভাবে লিরার মান ধরে রাখতে গিয়ে চরম মূল্য দিতে হয়েছে তুরস্ককে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি বলা চলে। ২০২১ সালে লিরার মান ৪৪% পড়ে যায়। মুদ্রাস্ফীতি দাঁড়ায় ৭৩.৫%। ২০২২ সালে এখন পর্যন্ত লিরা মান হারিয়েছে ২৪%। সর্বশেষ রিজার্ভ এমন অবস্থায় পৌছেছে যে দেশটি এখন দেউলিয়ার ঝুকিতে।

মিশর বিগত দুই মাস ধরেই দেশটির ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ নিম্নমুখী।  জুলাই ৭ তারিখে রিজার্ভ নেমে হয়েছে $৩৩.৩৭ বিলিয়ন।

রাশিয়ার ক্ষেত্রে অবস্থাটা ভীন্ন। রাশিয়ার পর্যাপ্ত ডলার থাকার পরো ডেট সার্ভিসিং করার সুযোগ পাচ্ছে না নিষেধাজ্ঞার জন্য। বলা যেতে পারে দেশটিকে অনেকটা জোর করে দেউলিয়া তকমা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। রাশিয়াও ফিচ এর চিহ্নিত ১৭ দেশের তালিকায় রয়েছে।

অন্য দেশগুলির মধ্যে রয়েছে পাকিস্তান, ইথিওপিয়া,  ঘানা, তিউনিসিয়া,  সুরিনাম, এল সালভাদর, বেলিজ, ইকুয়েডর,  তাজিকিস্তান,  ভেনিজুয়েলা, ইউক্রেন, বেলারুশ।

রাশিয়া ইউক্রেন ও বেলারুশ মূলত রুশ ইউক্রেন যুদ্ধের সরাসরি ভিক্টিম। বর্তমান যুদ্ধাবস্থা দীর্ঘমেয়াদে চলতে থাকলে দেউলিয়া হবার তালিকা আরো দীর্ঘ হবে।

বাংলাদেশের রিজার্ভ আকুর পেমেন্ট দেয়ার পর চল্লিশ (৪০) বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে। এই পরিস্থিতিতে যেকোন মূল্যে দেশের  রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখতে হবে। বর্তমানে ডলারের রিজার্ভ কমে যাবার পেছনে মূল কারন উচ্চ মূল্যের এলএনজি, তেল। দৈনিক বিপিসিকে লোকসান গুনতে হচ্ছে ১০০ কোটি টাকার বেশি। $৩.৫ ডলারের এলএনজি $৪০ ডলারেও পাওয়া যাচ্ছেনা। কয়লার দাম ও বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে তেল, এলএনজি ও গ্যাস আমদানি কমানো এখন রিজার্ভ ধরে রাখার প্রধান সাময়িক উপায়। এই মুহুর্তে বড় ধরনের ঝুকি এড়াতে তেলের ব্যাবহার ও চাহিদা কমাতে হবে। বিদ্যুৎ ও এলএনজির ক্ষেত্রে এখন প্রাধান্য দিতে হবে শিল্প। শিল্প প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন ব্যাহত হলে আমাদের রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হবে যা আমাদের রিজার্ভের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।  যেকোন মূল্যে শিল্পে গ্যাস ও বিদ্যুত সরবরাহ বিচ্ছিন্ন করা যাবেনা। জরুরি সেবা যেমন হাসপাতাল বাদে অন্যান্য অফিস গুলির কর্মঘন্টা কমিয়ে আনার কথা আলোচনা হচ্ছে। এটা হলে চাহিদা কমার পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাস বা তেল আমদানি কিছুটা কমানো যাবে।

ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক BRPD সার্কুলারের মাধ্যমে আমদানি নিরুৎসাহিত করতে বিলাস দব্য, ইলেকট্রনিক আইটেমে ১০০% নিজস্ব উৎস হতে মার্জিন নিশ্চিত করার শর্ত জুড়ে দিয়েছে। নিত্য পণ্য বাদে অন্য পণ্যে ৭৫% মার্জিন সংরক্ষনের কথা বলা হয়েছে। এতে আমদানির চাপ কিছুটা কমবে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনভাবে পূর্ন ঝুকি এড়ানো যায়না। দেশের রপ্তানি পণ্যের প্রধান গন্তব্য ইউরোপ ও আমেরিকা। ইউরোপের অর্থনীতি সঙ্কুচিত হলে আমাদের শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হবে। রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফলে রিজার্ভের উপর সৃষ্ট চাপে টাকার মান আরো কমবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাজার হস্তক্ষেপ করার মত পর্যাপ্ত ডলার দেশে নেই। এরকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ এই মুহুর্তে করাও ঠিক হবেনা।

অপচয় রোধ ছাড়া গতান্তর নেই। মিতব্যয়ী হওয়া ছাড়া আর যে উপায় আছে সেটি হল বিশ্বকে অবরোধের কবল থেকে উদ্ধার করে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনা।