কাঁকড়ার সংস্কৃতি এবং বাঙ্গালী

0
12

কাঁকড়ার সংস্কৃতি এবং বাঙ্গালী

-সরওয়ার জাহান

বিভিন্ন লেখক তাদেঁর গল্পে,বিভিন্ন আড্ডায় বা অনেক সময় একক হাসির মঞ্চেও রম্য রস দিয়ে বাঙালি সমাজের চরিত্র বিভিন্ন ভাবে ফুটিয়ে তুলার চেষ্টা করেন । তার মধ্যে অন্যতম বাঙ্গালীর কাঁকড়া সংস্কৃতি অন্যতম। বিশিষ্ঠ গল্পকার বন্ধুদেব গুহের প্রসিদ্ধ উপন্যাসের একটি গল্পেও তা উল্লেখ করেন। কাঁকড়ার সংস্কৃতি প্রসঙ্গে এক সময় ভারতের রাজনিতিতেও আলোচনায় উঠে আসে।

কাঁকড়ার সংস্কৃতি সারা দুনিয়ায় একই। কিন্তু অন্যান্য দেশের মানুষের সাথে কেউই এর তুলনা না করলেও  বাঙ্গালীর সাথে কাঁকড়ার সংস্কৃতি সম্পর্কে অনেকেই অবগত। ইদানিং সমাজে  কাঁকড়া সংস্কৃতির প্রবণতা ব্যবহার বেশ বেড়েছে। চলছে কাদা ছোড়াছুড়ি। সন্দেহ, বিশ্বাসের থেকে অবিশ্বাস বড় হয়ে উঠেছে। শুধুমাত্র অতীতের গৌরব ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। সহনশীলতার থেকে অসহিষ্ণুতা বড় হয়ে যাচ্ছে। প্রশংসাকে ভুলতে বসেছে বেশিরভাগ মানুষ। কাঁকড়া সংস্কৃতির এই চোরাবালি থেকে বের হতে না পারলে বাঙ্গালী আবার নতুন করে কোন ইতিহাস গড়তে পারবে না। আর তাই বাঙ্গালীরা পিছিয়ে পড়ছে । বর্তমান যুগে এই কাঁকড়া-নীতির কোপানলে পড়ে যোগ্যতা-মেধা থাকা সত্ত্বেও পদ-পদবী ও প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকতে হচ্ছে। সভাবগত ভাবে কাঁকড়া সংস্কৃতিতে কাঁকড়া এ কাজে বেশ পারদর্শী। আমাদের যেমন জাতিগত কিছু বৈশিষ্ট আছে ঠিক তেমনি কাঁকড়ার ও কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। তাই অনেকে কাঁকড়ার সাথে বাঙালির চরিত্র খুঁজে পায়। যদিও এই বৈশিষ্টগুলোর মধ্যে কাঁকড়া ও মানব জাতির মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে।

“কাঁকড়ার সংস্কৃতি বা মানসিকতা” শব্দটি এমন একটি আচরণকে বর্ণনা করার জন্য ব্যবহৃত হয় যেখানে একটি গোষ্ঠীর ব্যক্তিরা সফলতা অর্জনকারী বা তাদের অবস্থার উন্নতি করার চেষ্টা করে এমন কাউকে দুর্বল করার বা টেনে নামানোর চেষ্টা করে,এই আচরণটি প্রায়শই হিংসা,সন্দেহ, অবিশ্বাস নিরাপত্তাহীনতা এবং পিছনে ফেলে যাওয়ার ভয়কে দায়ী করা হয়। এটি বিভিন্ন সামাজিক, পেশাগত এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে দেখা যায়।

আমরা আমাদের সমাজকে কাঁকড়ার ঐ পাত্রে পরিণত করে একজন আর একজনকে উপর থেকে নামানোর জন্য অনবরত কাজ করে যাই । যতক্ষণ না নামানো যায় ততক্ষণ নানাবিধ অপকর্মে লিপ্ত থাকি। আর তা হোক একে অপরের প্রতি মিথ্যা অপবাদ,কটূক্তি ,অশালীন বাক্য ব্যাবহার,অথবা উচ্চ পদে বসে বিভিন্ন কৌশল ব্যাবাহার করে নাজেহাল করা। কোনটাই যেন আজ আমাদের কাছে কঠিন নয়। হিংসা-বিদ্বেশ অনবরত লেগেই আছে। কথা শুনলে মনে হয় বাক্যের শালীনতা যেন ফুঁড়িয়ে গেছে। কোথাও শান্তি নেই। এর ফলে , আমরা পিছিয়ে আছি। জাতিগত ভাবে পিছিয়ে যাচ্ছি। ব্যক্তিগত ভাবেও পিছিয়ে যাচ্ছি। অনেক মুকুল ফুল হওয়ার আগেই ঝড়ে যাচ্ছে। জেনে ও না জেনে আমরা কাঁকড়ার চরিত্রের মত নিজের ক্ষতি করে ফেলছি । কাঁকড়ার চরিত্র অনেক ক্ষেত্রে মূর্খতা,প্রলোভন,ঈর্ষাকাতরতা,থেকেই বেশীরভাগ সময় আমাদের মাঝে ভর করে।

বাঙ্গালীর কাঁকড়া সংস্কৃতির প্রসঙ্গটি পশ্চিমবঙ্গ তথা গোটা ভারতের রাজনৈতিক মহলে ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে বিগত শতকের নব্বইয়ের দশকের শেষার্ধে । ভারতে সে সময়টিতে  রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছিল। ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনে এককভাবে কোনো দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় ভারতে তখন ঝুলন্ত সরকার আসে। একে একে দু-তিনজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়। এ সময় বিরাজমান পরিস্থিতির আলোকে বর্ষীয়ান কমিউনিস্ট নেতা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার একটি সুবর্ণ সুযোগ দেখা দেয়। শপথ নেয়ার বিষয়টি ছিল তখন সময়ের ব্যাপার। জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ প্রশ্নের জবাবে সংবাদকর্মীদের বলেন,সুযোগ সৃষ্টি হলেও মূলত‘কাঁকড়া-নীতির’কারণে পশ্চিমবঙ্গবাসীর আশা নিরাশায় রূপ নেয়। ফলে, পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারত প্রথমবারের মতো বাঙ্গালী প্রধানমন্ত্রী হওয়া থেকে বঞ্চিত হলো ।

কাঁকড়া সংস্কৃতির কারণে প্রশাসনিক ও আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে যোগ্য,দক্ষ ও উপযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও পদ-পদবি এবং পদোন্নতি পাওয়া থেকে দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত করা হয় বা বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে, এমন উদাহরণ চারপাশে ভূরিভূরি রয়েছে।‘আমি হতে পারি না বা হতে পারিনি;কিন্তু তোমাকেও হতে দিইনি,হতে দেব না;যেভাবেই হোক ঠেকিয়ে দেব বা ঠেকিয়ে দিয়েছি!’-আরও কত ধরনের আত্মপ্রবোধ! রাজনৈতিক দল,সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন,এমনকি খোদ সরকারি-বেসরকারি প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও এমনটি হরহামেশাই লক্ষ করা যায়।

এক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তো সর্বাগ্রগণ্য। স্কুল,কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে এহেন হীনচর্চা থেকে খুব কম প্রতিষ্ঠানই মুক্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি,প্রোভিসি,ট্রেজারার,রেজিস্ট্রার,ডিন,বিভাগীয় প্রধান,বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কমিটির প্রধান ও লোভনীয় পদ এবং সম্মান! পদ-পদবি এবং পদোন্নতির জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বিপনন বিভাগের দুই শিক্ষক আদলতে গিয়েছিলেন বা যেতে হয়েছে । পদোন্নতির জন্য ২০০৬ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক খুন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপককে,অথচ এই সহযোগী অধ্যাপক তারই এক সময়কার ছাত্র । পদোন্নতি স্থগিত চেয়ে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘিত হবে দাবি করা ২০১৯ সালে হাইকোর্টে আবেদন করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের দুই শিক্ষক ।

কাঁকড়া-সংস্কৃতিতে নিজেরাই নিজেদের মধ্যে সব সময় লড়াইয়ে ব্যস্ত থাকে! তদুপরি যদি দেখা যায় যে কোন কেউ নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টায় ব্যস্ত তখন বাকিরা এক হয়ে তাঁর পেছনে লেগে যায় যেন সে মুক্ত হতে না পারে! এই সংস্কৃতি হিংসাত্মক না হয়ে প্রতিযোগিতামূলক হলে সমাজ উপকৃত হতো। অথচ কাঁকড়া-সংস্কৃতির কারনে প্রতিষ্ঠান সমাজ দেশ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পক্ষ অবলম্বন করছে।

যে দেশে প্রতিনিয়ত আগে মুসলমান না বাঙ্গালী এই প্রশ্নে জাতিকে বিভাজিত করার অপপ্রচেষ্টা করা হয়, মুসলমানদের মাঝে সুন্নি, শিয়া,ওয়াহবী, সালাফী নিয়ে ধর্মীয় নানা জাতিসত্ত্বায় বিভাজন করা অতি সহজ। আর আমরা নিজেকে যতই শিক্ষিত বলে দাবী করি না কেন আদতে আমরা সনদধারী অশিক্ষিত বর্বর হিসেবেই আত্মপ্রকাশে মত্ত! নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে আমজনতা সবাই একই সংস্কৃতিতেই আছি । আমরা সনদধারী অশিক্ষিতরাই এই পরিণতির জন্য অধিকাংশ দায়ী।

কাঁকড়ার সংস্কৃতি থেকে আমরা ভালো হতে পারি। একে অপরকে নিচে টানার পরিবর্তে আমরা একে অপরকে সমর্থন করতে পারি। কর্মক্ষেত্রে সহকর্মির পদোন্নতিতে খুশি হতি পারি ।কারন সে তার যোগ্যতার কারনেই  পদোন্নতি পেয়েছে। অন্যদেরও চেষ্টা করা উচিৎ।

আমদের সমাজে এমন কিছু মানুষ আছে অর্থ বিত্ত-সামর্থ সবই আছে,সঠিক পরিকল্পনা বা ধারণা না থাকায় কাঁকড়ার সংস্কৃতিতে জড়িয়ে পড়ে। আর কিছু মানুষ আছে, অর্থ বিত্ত-সামর্থ নাই, সঠিক পরিকল্পনা বা ধারণাও নাই তবে নিজেকে খুবই যোগ্য মনে করে, কার্যত এরাও কাঁকড়ার সংস্কৃতিতে জড়িয়ে পড়ে । আর কিছু মানুষ আছে পরিকল্পনা বা ধারণা আছে,নেই শুধু অর্থ-বিত্ত এরা কাঁকড়ার সংস্কৃতির জ্বালে আবদ্ধ থাকে ।  বাঙ্গালীর মানসিকতার কারনে আজ কাঁকড়ার সংস্কৃতির সাথে আমাদের তুলনা করা হচ্ছে। অথচ এই কাঁকড়া সব দেশেই আছে, কিন্তু সেই দেশের মানুষগুলো এই সংস্কৃতিতের উর্ধে।

স্থির মানসিকতার লোকেরা বিশ্বাস করে যে তাদের চরিত্র, বুদ্ধিমত্তা এবং সৃজনশীল গুণাবলী স্থির এবং উন্নত করা যায় না। এই কারণেই তাদের মধ্যে চ্যালেঞ্জ এড়ানো, সহজে হাল ছেড়ে দেওয়া, প্রচেষ্টাকে অকেজো করা, প্রতিক্রিয়া উপেক্ষা করা এবং অন্যদের সাফল্যের দ্বারা হুমকি বোধ করার প্রবণতা থাকে। তাই চ্যালেঞ্জিং কাজ করার পরিবর্তে এবং নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে, তারা স্বাভাবিকভাবেই “শীর্ষে থাকার” উপায় হিসাবে অন্যদেরকে নীচে টেনে ধরে।

যে কোনো সময় আপনি সফল হয়েছেন; যে কোনো সময় যখন আপনি বিশ্বাসের ঝাঁপ ফেলেছেন বা এমনকি আপনার বড় পরিকল্পনার কথা বলেছেন, সেখানে সর্বদাই আপনার বিপরীতে  কেউ না কেউ থাকবেই, আর তা শুরু হয় নিজের বাসগৃহ থেকেই। আমরা সবাই গতানুগতিক কাজে অভস্থ । নতুন কিছু নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা কেউ পছন্দ করে না। কারণ সিস্টেমটি তৈরী করা হয়েছে ধাবিয়ে রাখার জন্য।এটি এ এক ভয়ঙ্কর ধারণা। তা এক মাত্র আমাদের সমাজেই আছে।

এই কাঁকড়া মানসিকতা থেকে মুক্ত হতে হলে, যে কোনো পরিবেশে নিজের প্রতি অবিচল আস্থায় নিজেকে আবিষ্কার করে নিতে হবে । উদাহারণসরুপ আমরা যদি ভিক্টিমের মত থাকি, তাহলে কখনই এই পরিবেশ থেকে মুক্ত হতে পারবো না যা আমাদেরকে সীমিত-চিন্তার সীমার মধ্যে নোঙর করে রাখে।

জীবনের বাস্তবতা হল সমাজে এমন কেউ থাকবে যিনি আপনার চেয়ে ধনী,সুকৌশুলী , বুদ্ধিমান, ভাগ্যবান এবং সম্ভবত আপনার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সফল। সুতরাং আপনি যদি ক্রমাগত নিজেকে অন্যের সাথে তুলনা করেন এবং তাদের সাফল্য আপনাকে হ্রাস করতে দেয়, তাহলে স্ব-মূল্যের একটি স্থিতিশীল অনুভূতি থেকে কাজ করা অবিশ্বাস্যভাবে প্রতিষ্ঠিত করা কঠিন হবে এবং আপনি জীবনে সর্বদা ছোটই থাকবেন।

অধ্যাপক সরওয়ার জাহান : উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা, সাদার্ন ইউনিভার্সিটি; এবং টেকসই উন্নয়নকর্মী