দেশে আকস্মিক বন্যায় বানভাসী মানুষের পাশে মানুষ
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে দেশের পূর্ব সীমান্তবর্তী ১২টি জেলায় ।লক্ষ লক্ষ মানুষ পানিবন্দী, গৃহহীন, খাবারবিহীন অবস্থায় রয়েছেন। ২৯শে আগস্ট পর্যন্ত বন্যায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৭২ হয়েছে। ৮টি নদীর পানি বিপদসীমার উপরে উঠার ফলে কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী এবং মৌলভীবাজার জুড়ে ৫০ লাখ এর বেশী মানুষ আটকা পড়েছে। মুহুরী ও গোমতী নদীর পানির উচ্চতা ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এতটাই করুণ, যা কল্পনাতীত।
বানের পানিতে আটক মানুষদের উদ্ধারে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ট্রাকে করে নৌকা, স্পিডবোট নিয়ে বন্যা প্লাবিত এলাকায় যাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবী মানুষজন। অনেকে কাভার্ড ভ্যান, পিকআপ, মাইক্রোবাসে করে নিয়ে যাচ্ছেন শুকনো খাবার, ঔষধ, নিরাপদ পানি, চাল-ডাল। সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের একদিনের বেতন ত্রাণ তহবিলে দান করেছে। এছাড়াও, দেশের মোবাইল অপারেটরগুলি বন্যা দুর্গতদের জন্য বিনামূল্যে টকটাইম এবং ইন্টারনেট পরিষেবা দিচ্ছে।
সাধারণ মানুষজনও সামর্থ্য অনুযায়ী স্বেচ্ছাসেবীদের কাছে টাকা-পয়সা, ত্রাণসামগ্রী দিচ্ছেন। পাবলিক কিংবা প্রাইভেট সেক্টরের সবাই যার যার জায়গা থেকে দাঁড়াচ্ছেন বানভাসী মানুষদের পাশে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই বলছেন, দুর্যোগ ঘিরে এমন ‘একতাবদ্ধ বাংলাদেশ’ আগে দেখেননি তারা।
বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে রোল মডেল হিসেবে পরিচিত । দেশটির ইউনিয়নের ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের অধীনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি রয়েছে। কিন্তু ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়ে দেশত্যাগ করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিরা পালিয়ে থাকায় স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাপনা র্দুবল হয়ে পড়েছে। অতি বৃষ্টি ও বন্যার পূর্বাভাস থাকলেও ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর পাশাপাশি মানবিক বিপর্যয় মোকাবেলায় তেমন কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না। তবে, স্থানীয় সরকারের অধীনে স্বেচ্ছাসেবকদের নেতৃত্বে প্রস্তুতি ও ত্রাণ প্রচেষ্টা দেখা না গেলেও বন্যার্তদের পাশে সাধারণ মানুষ একসাথে এগিয়ে এসেছেন। বন্যার্তদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী, নৌ-বাহিনী, কোস্টগার্ড মোতায়েন করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর মেডিক্যাল টিমও চিকিৎসাসহায়তায় কাজ করছে।
বাংলাদেশ ও ত্রিপুরা রাজ্যের ওপর রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয় , তার পূর্বাভাস ১০ দিন পূর্বে দেওয়া সম্ভব ছিল। উজানে ভারতের ত্রিপুরা থেকে বাঁধের গেট খুলে দেওয়ার পর নেমে আসা ঢল ও প্রবল বর্ষণে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় আকস্মিক বন্যা দেখা দিয়েছে। পানিবন্দী ও ক্ষতির মুখে পড়েছেন লাখ লাখ মানুষ। এপর্যন্ত ৫৮ জন মারা গেছেন বলে জানা গেছে। আগস্ট মাসের মোট বৃষ্টিপাতের চেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়। এই রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিই হলো রেকর্ড পরিমাণ বন্যার প্রধানত কারণ।
কুমিল্লা জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত গোমতী নদী ও ফেনী জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত মুহুরী নদীর উজানে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে একাধিক বাঁধ দিয়েছে ভারত সরকার। সেখানে আছে ব্যারেজও। এসব বাঁধ ও ব্যারেজ কোনোটি পানি সংরক্ষণের ,কোনোটি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কিংবা কৃষি কাজের জন্য। এসব ড্যাম ও ব্যারাজ পানিতে পূর্ণ ছিল। ১৯ আগস্ট সকাল ৯টার পর থেকে শুরু করে ২০ আগস্ট সকাল ৯টা পর্যন্ত মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ত্রিপুরা রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ২০০ থেকে ৪০০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের কারণে ত্রিপুরা রাজ্যের সব ড্যাম ও ব্যারাজের পানি ধারণক্ষমতার সীমায় পৌঁছে যায় এবং ২০ আগস্ট রাতে হঠাৎ করেই বেশির ভাগ ড্যাম ও ব্যারাজের গেট খুলে দেয় ত্রিপুরা রাজ্য কর্তৃপক্ষ। ত্রিপুরা রাজ্য কর্তৃপক্ষ কিংবা ভারত সরকার ভাটি অঞ্চলে অবস্থিত বাংলাদেশ সরকারকে ড্যাম ও ব্যারাজের গেট খুলে দেওয়া সম্পর্কে আগে থেকে কোনো রকম তথ্য দেয়নি বা দিতে ব্যর্থ হয়।
১২টি জেলার ৫০ লক্ষেরও বেশি মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিন লাখেরও বেশি মানুষ কয়েক হাজার জরুরি আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন, যাদের জন্য সাহায্য, আবাসন এবং পুনর্বাসনের জরুরী প্রয়োজন।
বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা ঢলে এসব জেলায় বন্যা নতুন কিছু নয়। কিন্তু এবারের বন্যা ভয়াবহতায় আগের সব বন্যাকে ছাড়িয়ে গেছে। বন্যা কবলিত এলাকার বাসিন্দারা এমন ভয়াবহ বন্যা তাদের জীবদ্দশায় দেখেননি বলে জানিয়েছেন। গ্রামের পর গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। সবার বাড়িঘরেই বন্যার পানি।
যেকোনো দুর্যোগে মানুষ মানুষের পাশে ছুটে যায়- এটিই বাংলাদেশের অন্যতম সৌন্দর্যময় বৈশিষ্ট্য। এবারের বন্যায় সেই দৃশ্যই আবার দেখা গেল।