প্রাচীন উপমহাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার গোড়ার কথা

0
879

প্রাচীন উপমহাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার গোড়ার কথা

ডা. দিলিপ দে

ইতিহাসকথা

বিখ্যাত লেখক স্যার অরিয়েল স্টেইন (১৮৬২-১৯৪৩) বলছেন- পুতঃসলিলা সরস্বতী নদীর উৎপত্তি ছিল হিমালয় থেকে, এবং এটা ছিল অনন্ত জলরাশির উৎস। তবে একদিন সরস্বতী’র এই অবারিত ধারা শুকিয়ে গেলে তার তীরে বর্ধিষ্ণু মানবসমাজ সেখান থেকে সরে যায়। (ভারতীয়রা এখনো সরস্বতী নদীকে খুঁজছে এবং ইদানিং ২০১৫ সালে ভারতের কিছু এলাকায় এ নদীর প্রাচীন প্রবাহমানতার অংশবিশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে।)

হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো ছিল যথাক্রমে রবি নদ এবং সিন্ধু নদের তীরে অবস্থিত দ্রাবিড়দের সৃষ্ঠ প্রাচীন নদীমাতৃক সভ্যতা। মোটা দাগে এটাকে সিন্ধু সভ্যতা বলা হয়। এ সভ্যতা রাজস্থান থেকে সিন্ধু হয়ে পাঞ্জাব পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ১৯২০ সালের মহেঞ্জোদারো’র খনন কার্যে আবিষ্কৃত হয় পোড়া ইটের তৈরী নানা স্তর ও উচ্চতা বিশিষ্ট ভবন, প্রশস্ত ও বিস্তৃত সড়ক ব্যবস্থা, শহর পরিকল্পনায় উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, গণ স্নানাগার, খাদ্যশস্য মজুদ রাখার ব্যবস্থা, তুলা গম যবের চাষ, গরু বৃষ কুকুর বিড়াল ইত্যাদি পশুপালন, হরপ্পায় প্রাপ্ত পাথরের তৈরী নটরাজের মূর্তি, প্রসাধন সামগ্রী, এর অধিবাসীরা প্রস্তর ও লৌহ যুগ মধ্যবর্তী ব্রোঞ্জ যুগের মানুষ বিধায় ব্রোঞ্জ ও তামার নানা ব্যবহার যথা মহেঞ্জোদারোয় নৃত্যরতা নারী মূর্তি, প্রাপ্ত নানা সিলমোহর- ইত্যাদি থেকে প্রতীয়মান হয় যে একদা এখানে এক উন্নত সুশৃংখল সভ্য ও সহিষ্ণু জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। এসবের কার্বন ডেটিং-এ দেখা গেছে এ সভ্যতা অন্ততপক্ষে খ্রী.পূ. ২৫০০ বছর আগের। অপরদিকে, লক্ষণীয় যে, একমাত্র বেদ ছাড়া ভারতে আর্যদের বসবাসের কোন প্রাতিষ্ঠানিক প্রমাণ নেই। আর অশ্ব হচ্ছে বৈদিক আচারানুষ্ঠানের একটি অন্যতম অঙ্গ। যজ্ঞে যুদ্ধে আর্যরা ঘোড়া ব্যবহার করতো। সংস্কৃতকে প্রায় দশ হাজার বছর আগের ইন্দো ইউরোপীয়ান ভাষার একটা শাখা হিসেবে ধরা হয়। আর্যরাই এটা বহন করে নিয়ে এসেছিল বলে জগৎজোড়া স্বীকৃতি পায়। আর্যরা এই ভাষার বাহক বহিরাগত জনগোষ্ঠী। অন্যদিকে দ্রাবিড়রা ছবি দিয়ে তৈরী ভাষা ব্যবহার করতো কারণ তখনো তাদের কোন বর্ণমালা ছিল না এবং ঘোড়ার ব্যবহারও তারা জানতো না। স্বভাবতঃই যুদ্ধক্ষেত্রে এ এক বিরাট দূর্বলতা, এক বিরাট ঘাটতি হিসেবে দেখা দেয়।

সরস্বতী নদী শুকিয়ে গিয়েছিল আর তাই তার তীরের জনগোষ্ঠী সরে গিয়েছিল। সিন্ধু নদ এখনো বহাল তবিয়তে বর্তমান। এই সিন্ধু সভ্যতার নির্মাতাদের ক্ষেত্রে কি ঘটেছিল এবং লোকগুলো রাতারাতি সব ছেড়ে কেন বা কোথায় পালালো এ প্রশ্ন প্রতœতাত্মিক ও সমাজবিজ্ঞানীদের বারংবার ভাবিত ও বিচলিত করেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ- যেমন জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির আগ্নুৎপাতের কোন প্রমাণ মেলেনি বিধায় এই দ্রাবিড়ীয় জনগোষ্ঠীর হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার বিষয়ে একটা ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা উদ্ভুত হয়। আগন্তুক গোষ্ঠীর উপর্যুপরি আকস্মিক ও সহিংস আক্রমণ এ জনগোষ্ঠীকে অনেকটা নিশ্চিহ্ন ও ক্রমাগত তাদেরকে দক্ষিণ ভারতের দিকে ধাবিত করেছে বলে গবেষকগণ মনে করছেন। ককেশীয় অঞ্চল থেকে ইরান হয়ে আসা এই আক্রমণকারী আগন্তুক গোষ্ঠীকে আর্য হিসেবে চিহ্নিত করে তাদেরকেই দ্রাবিড়দের আরো দক্ষিণে পশ্চাদপসারণের কারণ হিসেবে গবেষকগণ বর্ণনা করেছেন।

ইদানীং কেউ কেউ বলছেন, “আর্য নামক কোন বহিরাগত জনগোষ্ঠী ভারতে আসেনি”। হতে পারে। তবে আর্যদের মূল ধর্মগ্রন্থ ঋগে¦দেই আর্য শব্দটি ছত্রিশবার উল্লেখিত। আর, আর্যরা যদি ভারতেরই একটি জাতিগোষ্ঠী হয়ে থাকে, তাহলে পাশাপাশি বসবাসকারী দ্রাবিড়দের চাইতে তারা নগর সভ্যতার সঙ্গে একেবারেই পরিচিত নয় কেন? তারা মূলত পশুপালক ও শিকারী জনগোষ্ঠী। যুদ্ধে ইরানীয়দের মতো প্রবল পারঙ্গম কেন? তাদের খাদ্য মূলতঃ ফলমূল মাংস ইত্যাদি। অন্যদিকে দ্রাবিড়দের ওখানে যব, ভুট্টা ইত্যাদির আড়ত আবিষ্কৃত হয়েছে। আর্যদের ভাষা লিখিত ভাষা অথচ দ্রাবিড়দের তা নেই। তাদের মূল বাহন ঘোড়া অথচ দ্রাবিড়রা ঘোড়ার সঙ্গে পরিচিতও নয়। তা নেইÑএসব কি করে সম্ভব সে প্রশ্নও সঙ্গত এবং তা উত্থাপিতও হচ্ছে।

আজকের আলোচ্য বিষয়, ভারতীয় চিকিৎসা শাস্ত্রকে সিন্ধু সভ্যতা পর্যন্ত বিস্তৃত করা যায়। সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরা যে বৃক্ষজ, প্রাণীজ, অজৈব প্রাকৃতিক পদার্থ খনিজ বা আকরিক পদার্থ ব্যবহার করতো তার নানা প্রমাণ মেলে। যেমন একটি উৎখননে সিলাজত পাওয়া যায়, তার মানে প্রাচীন মহেঞ্জোদারো’র লোকদের জনজীবনে এর প্রয়োগ ও ব্যবহার ছিল। বিস্তারিত কোন তথ্য পাওয়া না গেলেও আর্বান জনজীবনে যেখানে নগর পরিকল্পনা থেকে শুরু করে সব কিছুই একটি সুশৃঙ্খল পদ্ধতির মাধ্যমে চলতো সেখানে চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা বা ধারণা ছিল না এটা কল্পনা করা কঠিন।

এরপরের গাঙ্গেয় বৈদিক সভ্যতা খ্রী.পূ. অন্যূন হাজার বছর অর্থাৎ আজ থেকে অন্তত: তিন হাজার বছর আগের। আর্যদের এ সভ্যতায় ধ্বনিত ঋগে¦দে ধন্বন্তরীÑকে শ্রী বিষ্ণু’র ১৭তম নবমূর্তিতে আবির্ভাব হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। ধনন্তরী হচ্ছেন চিকিৎসা শাস্ত্রের দেবতা। অর্থাৎ চিকিৎসার একটা ভিন্ন ব্যবস্থা সেই আদিকাল থেকে ভারতে বিদ্যমান ছিল। অন্যদিকে অশ্বিনীদ্বয় ছিলেন দুর্ভাগ্য ও রোগ নিরাময়কারী দেবতা। তাঁরা দুজনে দেব চিকিৎসক এবং আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শাস্ত্রের দেবতা। আয়ুর্বেদ মানে আয়ুবৃদ্ধি সম্পর্কিত বেদ অথবাÑ দীর্ঘায়ু বিজ্ঞান। আয়ুর্বেদ প্রাচীন ভারতের মুখ্য চিকিৎসা ব্যবস্থা। এটি প্রাচীন ভারতের লৌকিক স্থানীয় এবং মূলতঃ ভেষজ চিকিৎসা ব্যবস্থাÑ যা রোগ নিরাময়ে বিশেষতঃ তৎকালেÑ সীমাহীন অবদান রেখেছে।

শুশ্রুত সংহিতা ও চরক সংহিতা ভারতের প্রাচীনতম চিকিৎসা বিষয়ক গ্রন্থ। এই আকর গ্রন্থদ্বয়ে রোগের উপসর্গ রোগ নির্ণয় এবং সম্ভাব্য নিরাময়ের বর্ণনা রয়েছে।

এ সম্পর্কিত জ্ঞান একটা সুশৃঙ্খল নিয়ম প্রণালী-পদ্ধতিতে মুনি-ঋষিদের মধ্যে যুগ ও প্রজন্ম-পরম্পরায় লিপিবদ্ধ করা ব্যতিরেকে কেবল তাঁদের স্মৃতিতে ধারণ ও বিস্তৃত হতে থাকে। সাধক ও পরিব্রাজক সন্ন্যাসীদের মাধ্যমে এটা নানা স্থানে ছড়ায়। তবে পরে স্থানীয়ভাবে যারা এই বিদ্যা আয়ত্ত ও চর্চা করতেন তাদেরকে বৈদ্য বলা হতো এবং তারা মূলতঃ ছিলেন ব্রাহ্মণ শ্রেণীভুক্ত।

প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে চিকিৎসাকে আটটি অংশের বিজ্ঞান হিসেবে শ্রেণী বিন্যাস করা হয় যা নি¤œরূপÑ ১. কায়া চিকিৎসা (জেনারেল মেডিসিন), ২. কৌমারÑর্ভত্য (শিশু কিশোর চিকিৎসা), ৩. শল্য চিকিৎসা (শল্য বিদ্যা), ৪. শালাক্য তন্ত্র (চক্ষু ও নাক-কান-গলা চিকিৎসা), ৫. ভূত বিদ্যা (অপদেবতা, মনোরোগ সম্পর্কিত বিদ্যা), ৬. আগড় তন্ত্র (বিষক্রিয়া সম্পর্কিত) ৭. রসায়ন তন্ত্র (নানাবিধ দ্রব্য সহকারে তরল ঔষধি প্রস্তুতকরণ বিদ্যা), ৮. বাজিকরণ তন্ত্র ও আফ্রোডিজিয়াক। হাজার হাজার বছর পরেও বর্তমান বিশ্ব চিকিৎসা ব্যবস্থায় এই শ্রেণী বিন্যাসের কোনটাই অপাংক্তেয় বা পরিত্যাজ্য হয়ে যায়নি।

আয়ুর্বেদ হচ্ছে বৈদিক রীতি মতে উপবেদ (বা বাড়তি জ্ঞান) গোত্রীয়, ঋগে¦দের উত্তরখ- তথা সম্পূরণী অংশ বা পরিশিষ্টে এর অন্তর্ভূক্তি থাকলেও অথর্ববেদকে আয়ুর্বেদের মুখ্য উৎস হিসেবে গণ্য করা হয়। অথর্ব বেদের সংহিতা অংশে রোগ নিরাময়ের জন্য ১১৪টি স্ত্রোত্রগীত বা জাদুবিদ্যার মন্ত্রোচ্চারণমূলক শ্লোক আছে। চরক তাঁর সংহিতায় উল্লেখ করেন যে চিকিৎসকরা অথর্ব বেদ সংলগ্ন থাকা বিধেয়। আয়ুর্বেদকে পাঁচ হাজার বছরের পুরানো চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে অনেকে বিবেচনা করেন। আয়ুর্বেদের উৎস সম্পর্কে নানা পৌরাণিক কাহিনী বর্তমান। এর একটি হচ্ছে চিকিৎসক ধন্বন্তরী (বা দিবোদাস) এই বিজ্ঞান ব্রহ্মার কাছ থেকে প্রাপ্ত হয়েছিলেন। এটাও প্রচলিত আছে যে, ঋষি ভরদ্বাজের শিষ্য ঋষি অগ্নিবেশ এর রচিত এটি, যা শ্রবণ পরম্পরার মাধ্যমে স্মরণে রাখা হতো, সংরক্ষিত ও বিস্তৃত হতো, পরে এসে এটা গ্রন্থে রূপ পায়।

আয়ুর্বেদ যারা চর্চা ও প্রয়োগ করতেন প্র্যাকটিস করতেন সেইসব চিকিৎসকদের মধ্যে আত্রেয়, অগ্নিবেশ, চরক ও শুশ্রুত অন্যতম। আত্রেয় ও অগ্নিবেশ এর মতো ঋষিগণ খ্রীঃ পূঃ ৮০০অব্দে আয়ুর্বেদের মূল সূত্র নিয়ে পা-িত্যপূর্ণ ব্যাখ্যা করেছেন। সুবিখ্যাত চিকিৎসক অগ্নিবেশ সেই সময়ে বিস্তৃত তথ্যপূর্ণ চিকিৎসা সম্পর্কীয় জ্ঞানকোষ রচনা করেন। তাঁদের কাজ ও অন্যান্য অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে চরক চিকিৎসা সম্পর্কীয় সূত্র ও চর্চা তথা চরক সংহিতা রচনা করেন যা দুই সহস্রাধিক বৎসর যাবৎ ভারতীয় চিকিৎসা ব্যবস্থার ভিত্তিভূমি হিসেবে কাজ করেছে। প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসা বিষয়ক গ্রন্থের একটি মানদন্ড বা মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে, অনুদিত হয়েছে আরবী ল্যাটিন সহ নানা ভাষায়। বলা হয়ে থাকে, চরক সংহিতা তার প্রাথমিক রূপে খ্রী.পূ. ৯০০ থেকে খ্রী.পূ. ৬০০ বৎসর আগের। এই সংহিতায়Ñ শরীরের নানা অভ্যন্তরীণ ও স্বাভাবিক কর্মকান্ড (ফিজিওলজি) রোগের উৎপত্তি ও কারণ (ইটিয়োলজি), ভ্রুণ তত্ত্ব (এম্ব্রায়োলজি), হজমপ্রক্রিয়া (ডাইজেস্সান), বিপাক প্রক্রিয়া (মেটাবোলিজম), রোগ প্রতিরোধের বিষয় (ইম্যুনিটি)’সহ শ্রেণীবদ্ধ ভাবে শরীর বিষয়ক প্রায় সকল মূল বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে। জেনেটিকস্ এর একবারে প্রাথমিক পর্যায়ের ধারণার সন্ধানও এ সংহিতায় বর্তমান। চরক সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারক হিসেবে কোন কোন বিষয় গুরুত্বপূর্ণ তার আলোচনা করেন। চরক বলছেনÑ বাবা মাÑর দোষে ছেলে জন্মান্ধ হয় না, এটা একবারে ভ্রুণ থেকে আসে। যোগ ব্যায়াম হচ্ছে মানব শরীর ও মনের উৎকর্ষের জন্য বিশেষ ধরনের শারীরিক কসরৎ। এটা প্রাচীন ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থার অন্যতম অংশ ছিল। খ্রীস্ট জন্মের বহু আগে থেকেই এ ভূখন্ডের প্রয়োগ থাকলেও ঋষি পতঞ্জলি খ্রী.পূ. ২০০ অব্দে যোগের সকল মূল বিষয়গুলো মূল উপাত্তসমূহ সংগ্রহ করেন। পতঞ্জলি লিখেন যে, যোগচর্চার মাধ্যমে সুপ্ত শক্তিকে জাগরিত করা যায় এবং তা প্রয়োগ করা যায় এবং এটা শরীর ও মনের উপর একটা স্বাস্থ্যকর ভূমিকা রাখে। পতঞ্জলি যোগচর্চাকে কিছু রোগ এবং বিশেষতঃ নানা দীর্ঘসূত্রি রোগব্যাধি নিরাময়ের কাজে ব্যবহারের শিক্ষা দিতেন।

ভারতীয় প্রাচীন দার্শনিকদের মধ্যে যারা ধর্ম এবং এবং প্রচলিত ঔষধ ও চিকিৎসা ব্যবস্থা একসঙ্গে যুক্ত করেছিলেন তাদের মধ্যে নাগার্জুন অন্যতম। নাগার্জুন মধ্যমপথ নামক ধর্মীয় ব্যাখ্যার স্রষ্টা, অন্যদিকে তিনিÑচিকিৎসা বিষয়ক একশত ব্যবস্থাপত্র, এবং মূল্যবান সংকলন প্রভৃতিরও রচয়িতা। তাঁর উত্তরতন্ত্র মূলতঃ বিভিন্ন ঔষধি তৈরীর নির্দেশক গ্রন্থ। তিনি আরোগ্যমঞ্জরী, কক্ষপূততন্ত্র, যোগসার, যোগশতক শীর্ষক চারটি গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর সময়কাল দশম শতাব্দী বিধায় তাঁর পূর্বের চিকিৎসকদের ধ্যান-ধারণা তাঁর কাজে অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর কয়েকযুগ পর ১০২০ সালে গজনীর সুলতান মাহমুদ আক্রমণ চালিয়ে সোমনাথ মন্দির ও এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ব্যাপক লুণ্ঠন ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর প্রাক্কালে সোমনাথের বাসিন্দা নাগার্জুনের এই বিশাল লেখালেখির ভার তাদের হাতে পড়ে বলে ধারণা করা হয়। রাষ্ট্রনগর ইমারত মানুষ ধ্বংস করলেও সুলতান মাহমুদের সঙ্গে আসা আল-বিরুনী ছিলেন পরিব্রাজক ও লেখক। তিনি ভারতের চিকিৎসাসহ নানা বিষয়ে অধ্যয়ন করে তা আরবীতে অনুবাদ করেন। ভারতের চরক ও শুশ্রুত সংহিতা সহ চিকিৎসা বিষয়ক প্রাচীন গ্রন্থ আরবীতে অনূদিত হয়ে আরবীয় ইউনানী চিকিৎসায় অন্তর্ভূক্ত হয়। নাগার্জুনের রচনা সম্ভারও তাদের নজর এড়ানোর কথা নয়।

মধ্যযুগে আয়ুর্ব্বেদ সারা ভারতব্যাপী বিস্তৃতি লাভ করে। দলহন (১২০০খ্রী.), সরঙ্গধারা (১৩০০খ্রী.), ভবমিশ্র (১৫০০ খ্রী.) ভারতীয় চিকিৎসা শাস্ত্রের গ্রন্থ সংকলন করেন। ৮ম শতাব্দীতে শুশ্রুত ও চরক সংহিতা আরবীতে অনূদিত হয়। ৯ম শতাব্দীর পারস্যের চিকিৎসক ঢ়াঝেস এসব গ্রন্থ সম্পর্কে জানতেন। গুপ্ত যুগের গ্রন্থ থেকে আরবি ভাষায় অনূদিত হয়ে তা মধ্যযুগের শেষের দিকে ইউরোপীয় চিকিৎসা জগতে প্রবেশ করে। ভারতীয় চিকিৎসা শাস্ত্রের ধ্যান ধারণা গ্রীকদেরও প্রভাবিত করেÑ এটা মূলতঃ খ্রী.পূ. ১৮০ থেকে ১০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ভারতের একাংশে ইন্দোÑগ্রীক শাসনামলের সরাসরি সংস্পর্শের কালে ঘটেছিল। ইতালীয় রেনেসাঁর যুগে সিসিলি’র ব্রাঙ্কা পরিবার এবং বোলোঙ্গা’র গাস্পারে টলিয়াকোজ্জি শুশ্রুতের দক্ষ শল্য চিকিৎসার কৌশল দ্বারা প্রভাবিত হন। ভারতীয় নানা রাজারাজরা-গণ প্রাচীন এই চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। আযুর্বেদ এবং যোগব্যায়্যাম জনিত চিকিৎসা পদ্ধতি উপমহাদেশে বহুলভাবে অনুসৃত হয়। এইভাবে প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা ভারতে জগৎব্যাপী পরিচিতি ও বিস্তৃতি পায়।

ডা. দিলিপ দে: শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, লেখক, গবেষক।

দখিনা: ৩৮