এক মঞ্চে চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিযোগিতায় মেতেছে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ প্রতিযোগিতা দেশের সংস্কৃতিকে তুলে ধরার। নিজেদের সাংস্কৃতিক যোগ্যতাকে মেলে ধরার। আর এই মঞ্চ! প্রথম আলো আয়োজিত তারুণ্য উৎসবের মঞ্চ। যেখানে বিভিন্ন বিদ্যালয়, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা লড়াই করে সেরাদের সেরা হওয়ার জন্য। এ লড়াই কখনো যুক্তির, কখনো বুদ্ধির, আবার কখনো সাংস্কৃতিক দক্ষতার। এভাবেই নানা আয়োজনে প্রতি বছর আয়োজিত “প্রথম আলো তারুণ্য উৎসব” মুখরিত হয়ে ওঠে তারুণ্যের জয়গানে।
প্রথম আলো আয়োজিত এই তারুণ্য উৎসব শুরু হয় ২০১২ সালে। সে বছরের জুন মাসে কনফিডেন্স সিমেন্টের সৌজন্যে প্রথম আলো আয়োজন করে স্কুল বিতর্ক প্রতিযোগিতা। নগরের সেরা ১৬ টি বিদ্যালয় অংশ নেয় এ আয়োজনে। পুরো অনুষ্ঠানের সার্বিক সহযোগিতায় থাকে চট্টগ্রাম বন্ধুসভা। স্কুল বিতর্ক উৎসবে সফলতার পর আয়োজকরা যেন অন্য কিছু ভাবছিলেন। এ ভাবনা নগরের সবকটি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজকে এক মঞ্চে আনার। আয়োজকদের এমন ভাবনার ফসল পাওয়া গেল ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে। সে বছরের ১১ ও ১২ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো আয়োজন করা হয় ‘কনফিডেন্স সিমেন্ট-প্রথম আলো তারুণ্য উৎসব’। এই আয়োজনেরও সার্বিক সহযোগিতায় ছিল চট্টগ্রাম বন্ধুসভা। প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক কবি বিশ্বজিৎ চৌধুরীর নির্দেশনায় এ আয়োজন সফল করতে কাজ করে ৭ জনের একটি প্রধান দল। সে দলে ছিলেন বিতর্ক সংগঠক মাসুদ বকুল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভার সাবেক সভাপতি আদনান মান্নান, চট্টগ্রাম বন্ধুসভার সাবেক আহ্বায়ক সৌমিত্র পালিত, চট্টগ্রাম বন্ধুসভার সাবেক সভাপতি সঞ্জয় বিশ্বাস, চট্টগ্রাম বন্ধুসভার বন্ধু নুরুল আবরার, রাসেল চৌধুরী ও শিহাব জিশান। এই সাতজনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম বন্ধুসভার বন্ধুরা সফল করে তোলে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রামে আয়োজিত তারুণ্য উৎসবের আয়োজন। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে আয়োজিত তারুণ্য উৎসবে ছিল আন্তঃকলেজ বিতর্ক ও আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন। সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় চট্টগ্রামের সাদার্ন ইউনিভার্সিটি, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, ইউএসটিসি ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ এই আটটি বিশ্ববিদ্যালয় অংশ নেয়। আর আন্তঃকলেজ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল নগরের ১৬ টি কলেজ। প্রথমবারের মতো আয়োজিত তারুণ্য উৎসবের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় সেরা হওয়ার গৌরব অর্জন করে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
২০১২ সালে তারুণ্য উৎসবের মাধ্যমে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে যে উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছিল সে উচ্ছ্বাস দিনে দিনে বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে এই উৎসবের ব্যাপ্তি ও সৌন্দর্য। ২০১৩ সালের তারুণ্য উৎসবে আন্তঃকলেজ বিতর্ক ও আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার সঙ্গে যুক্ত হয় আন্তঃস্কুল বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজনও। আর ২০১৬ সালের সর্বশেষ তারুণ্য উৎসবে যুক্ত করা হয় আন্তঃস্কুল আইডিয়া জেনারেশন প্রতিযোগিতা নামে নতুন একটি পর্ব। যেখানে শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাই করা হয়।
এখন পর্যন্ত চট্টগ্রামে প্রথম আলো আয়োজিত তারুণ্য উৎসবই একমাত্র মঞ্চ যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা মিলিত হয়ে তাঁদের সাংস্কৃতিক দক্ষতার পরিচয় দেয়। নগরের খ্যাতনামা সংস্কৃতি কর্মীরা এই আয়োজনে আসেন বিচারক হিসেবে। ২০১৬ সালে পঞ্চমবারের মতো বসে এই তারুণ্য উৎসবের আসর। উৎসবের প্রতিটি আসরেই আটটি করে বিশ্ববিদ্যালয় অংশ নেয় তাঁদের সাংস্কৃতিক নৈপূণ্য প্রদর্শনের জন্য। আর তারুণ্য উৎসবের প্রতিটি আসরেই সাদার্ন ইউনিভার্সিটি অংশ নিয়ে নিজেদের সাংস্কৃতিক নৈপূন্য প্রদর্শন করে। উৎসবের তিনটি আসরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দ্বিতীয় রাউন্ডেও নিজেদের দক্ষতা প্রদর্শনের গৌরব অর্জন করে। ২০১২ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তারুণ্য উৎসবের আসরে অনুষ্ঠিত সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান লাভ করে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১৫ সালে এই পুরস্কার ওঠে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে। সে বছর দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
সর্বশেষ ২০১৬ সালের ৫ থেকে ৭ অক্টোবর নগরের জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে বসেছিল এই উৎসবের আসর। পঞ্চমবারের মতো বন্দরনগরীতে আয়োজিত এই উৎসবের সহযোগিতায় ছিল চট্টগ্রাম বন্ধুসভা।
তিন দিনব্যাপী তারুণ্য উৎসবের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার বিষয় ছিল ‘বিশ্বদরবারে বাংলাদেশ’। এই বিষয়ের উপর নাচ, গান, অভিনয়সহ বিভিন্ন পরিবেশনার মাধ্যমে শিল্পকলার মঞ্চ মাতিয়েছেন চট্টগ্রামের আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ছিল সাদার্ন ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ, পোর্ট সিটি আর্ন্তজাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিজিএমইএ ইনস্টিটিউট অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় উঠে আসে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতার ইতিহাস, নোবেল প্রাপ্তি, ক্রিকেটের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়সহ দেশের বিভিন্ন অর্জন। তরুণদের এমন পরিবেশনা মুগ্ধ করে শিল্পকলা প্রাঙ্গণের হাজারো দর্শককে। সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় বিচারকের দায়িত্বে থাকা আবৃত্তিশিল্পী রাশেদ হাসান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে এ ধরনের আয়োজন আগে কখনো চট্টগ্রামে হতো না। প্রথম আলোর এই আয়োজনে অংশ নিয়ে তরুণরা যে দেশপ্রেম তুলে ধরলো তা আমাদের আশাবাদী করে তুলেছে। দেশের পতাকার ভার তাঁরা নিতে পারবেই।’
বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশিদুজ্জামান বলেন, ‘প্রতিবছর পত্রিকায় দেখে এই আয়োজন সম্পর্কে শুনেছি। এবছর উৎসব প্রাঙ্গণে গিয়েছিলাম বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক দলের দায়িত্ব নিয়ে। আমার মতে তারুণ্য উৎসবের বিভিন্ন পর্বের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতাটিই সবার সেরা।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা অনেকদিন মনে রাখার মতো বলে জানান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মামুনুল হক। ২০১৬ সালের তারুণ্য উৎসবের শেষ দিন ৭ অক্টোবর কথা হয় সাদার্ন ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী আহমেদ চিশতীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ঘুরতে ঘুরতে শিল্পকলায় এলাম। এরপর এই প্রতিযোগিতার মঞ্চে অংশগ্রহণকারী চট্টগ্রামের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিয়েছি। এই আয়োজনে এসে যা পেলাম তা বলে বোঝানো যাবে না।’ আগ্রাবাদ এলাকা থেকে ছেলেকে নিয়ে উৎসবে আসা শারমিন হক বলেন. ‘দেশ নিয়ে তরুণদের এমন ভাবনার প্রতিফলন আমাকে মুগ্ধ করেছে। তরুণদের এমন ভাবনা আমাদের উন্নতির শিখরে নিয়ে যাবেই।’ অন্য দিকে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ঐশী চৌধুরীর ভাবনা আরও বিস্তৃত। তিনি বলেন, ‘বিশ্বদরবারে বাংলাদেশ অনেক আগেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। আমরা সেই ধারা অব্যাহত রাখতে চাই। বিশ্বব্যাপী লাল-সবুজের পতাকা ওড়ানোই আমাদের স্বপ্ন। তরুণদের এগিয়ে নিতে এ ধরনের উদ্যোগ আরও প্রয়োজন।’ উৎসবে আসা ক্যান্টনমেন্ট ইংলিশ স্কুলের শিক্ষক মনসুর নবী বলেন, ‘শিল্পকলা প্রাঙ্গণে এভাবে তারুণ্যের ঢলই বলে দেয় এটি একটি সত্যিকারের উৎসব আয়োজন। বিদ্যালয় ও কলেজের বিতর্ক, বিদ্যালয়ের আইডিয়া জেনারেশন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা উৎসবের সবকটি পর্বই বেশ উপভোগ্য ছিল।’
২০১৬ সালের ৭ অক্টোবর বিকেলে শিল্পকলা একাডেমির মুক্তমঞ্চে বসে আন্তঃস্কুল ও আন্তঃকলেজ বিতর্কের চূড়ান্ত পর্বের আসর। বিতর্ক বিভাগে বিদ্যালয় পর্যায়ে এবার শ্রেষ্ঠ হয়েছে প্রেসিডেন্সি ইন্টারন্যাশনাল স্কুল। রানারআপ হয়েছে সিলভার বেলস গার্লস হাইস্কুল। কলেজ পর্যায়ে জয়ী হয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী কলেজ। রানারআপ হয়েছে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ। আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম, পোর্ট সিটি আর্ন্তজাতিক বিশ্ববিদ্যালয় দ্বিতীয় ও চট্টগ্রাম বিজিএমইএ ইনস্টিটিউট অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি তৃতীয় হয়। উৎসবে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত আন্তঃবিদ্যালয় আইডিয়া জেনারেশন প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছে ক্যান্টনমেন্ট ইংলিশ স্কুল। দ্বিতীয় হয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী স্কুল এবং তৃতীয় হয়েছে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ। সমাপনী দিনে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন সাংসদ ওয়াসিকা আয়েশা খান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের (ইউএসটিসি) উপাচার্য প্রভাত চন্দ্র বড়ুয়া ও কনফিডেন্স সিমেন্ট লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক জহির উদ্দিন আহমেদ।
এর আগে ৫ অক্টোবর সকালে জেলা শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বেলুন উড়িয়ে তিন দিনব্যাপী এই উৎসবের উদ্বোধন করা হয়। বেলুন উড়িয়ে এই উৎসবের উদ্বোধন করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড. শিরিন আক্তার। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন কনফিডেন্স সিমেন্টের নির্বাহী পরিচালক এবং বিক্রয় ও বিপণন প্রধান জহির উদ্দিন আহমেদ এবং প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক বিশ্বজিৎ চৌধুরী।
শিহাব জিশান: রির্পোটার, চ্যানেল নাইন, চট্টগ্রাম ব্যুরো।
shihab.anik@yahoo.com