১৪২৫ বাংলা সন সমাগত। বহু প্রাচীনকাল থেকেই সন গণনা আরম্ভ। যেমন সম্রাট বুখ্তে নসরের জন্ম তারিখ থেকে চালু হয় ব্যাবলনীয় সন, মিশর থেকে হিজরত করে বনী ইসরাঈল যেদিন আযাদ হয় সেদিন থেকে তাদের সন গণনা শুরু। গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা উজ্জয়িনীর কিংবদন্তি রাজা বিক্রমাদিত্য ভারতবর্ষে বিক্রমাব্দ চালু করেন খ্রিষ্টপূর্ব ৫২ অব্দে। ইয়েমেনের খ্রিষ্টরাজা আবরাহা যখন কাবা ঘর ধ্বংস করতে হস্তি বাহিনী প্রেরণ করেছিল তখন থেকে শুরু হওয়া সনকে আমুল ফিল এবং আমুল ফুজ্জার, আমুল ফতেহ নামের সন গণনাসহ হবুতি, লুই, খসরু সন সমূহ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ঈসায়ী বা ইংরেজি সনের প্রচলন হলো হযরত ঈসা (আ:) এর জন্মদিন থেকে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে- কোন বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সব ধরনের সন গণনা চলে এসেছে। কিন্তু আরব ভূ-খন্ডে গোষ্ঠীগত বিভাজনের কারণে তাদের মাঝে সার্বজনীন গ্রহনযোগ্য কোন সন বা বর্ষ ছিল না। যার কারণে আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও লেন-দেনের ক্ষেত্রে খ্রিষ্টপূর্ব ৭৫৩ অব্দে শুরু হওয়া রোমান সনকেই অনুসরণ করা হতো। ৬৩৯ খ্রিষ্টাব্দে কুফার গভর্নর হযরত আবু মুছা আল আশয়ারী (রা:) প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার সুবিধার্থে সন তারিখ নির্ধারনের জন্যে তখনকার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ফারুক (রা:)এর কাছে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে খলিফা ওমর (রা:) একটি নীতি নির্ধারনী সভা আহবান করেন। ঐ সভাতে বিভিন্ন প্রস্তাবের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে হযরত আলী (রা:) বিশ্ব নবী (দ:)এর হিজরতের বৎসরকে সন গণনার বৎসর নির্ধারনের আহবান জানালে সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাবটি গৃহিত হয়। হিজরী সন বা ইসলামী বর্ষ গণনা আরম্ভ হয় তখন থেকে।
হিজরীর প্রথম শতাব্দী অর্থাৎ ৭১১ খ্রিষ্টাব্দে মুহাম্মদ বিন কাশেম ভারতবর্ষে আগমন করেন। তখন থেকে ইসলামী সংস্কৃতির অন্যান্য উপাদানের মত হিজরী সনও ভারতবর্ষে প্রবেশ করে। মোগল সম্রাট জালাল উদ্দীন মোহাম্মদ আকবর সিংহাসনে আরোহনের ২৮ বছর পর অর্থাৎ ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর রাজস্ব কর্মকর্তা পন্ডিত আমীর ফতেহ উল্লাহ শিরাজীকে স্থানীয় পরিবেশ ও ফসল তোলার সাথে সঙ্গতি রেখে একটি নতুন অব্দ চালু করার নির্দেশ দেন। অমাত্য শিরাজী উদ্ভাবিত নতুন অব্দ বা সনই হচ্ছে বাংলা সন। যা কার্যকর হয় ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাটের সিংহাসনে আরোহনের বৎসর থেকে। যা ছিল ৯৬৩ হিজরি সন। হিজরি চন্দ্রাব্দ। কিন্তু আকবর যে অব্দ প্রবর্তন করেন তা হচ্ছে সৌর অব্দ। ফসল উৎপাদনের সাথে সৌর অব্দের বিশেষ সঙ্গতি থাকে বলেই সম্রাট আকবর তা গ্রহণ করেন। হিজরি সনকে সৌর সনে রূপান্তর করে বাদশাহ আকবরই বাংলা সালের প্রবর্তক বলে মত দিয়েছেন অধিকাংশ ইতিহাসবিদ, প-িত-মনীষী ও জ্যোতির্পদার্থ বিজ্ঞানীরা। এ সন প্রচলনের উদ্দেশ্য ছিল খুবই মহৎ এবং গরিব হিতকর। জনসাধারণ ফসল ঘরে তুলে তা বিক্রি করার পর যাতে অনায়াসে খাজনা প্রদান করতে পারে এবং অর্থাভাবে কেউ কষ্ট না পায় সে দিকটি বিবেচ্য ছিল। তাই ফসল তোলার সাথে সম্পর্কিত হওয়ার কারণে একে ফসলি সনও বলে থাকে। কোন এক সময় বাংলাদেশের কৃষকের মুখ্য ফসল ছিল আমন ধান। এ ধান অগ্রহায়ণ মাসে কৃষকের ঘরে উঠত। এ কারণে তখন বছরের প্রথম মাস হিসেবে ধরা হতো অগ্রহায়ণকে। কিন্তু এখন আমরা বৈশাখকেই বাংলা সনের প্রথম মাস হিসেবে নির্ধারণ করেছি। উৎসবের দিন হিসেবে ১ বৈশাখ আমাদের কাছে অতি প্রিয়। বিশাখা থেকে বৈশাখ। রূদ্র হলেও বৈশাখ মাধব, সে কারণে এ মাসে আমের মুকুল দৃশ্যমান হয়। হিজরি সনের প্রথম মাস মর্হরম। ৯৬৩ হিজরির মর্হরম মাসের সময় ছিল বাংলা মাসের বৈশাখ। যেহেতু হিজরি সন বাংলা সনের জননী সেহেতু বৈশাখ হয়ে গেল মর্হরম মাসের মতই বাংলা সনের প্রথম মাস। নাযীর আহমেদ “প্রাচীন বাংলার ইতিহাস” গ্রন্থে লিখেছেন, সুবেদার ইসলাম খাঁ চীশতি ঢাকাকে রাজধানী হিসেবে রূপ দেয়ার প্রাক্কালে পহেলা বৈশাখকে উৎসবের দিন ঘোষণা করেন। এর পর থেকে প্রতি বৎসর পহেলা বৈশাখে তাঁর বাসভবনের উঠোনে প্রজাদের সাথে কুশল বিনিময়, মিষ্টি বিতরণ ও ভোজ সভার আয়োজন করা হতো। নতুন জামাকাপড় পরে আধিকারিক, জমিদার, ব্যবসায়ীসহ সকল শ্রেণী পেশার মানুষ মিলেমিশে একাকার। প্রজারা খাজনা আদায়ের পর অংশ নিতেন লোকগাথা, কাবাডি ও গরু-মোষের লড়াইয়ে। ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ হালখাতা শেষে খরিদ্দারদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। মানুষ মন খুলে প্রাণ খুলে আনন্দে মেতে উঠতেন।
দক্ষিণ এশিয়ার নেপাল এবং মিয়ানমারে নববর্ষের সূচনা হয় বৈশাখ মাসে। শ্রীলঙ্কায় সিংহলি বর্ষপঞ্জি হিসেবে ১৪ এপ্রিল বর্ষ শুরু। ত্রিপুরাতে নববর্ষ পালন করে ত্রিপুরাব্দ মোতাবেক ১৫ এপ্রিল। সুতরাং দেখা যাচ্ছে- নববর্ষ আসে বৈশাখে উপমহাদেশের অন্যান্য এলাকাতেও। বিশেষ করে পূর্ব ভারতে। বৈশাখকে ঘিরে নববর্ষ উদ্্যাপন আমাদের পাহাড়ি এলাকার নৃগোষ্ঠীদের মাঝেও বিদ্যমান। ঐতিহ্যবাহী ‘বৈসাবি’ উৎসব পালন প্রধান তিনটি নৃগোষ্ঠীর মাঝে পরিলক্ষিত হয়। বৈসু থেকে (বৈ), সাংগ্রাই থেকে (সা) আর বিজু থেকে (বি) শব্দত্রয়ের মিলিত রূপ ‘বৈসাবি’। বাংলাদেশের সকল নাগরিকের কাছে বৈশাখের প্রথম দিন যেমন উৎসবের, তেমনি দরিদ্র মানুষের প্রতি দায়িত্বেরও। যে উদ্দেশ্য নিয়ে মোগল সম্রাট আকবর হিজরি সনের তারিখ অনুযায়ী পারস্যের সাফাভিদ রাজাদের সৌর অব্দ অনুকরণ করে বাংলা সন প্রবর্তন করেছিলেন তা অবশ্যই মনে রাখা উচিৎ। উৎসবে অবশ্যই আনন্দ অভিরুচি থাকবে। কিন্তু সেটা কোনভাবে যেন অর্থ-বিত্তশালীদের হাতের মুঠোয় চলে না যায়। খেয়াল রাখতে হবে কারো আনন্দ যেন কারো বেদনা বা বিরক্তির কারণ না হয়। আমরা নববর্ষে সুন্দর, রুচিশীল, পরিচ্ছন্ন পোষাক পরিধান করবো। সম্ভব হলে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে পরিচ্ছন্ন পরিবেশে মানসম্মত খাওয়া দাওয়ার আয়োজন হবে (পান্তা ইলিশের নামে গরিবের প্রতি উপহাস নয়)। সারাদিন পরিবার পরিজনসহ সবুজ অঞ্চল, অটবি, বড় হৃদের তটভূমিতে কিংবা অভয়ারন্যে ঘুরে বেড়ানো, সাঁতার কাটা, সুযোগ পেলে বই পড়া ইত্যাদি। এ ধরনের ভ্রমণেতে বাচ্চাদের প্রতি খেয়াল রাখা এবং তাদের খুশি করার চেষ্টা থাকা বাঞ্চনীয়। সকলে মিলে আনন্দ করার সময় যেটা অত্যন্ত জরুরী সেটা হচ্ছে অন্য কারো ধর্মীয় এবং পার্থিব জীবনে সমস্যার সৃষ্টি হয় এমন কিছু না করা। সময় ও অর্থের অপচয় হচ্ছে কিনা সেটাও মনে রাখতে হবে। আবার বিনোদনের সীমারেখা থাকা খুব বেশী প্রয়োজন। যাতে কোন ধরনের পাপাচার আমাদের স্পর্শ করতে না পারে।
আজ অনুশোচনার ভাষা নেই। আমরা প্রতি পদে পদে, পলে পলে অবিচারে পাপাচারে লিপ্ত হচ্ছি। জাতি হিসেবে নিজস্ব ঐতিহ্য, গৌরব, চেতনা ভুলে গিয়ে, স্বকীয়তা হারিয়ে বিজাতীয় অপসংস্কৃতির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছি। স্যাটেলাইট বেহায়াপনার বিস্তার ঘটিয়েছে। যৌন উত্তেজনাকর বিজ্ঞাপন কোথায় নেই? ইন্টারনেট অভিশাপ হয়ে নৈতিকতা হরণ করছে। আমেরিকা, ইউরোপ, ইন্ডিয়া মিডিয়ার মারফতে তাদের রুচিহীন সংস্কৃতি বিরতিহীনভাবে আমাদের ধ্যান-ধারণা, মননে মগজে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। মিডিয়ায় প্রকাশ্যে অতি আধুনিক হতে গিয়ে নারী পুরুষের পোষাক আশাক স্বল্পবসনায় ঠেকেছে। সামাজিক মূল্যবোধ পরিপন্থী এসব কাজ প্রগতি ও সামাজিক নিরাপত্তার জন্যে হুমকি স্বরূপ। এবং হুমকি স্বরূপ। এটাই বাস্তব।
লেখক: রাজনীতিক ও প্রাবন্ধিক।