যুক্তরাজ্যে সাধারণ নির্বাচন আজ বৃহস্পতিবার। এবার ভোটারদের কাছে পার্টির চেয়ে বড় ইস্যু হয়ে উঠছে ব্রেক্সিট। পাঁচ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে এ নিয়ে তৃতীয়বারের নির্বাচন।
নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে কনজারভেটিভ এবং লেবার পার্টির মধ্যে। ৫ হাজার ৫০টি বুথে ভোট দিচ্ছেন ইংল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডের মানুষ। কেন্দ্রগুলো খোলা হবে স্থানীয় সময় সকাল ৭টায়। ফলাফল ঘোষণা করা হবে শুক্রবার।
ব্রেক্সিট ইস্যুতে ম্যান্ডেট নিতেই দেশটির প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দেন। নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের কনজারভেটিভ পার্টি টোরি পার্টি এবং জেরেমি করবিনের লেবার পার্টির মধ্যে। এছাড়া আরও ছোট দল রয়েছে যারাও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।
টোরি ও লেবার পার্টি রাজনৈতিক সংকটের সমাধানে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বিশেষ করে বাজেটের নানা ইস্যুও স্থান পেয়েছে তাতে।
এদিকে, এথনিক মাইনোরিটির ভোট নির্বাচনী ফলাফলে বিরাট প্রভাব রাখবে বলে আভাস দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা। এবারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৯ বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত প্রার্থী। ৯ জনের মধ্যে লেবার পার্টি থেকে সাত, লিবারেল ডেমোক্র্যাটের এক এবং কনজারভেটিভ পার্টি থেকে একজন। তাদের ৯ জনের সাতজনই নারী।
যুক্তরাজ্যের এবারের সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের প্রতিনিধিত্ব বাড়বে এটা নিশ্চিত। তবে আলোচনা বেশি হচ্ছে ব্রিটিশ-বাংলাদেশি পাঁচ নারীকে নিয়ে, যাদের তিনজন এখন সংসদ সদস্য।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রুশনারা আলী, টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক ও রূপা হক নিজ আসন ধরে রাখতে লড়ছেন। এবার তাদের সঙ্গে মাঠে নেমেছেন আফসানা বেগম। বাংলাদেশি অধ্যুষিত পূর্ব লন্ডনের পপলার অ্যান্ড লাইম হাউস আসনে তাকে সম্ভাবনাময় ধরা হচ্ছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতায় করছেন লিবডেম দলীয় প্রার্থী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ড. বাবলিন মল্লিকও।
এ ছাড়াও বাকি বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত প্রার্থীরা হলেন- কনজারভেটিভ পার্টির আনোয়ারা আলী, লেবার পার্টি থেকে নুরুল হক আলী, আখলাক খান।
সিলেটের বিশ্বনাথের মেয়ে রুশনারা টানা তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি আরও পাঁচ বছর ব্রিটিশ পার্লামেন্টে থাকতে লড়ছেন। বাঙালি ভোটারদের সংখ্যাধিক্যের কারণে এ আসন লেবার পার্টির জন্য নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত। ৮০ হাজার ভোটারের মধ্যে প্রায় অর্ধেক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক। শুধু তাই নয়, তাকে ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সবচেয়ে উজ্জ্বলতম দাবিদার বলে মন্তব্য করেছে ব্রিটেনের প্রভাবশালী রাজনৈতিক পত্রিকা নিউ স্টেটসম্যান।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতি টিউলিপ সিদ্দিক উত্তর-পশ্চিম লন্ডনের হ্যামস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন আসনটি ধরে রাখার লড়াইয়ে নেমেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ ২০১৫ সালে লেবার পার্টি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে জয়ী হন। পরের দফায় ২০১৭ সালের নির্বাচনে তিনি পুনর্নির্বাচিত হন। পারিবারিক পরিচয় আর লন্ডনের তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ আসনে প্রার্থিতার কারণে ৩৭ বছর বয়সী টিউলিপ সব সময়ই আলোচনার কেন্দ্রে।
টানা দুই বারের এমপি রূপা হকের জন্ম ও বেড়ে ওঠা লন্ডনে। বাংলাদেশে তার আদি বাড়ি পাবনায়। ৪৮ বছর বয়সী রূপা অল্প ভোটের ব্যবধানে হলেও ২০১৫ সালের নির্বাচনে রক্ষণশীলদের হাত থেকে লন্ডনের ইলিং সেন্ট্রাল অ্যান্ড অ্যাকটন আসনটি পুনরুদ্ধার করেন। ২০১৭ সালের নির্বাচনেও তিনি ব্যবধান বাড়িয়ে আসনটি ধরে রাখেন।
টাওয়ার হ্যামলেটস এলাকার পপলার অ্যান্ড লাইম হাউস আসন থেকে লেবার পার্টি থেকে এবার প্রথমবারের মতো লড়ছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আফসানা বেগম। আসনটিতে দুই দশকের লেবার পার্টি এমপি জিম ফিটজপেট্রিক চলতি বছরের শুরুর দিকে নির্বাচন না করার ঘোষণা দেন। লেবার দলের নিরাপদ এই আসনে মনোনয়ন নিয়ে লড়াইয়ের মধ্যে অনেকটা চমকে দিয়ে প্রার্থী হয়েছেন অপেক্ষাকৃত তরুণ এ বাঙালি কন্যা। আফসানার জন্ম ও বেড়ে ওঠা টাওয়ার হ্যামলেটসে হলেও বাংলাদেশে তাদের আদি বাড়ি সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে। টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের আবাসন বিভাগে কর্মরত আছেন তিনি।
নির্বাচনে যুক্তরাজ্যের কার্ডিফ সেন্ট্রাল আসন থেকে উদার ধারার রাজনৈতিক দল লিবডেমের (লিবারেল ডেমোক্র্যাট) হয়ে একমাত্র বাংলাদেশি লড়ছেন। বাবলিন মল্লিক মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কচুয়া গ্রামের মোহাম্মদ ফিরোজের মেয়ে। ছোটবেলায় মা-বাবার সঙ্গে যুক্তরাজ্যে আসেন। বায়োক্যামেস্ট্রিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন। তিনি কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন। কমিউনিটির স্বার্থে বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। সেখানকার কাউন্টি কাউন্সিলের প্রথম বাঙালি ও মুসলিম নারী হিসেবে গত কাউন্সিল নির্বাচনে বিপুল ভোটে কাউন্টি কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।
যুক্তরাজ্যের মধ্যবর্তী নির্বাচনে লন্ডনের বেকেনহাম আসন থেকে লেবার পার্টির মনোনয়ন পেয়েছেন বাঙালি কন্যা মেরিনা মাসুমা আহমেদ। পার্টির প্রভাবশালী সদস্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনি এ আসনে এবারও নির্বাচন করার টিকিট লাভ করলেন। এ আসনে বর্তমানে এমপি হিসেবে আছেন ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি। নারায়ণগঞ্জে জন্ম নেওয়া মেরিনা আহমেদ মা-বাবার সঙ্গে ৬ মাস বয়সে যুক্তরাজ্যে যান। তার বাবা বর্তমানে বেঁচে নেই। মা মমতাজ বেগম বর্তমানে ঢাকার বনানীতে বাস করছেন। চার ভাইয়ের সঙ্গে মেরিনা লন্ডনে বসবাস করেন। মেরিনা পাবনার কৃতি সন্তান ডা. ইমরুল কায়েসকে বিয়ে করেন।
কনজারভেটিভ পার্টি থেকে একমাত্র বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রার্থী সাবেক কাউন্সিল ডা. আনোয়ার আলী। গত নির্বাচনেও টোরির হয়ে নির্বাচনে অংশ নেন। এবারের নির্বাচনে তিনি লন্ডনের হ্যারো ওয়েস্ট আসন থেকে লড়ছেন। সর্বশেষ নির্বাচনেও একই দল থেকে টাওয়ার হ্যামলেটসের প্রার্থী হয়েছিলেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী বর্তমান লেবার কো-অপারেটিভ পার্টির এমপি রিচার্ড থমাস।
আনোয়ারা আলী পেশায় একজন চিকিৎসক। গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে চিকিৎসার পাশাপাশি সক্রিয় রাজনীতির মাঠে রয়েছেন। সাড়ে চার বছর বয়সে মা-বাবার সঙ্গে লন্ডনে যান আনোয়ারা। তার বেড়ে ওঠা ও শিক্ষাজীবন কেটেছে লন্ডনেই। হাজি জোবেদ আলীর তিন সন্তানের মধ্যে সবার ছোট আনোয়ারা একজন ব্যবসায়ীও। তিনি সাংবাদিক রেজা আহমদ ফয়সল চৌধুরীর স্ত্রী ও এক পুত্রসন্তানের জননী।
স্কটল্যান্ডের অ্যাবারডিন নর্থ সংসদীয় এলাকার লেবার পার্টির প্রার্থী হয়েছেন আরেক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নুরুল হক আলী। প্রায় ২৭ বছর ধরে লেবার পার্টির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। লন্ডনের নিউহাম এলাকার একজন লেবার কাউন্সিলর হিসেবে ১৯৯৮ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ডেপুটি চেয়ারম্যান ফর রিজেনারেশন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ জেলার ঐতিহাসিক শাহানপাড়া এলাকার মিরপুরে জন্মগ্রহণ করেন নুরুল হক।
যুক্তরাজ্যের এবারের মধ্যবর্তী নির্বাচনে হার্টফোটশেয়ার থেকে লেবার দলের প্রার্থী হয়ে লড়ছেন আখলাক খান। আদি বাড়ি সিলেট সদরে। সাত বছর বয়সে বাবার সঙ্গে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান। এরপর সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ওয়েস্টমিনস্টারে কনজারভেটিভের বিপরীতে লেবার কণ্ঠকে আরও শক্তিশালী করতে চান বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এ প্রার্থী।
এবারের সাধারণ নির্বাচনে সর্বমোট ৬৫০ আসনে মোট ভোটারের সংখ্যা হচ্ছে চার কোটি ৬০ লাখ। বিভিন্ন দলের মোট প্রার্থীর সংখ্যা ৩ হাজার ৩২২। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে হলে যে কোনও রাজনৈতিক দলের এমপির সংখ্যা হতে হবে ৩২৬ জন।