প্রসঙ্গ চট্টগ্রামের প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতা

0
894

প্রসঙ্গ চট্টগ্রামের প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতা
নাজিমুদ্দীন শ্যামল

চট্টগ্রামে সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র আন্দোলনের ইতিহাস অনেকদিনের। এখানে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের গোড়াপত্তন হয়েছিলো বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে। সেই থেকে চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদ দীর্ঘ অনেক বছর ধরে এখানের রুচিশীল দর্শক ও চলচ্চিত্র কর্মিদের জন্য কাজ করেছে। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত এই সংগঠনটি পট্টগ্রামে চলচ্চিত্র সংস্কৃতির বিকালে গুরুত্বপর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৯১-৯২ সালে আমি এই সংসদের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলাম। পরে ১৯৯৩ সালে আমরা চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্র প্রতষ্ঠিা করি।১৯৯৩ সালের জানুয়ারী মাস থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত আমি চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করি। চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদের সর্বশেষ সাধারণ সম্পাদক ও চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসাবে চট্টগ্রামে চলচ্চিত্র আন্দোলন বেগবান করতে গিয়ে নানা স্বপ্ন যেমন দেখেছি সিনেমা নিয়ে তেমনি অনেক প্রতিবন্ধকতার ও মুখোমুখি হয়েছি আমরা। সেই সময় আমরা ভাবতাম এবং কখনো ভাবি চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে একটি চলচ্চিত্র নারী গড়ে উঠবে। এখান থেকে নির্মিত হবে দেশের চলচ্চিত্র। ভারতে মেয়ন রাজধানী দিল¬ীতে না হয়ে মুম্বাইকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তর চলচ্চিত্র শিল্প, তেমনি ঢাকা নয়, চট্টগ্রামকে কেন্দ্রকরে এদেশেও তেমনটি হবে। কিন্তু আমাদের দূর্ভাগ্য, এদেশের সবকিছু রাজধানী ঢাকা কেন্দ্রিক। যেন পুরো বাংলাদেশটা ঢাকার ভিতরে ঢুকে যেতে চাইছে। রাজনীতি করতে চাও, ঢাকা যাও। কবিতা লিখতে চাও, চলচ্চিত্র বানাতে চাও, অভিনয় করতে চাও, যা কিছুই করতে চাওনা কেন ঢাকা যেতে হবে। ঢাকা না গেলে জাতীয় হওয়া যাবেনা এমন এক অদ্ভুদ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে উত্তর স্বাধীনতাপর্বের বাংলাদেশে। আমাদের চলচ্চিত্র সংসদ বা চলচ্চিত্র কেন্দ্রের কেউ কেউ ঢাকা চলে গেলো ছবি করলো, ত্র্যাড শিল্প বানালো। নানা কিছু করলো টিকে থাকলো তথা কথিও জাতীয় ভাবে কিন্তু আস্তে আস্তে আমরা পিছিয়ে যেতে থাকলাম। এই রকম অবস্থায় একদিন সাউদান ইউনির্ভাসিটির রাকসান ও রাজন জানালেন উনিভার্সিটি থেকে একটি চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতা করতে চায়। আমি খুব বিস্মিত হলাম। তারা আমাকে ধারনা দিলেন, এখানে অনেকেই স্বাল্পদৈর্ঘ্য ছবি নির্মান করছে। অনেক ছবি আসবে প্রতিযোগিতায় আমি পিন্টু ভাই (আনোয়ার হোসেন পিন্টু) প্রদীপ দা’ (প্রদীস দেওয়ানজী) আর শৈবাল দা’র (শৈবাল চৌধূরী) কথা বললাম।

সে যাই হোক আমার ধারনা ছিল এখানে চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতা হলে তা ফ্লপ করবে। তবুও আমি তাদের ডাকে সাউদান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা জনাব সরওয়ার জাহানের কাছে যাই। সেখানে পিন্টুভাই ও প্রদীপ দা’ও যান। আমরা সভা করি। সরওয়ার ভাইয়ের সাথে আমার যোগাযোগ অনেক দিনের। তিনি আমার দেখা স্বপ্নবান মানুষদের একজন। অসম্ভব সব স্বপ্ন দেখেন। সেগুলো আবার বাস্তবায়নের জন্য রাতদিন লেগে পড়েন। এমন কর্মোদ্যমি মানুষ বিরল। তাঁকে আমি শ্রদ্ধাও করি আবার ভালোওবাসি। তিনি বললেন, এটা করা যাবে। যদি আমরা তা করতে পারি তিনি সার্বিক সহযোগিতা করবেন। সবকিছু ঠিকঠাক আছে। সরওয়ার ভাই চাইলে বা চিন্তা করলে তিনি শেষ পর্যন্ত তা করেই ছানেন, এটা আমি জানি। কিন্তু কয়টা ছবি আসবে, কে ছবি দেবে এসব ভেবে আমার ভেতরটা কেমন আক পাকু করছিলো। আমি ইতস্তত করে সভায় তা বললাম। কিন্তু রাকসান ও রাজন দৃঢ় বিশ্বাসী। তাঁদের ধারনা ছবি আসবে। আমরা কাজটা এগিয়ে নিয়ে গেলেই হবে। যাহোক আমরা তিনজন রাজি হলাম। সেই থেকে কাজ শুরু হলো দখিনা আন্ত: বিশ্ববিদ্যালয় স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতা ২০১৬ এর।

মাঝে মাঝে রাজন কোন করেন প্রায়লই ফোন করেন রাফসান। তিনি লেগে আছেন এই উৎসব ও প্রতিযোগিতা নিয়ে। এবং শেষ পর্যন্ত রাকসান জানালেন ২১/২২ টা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র জমা পড়েছে প্রতিযোগিতার জন্য। আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মনে হলো ঙ্গ টা শুনতে গিয়ে নিজেই অংক গুলোর আগে ২ বসিয়ে দিচ্ছি না তো।

যাহোক একদিন রাকসান সব ছবি গুলো নিয়ে আসলেন। অসম্ভব সুন্দর করে টালি করে দিলেন। সিনোপলিসও তৈরী করে দিলেন। আমি, পিন্টুভাই, প্রদীপ দা’ জুরি হিসাবে কাজ শুরু করলাম। ছবি গুলো দেখছি। একটর পর একটা। কখনো একটা ছবিই কয়েকবার। ছবি গুলো যতই দেখছি, ততই বিস্মিত হচ্ছিলাম। এই সব বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া তরুনেরা এখন ছবি বানাচ্ছে। শুধু ছবি বানাচ্ছে তা নয়, বরং তাদের বিষয় বৈচিত্র্য চিন্তার অনন্যতা, শিল্প বোধের মৌলিকতা তথা সাধারণ মানুষের জীবন নীরিক্ষনের স্বকীয়তা আমাকে বিমুগ্ধ করে ফেলেছে।

চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া ছবিগুলো হলো- চৈতন্য রাজ রংশীর পরভূঁই মারুফ হাসানের আনাভ….., শুভ সাহার ঘুষ, তানভির আল মাহসুদের সিকিং নলেজ, মাসুম আহমেদের স্বপ্নভ্রম, তানিম শাহরিয়ারে ডিজিটাল কোয়েশ্চেন, আবরার কে রিজলের স্টোরি ইন এ স্টোরি, মোর রাব্বির চিরতারুন্য মাহাতির সরকারের গোল্ড কিস মিনক্রম, সাকিব উজ জামানের জীবন সায়াহ্ন, আমিত হাসানের প্রিন্স মাহমুদ) আই উইশ টু বি স্মার্ট ফোন, বাপ্পী আলমগীরের প্রেম, ইফতেখার আহমদের পতাকা, মাসুম সৈয়দের ডু অব ডাই, মুজিবর রহমান সজীবের মা, আবিদ মলি¬কের পথ, সুজিত দেব রায়ের দি রিলিজিয়াস, পিংকু বালার আত্মবোধ, এস এম সরওয়ারের পাঠশালা, দূর্জয় বড়–য়ার রঙ এবং মোহাম্মদ আকতার হোসেন চৌধুরীর বিষাক্ত রস। সব সিনেমা গুলো বিষয়গত দিক থেকে বৈচিত্রমা। এসব সিনেমার পরিবেশ, জীবন বোধ, বেঁচে থাকার সংগ্রাম, ধর্মীয় উগ্রবাদ, ডিজিটাল যুগের মানবিক উত্তরহীনতা সহ অনেক বিচিত্র বিষয় চিত্রায়িত হয়েছে। এসবের সমকালীনতা যেমন আছে, তেমনি আছে শিল্পতে আবেদন। মায়ের ভালোবাসার মতোন চিরকালীন বিষয় যেমন চলচ্চিত্র কারের ক্যামেরায় ওঠে এসেছে, তেমনি মোবাইল ফোন ও অমানবিক সমাজের চিত্রায়ণও আছে, যা খুবই সা¤প্রতিক ও সমকালীন। বর্তমানের ডিজিটাল বাস্তবতা ও ফাকির মাঝে যে চিরকালের প্রশ্নের উত্তরহীনতা আছে সেরকম বিষয়ও এখানে প্রাধান্য পেয়েছে। ডিজিটাল কোয়েশ্চেন ছবিটিতে ডিজিটাল অগ্রগতির বিপরীতে দারিদ্র্যের দ্রুততম বিস্তারের যে মন্তাজ তৈরী হয়েছে তা সত্যিই অসাধারন। আমার কাছে বড় বিস্ময়ের বিষয় এই যে, এই সব তরুন বন্দুরা কিভাবে এত বিস্তারিত ……. স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবিতে বিচিত্র সব বিষয় ও সমাজ আয় জীবনকে নির্মান করতে …. হয়েছেন। এত তরুন বয়সে তাদের অর্থাৎ এইসব চলচ্চিত্রকারদের কর্মক্ষমতার ও সৃজনশীলতার বিকাশ আমাকে সাত্যকার অর্থেই আনন্দিত করেছে।

আমার কেবল মনে হয়েছে। যে স্বপ্ন নিয়ে আমাদের তরুন বয়সে আমরা বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র আন্দোলন শুরু করেছিলাম। তা যেন বা এইসব বর্তমানের তরুন ও আগামীদিনের চলচ্চিত্রকারদের মধ্যেই বাস্তবে পরিণত হচ্ছে। আমার বা আমাদের স্বপ্ন ও শিল্প সংগ্রাম বৃথা যায়নি। আগামীর পৃথিবীতে এই স্বপ্ন সঞ্চায়িত হয়েছে। এই সব তরুন চলচ্চিত্র কর্মিরা অনাগত দিনে আমাদের চলচ্চিত্র স্বপ্নকে অনেকদূর নিয়ে যাবে। পরিনতিরতো শেষ নেই, শিল্পের ক্ষেত্রে তা আরো বেশি সত্য। এই তরুন চলচ্চিত্র কর্মিরা শিল্প স্বপ্নকে পরিনতির অশেষ পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে এবং এই পথে আরো অনেক নতুন নতুন মুখ ও শিল্পী যোজিত হবে।

যাহোক আমরা পৃথক পৃথক ভাবে বিচার কর্ম সম্পাদন করলাম। কেউ কারো সাথে ভাগাভাগি করলাম না। আমি পিন্টু ভাই প্রদীপ দা’র ফলাফল যোগ করে চূড়ান্ত রায় তৈরী করা হলো। বিচার শেষে দেখলাম, যদিও আমরা কেউ কারো সাথে শেয়ার করিনি, তথাপিও তিনজনের ফলাফল একেবারেই এক রকম হয়েছে। এটা একটা আশ্চর্যের বিষয় যে, শেষ পর্যন্ত আমাদের তিনজনের চিন্তার ঐক্যই সম্মিলিত ও পৃথক ফলাফলও একই করেছে।

তপর বিজয়ীদের পুরষ্কার দেয়া হলো। প্রথম পুরষ্কার ৪০,০০০ টাকা দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুরষ্কার সেই অনুপাতে করা হয়েছে। তাছাড়া সাউদান বিশ্ববিদ্যালয়ের যারা চলচ্চিত্র নির্মান করেছেন তাদেরকেও কর্তৃপক্ষ সম্মানিত করেছেন। সমাপর্নী দিবসে সাউদান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা জনাব সরওয়ার জাহান, দখিনা আন্ত: বিশ্ববিদ্যালয় স্বাল্পদৈর্ঘ্য প্রফেসর ডঃ ইশয়াত জাহান, নাট্যজন প্রদীপ দেওয়ানজি, চলচ্চিত্র গবেষক আনোয়ার হোসেন পিন্টু এবং আমি অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলাম। আরো ছিলেন ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন। জনাব সরওয়ার জাহান, বিজয়ী ও অংশগ্রহনকারীদের মধ্যে পুরষ্কার তুলে দেন।

এটা একটা গুরুত্ব পূর্ণ বিষয় যে দখিনা আন্ত: বিশ্ববিদ্যালয় স্বাল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতা ২০১৬ চট্টগ্রামের প্রথম প্রতিযোগিতামূলক চলচ্চিত্র আসর। আর এই প্রথম কাজটির সূচনা করেছেন সাউদান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সরওয়ার জাহান। তাই তাগে অভিনন্দিত করি। একই সাথে চট্টগ্রামের প্রথম প্রতিযোগিতা মূলক চলচ্চিত্র আসরে যারা পুরষ্কার পেয়েছেন ও অংশ গ্রহণ করেছে তাদের জন্যও প্রানঢালা শুভেচ্ছা। আর সাউদান বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব কর্মিরা নীরবে কাজ করে এত বড় প্রতিযোগিতা সম্মন্ন করেছেন তারাতো সত্যিই ইতিহাসে অন্তভূক্ত, হলেন তাদের শ্রম ও মেধায় এই প্রতিযোগিতা শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছে ও চট্টগ্রামে প্রথম চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতা হিসাবে ইতিহাস রচনা করেছে।

এই চলচ্চিত্র আয়োজন যদি নিয়মিত করা যায়, তবে শুধু চট্টগ্রাম নয়, সারা দেশের বিকল্প ধারার সিনেমা নতুন অধ্যায় সূচিত হবে। তাই এব্যাপারে সাউদান বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশেষত সরওয়ার জাহান ভাই যদি উদ্যোগ গ্রহন করেন, এই শিল্প হবে ইতিহাস আগামীর পথে আগ্রসর হবে।

নাজিমুদ্দীন শ্যামল: কবি ও সাংবাদিক , চলচ্চিত্র ও নাট্যকর্মি