করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা শুরু হয়েগেছে৷ প্রতিষ্ঠানগুলো দেউলিয়া হওয়াসহ আছে সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থান হারানোর শঙ্কা৷ তবে উন্নত দেশগুলো এই পরিস্থিতি সামলাতে বিভিন্ন আর্থিক ব্যবস্থা নিচ্ছে৷
সব ধরনের কোম্পানি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য ১১০ কোটি ডলারের ঋণ দিচ্ছে জার্মান সরকার৷ দুর্যোগকালীন এই পরিস্থিতি সামাল দিতে মোট ৫৩ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের তহবিল রয়েছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক৷ কোম্পানিগুলোর আর্থিক স্বচ্ছলতা বজায় রাখতে দেয়া হচ্ছে কর-ছাড়৷ দেরিতে ঋণ পরিশোধে গুণতে হবে না জরিমানা৷ প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটকে দেয়া হবে সাড়ে ১৪ কোটি ইউরো৷
অর্থনৈতিক ধাক্কা সামাল দিতে ২১ হাজার ৯০০ কোটি ডলারের তহবিল ঘোষণা করেছে স্পেন৷ ক্ষতিগ্রস্ত কোম্পানি, কর্মী আর আর্থিক অস্বচ্ছলদের সুরক্ষায় এই অর্থ ব্যয় করা হবে৷ এর মধ্যে শুধু সামাজিক নিরাপত্তায় খরচ করা হবে প্রায় ৬৪ কোটি ডলার৷
১৮ মার্চ থেকে ১৫ দিনের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে পর্তুগাল৷ এখন পর্যন্ত এক হাজার কোটি ডলারের প্রণোদনা ‘প্যাকেজ’ ঘোষণা করেছে দেশটির সরকার৷ এরমধ্যে ৩২২ কোটি ডলার পর্যটন, বস্ত্র, কাঠসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য ঋণ সহায়তা হিসেবে দেয়া হবে৷ ৫৩৬ কোটি ডলার আর্থিক প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে কর সুবিধা ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে৷
প্রায় পাঁচ হাজার কোটি ডলার সহায়তা তহবিলের প্রকল্প হাতে নিয়েছে ফ্রান্স সরকার৷ এর বড় একটি অংশ দেয়া হবে ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে৷ রেস্টুরেন্ট, দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং কোয়ারান্টিনের কারণে যেসব কর্মী কাজে যোগ দিতে পারছেন না, তাদের জন্য কয়কশ’ কোটি ডলার ব্যয়ের ঘোষণা দেয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে৷
করোনা ভাইরাসের কারণে ১৪৫০ কোটি ডলারের জরুরি আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করেছে যুক্তরাজ্য৷ জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা এবং সমস্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের লোকসান মেটাতে এই টাকা দেয়া হবে৷ পাশাপাশি খুচরা ব্যবসা এবং পর্যটন শিল্পের জন্য ৪০ হাজার কোটি ডলারের ঋণ তহবিলও রাখা হয়েছে৷
সম্প্রতি ১০ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের একটি সহায়তা প্যাকেজের অনুমোদন দিয়েছে সেনেট৷ স্বাস্থ্য বিমা ছাড়াই করোনার পরীক্ষা করানো, স্কুলগামী শিশুদের জন্য খাবার সরবরাহ, কর্মীদের ১০ দিনের অসুস্থতাজনিত এবং কিছু ক্ষেত্রে ১২ সপ্তাহের বেতনসহ ছুটির পেছনে এই টাকা ব্যয় হবে৷ পাশাপাশি এক ট্রিলিয়ন ডলারের আরেকটি প্রণোদনা প্যকেজের জন্য আইনপ্রণেতাদের সঙ্গে আলাপ চালিয়ে যাচ্ছে ডনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন৷
ক্যানাডার জন্য পাঁচ হাজার ৬৪০ কোটি ডলারের সহায়তা দেয়ার কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো৷ এই অর্থ দেশটির জিডিপির তিন শতাংশ ৷ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কর-ছাড়, কর্মীদের বেতন, সমাজে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ব্যয় হবে এই অর্থ৷
১১০০ কোটি ডলারের আর্থিক প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া সরকার৷ ৬৫ লাখ নিম্ন আয়ের মানুষকে এককালীন ৪৫১ ডলার করে দেয়া হবে এই তহবিল থেকে৷ পাশাপাশি এক লাখ ২০ হাজার শিক্ষানবিশ চাকুরিজীবী এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখতেও খরচ করা হবে এখান থেকে৷ অন্যদিকে অর্থনীতিকে সচল রাখতে ঋণের সুদহার কমিয়ে দিয়েছে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক৷
করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় ১৫৪০ কোটি ডলারের ব্যয় পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে তুরস্ক৷ ‘অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা’ শিরোনামের এই প্যাকেজটির আওতায় মোট ২১ টি খাতে খরচ করা হবে৷ এর মধ্যে অবসরকালীন ভাতা বৃদ্ধি, ব্যবসা সহযোগিতা, মূল্য সংযোজন কর হ্রাসসহ খুচরা, ইস্পাত, গাড়ি ও পর্যটন শিল্পে আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে৷
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব
করোনা ভাইরাস শুধু স্বাস্থ্য ঝুঁকি নয়, গোটা বিশ্বের অর্থনীতিকেই নাড়িয়ে দিচ্ছে৷ এর ফলে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিও কমে যেতে পারে৷ চাকুরি হারাতে পারেন মানুষ৷ করোনা ভাইরাস আতঙ্কে একের পর এক নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ৷ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে স্টেডিয়ামের খেলা থেকে শুরু করে বড় বড় সব বৈশ্বিক আয়োজন৷ স্কুল, কলেজ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কমে আসছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড৷ র্ধমিয় উপসানালয়ও এর বাইরে নয় । ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞার কারণে লোকসানে পড়ছে বিশ্বের এয়ারলাইন্সগুলো৷ ঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়ার আশংকায় রয়েছে বড় বড় প্রতিষ্ঠান৷ প্রতিদিনই ধ্বস নামছে প্রধান সব শেয়ার বাজারে৷
বিশেষজ্ঞদের মতে করোনা ভাইরাসের প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি দেখা দিবে ৷ চলতি বছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২০১৯ সালের চেয়ে অর্ধেক কমে যাবে ৷ ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা ভাইরাস বিশ্ব অর্থনীতিতে দুই দশমিক সাত ট্রিলিয়ন ডলারের লোকসান ঘটাবে, যা গোটা যুক্তরাজ্যের জিডিপির সমান৷ এমনকি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, জাপান মন্দায় পড়তে পারে বলেও আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে৷ এর প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কতটা পড়বে?
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে রপ্তানি আয় এমনিতেই পড়তির দিকে৷ জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি কমেছে চার দশমিক সাত নয় ভাগ৷ অব্যাহতভাবে কমছে পোশাক রপ্তানি৷ ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র এই পণ্যটির প্রধান বাজার৷ করোনা ভাইরাসের কারণে সেখানকার বাজারে এরিমধ্যে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে৷ ইটালিতে মানুষ ঘর থেকেই বের হতে পারছে না৷ যেখানে ১৪৩ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ গত বছর৷ ধীরে ধীরে একই পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে গোটা ইউরোপে, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও৷ বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির ৬২ ভাগ আসে ইউরোপ থেকে আর ১৮ ভাগই যুক্তরাষ্ট্র থেকে৷
তৈরি পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন তারা এরই মধ্যে চাহিদা কমে যাওয়ার আঁচ পেতে শুরু করেছেন৷ যুক্তরাষ্ট্রের খুচরা বাজারে শতকরা তিন দশমিক এক ভাগ বিক্রি এরইমধ্যে কমে গেছে, কমে যেতে শুরু করেছে ক্রেতাদের কার্যাদেশও৷ কারখানার মালিকরা ভয় হচ্ছে ইউরোপ নিয়ে,সেখানে যদি করোনা ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে পোশাকের চাহিদা অনেক কমে যাবে৷ মানুষ যদি ঘর থেকে বেরই না হতে পারে তাহলে পোশাক কিনবে কিভাবে?’’
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির বেশিরভাগ সূচকই নিম্নমুখী৷ তার মধ্যেও ভাল করছিল রেমিট্যান্স৷ চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে ১০৪২ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ ভাগ বেশি৷ এই গতি ধরে রাখা এখন কঠিন হয়ে যাবে বাংলাদেশের জন্যে৷ যেইসব দেশ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত সেখানে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এরইমধ্যে কমে গেছে৷ সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশি শ্রমিক বা ব্যবসায়ীরা প্রয়োজনমত আয় করতে না পারলে দেশে পরিবারের কাছে আগের মতো টাকা পাঠাতে পারবেন না৷ তাই স্বভাবতই রেমিট্যান্স কমতে থাকবে৷ এর প্রভাব পড়বে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে৷
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান দুই চালিকা শক্তি রপ্তানি ও রেমিট্যান্স৷ রপ্তানি আয় কমে গেলে দেশের শিল্প কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের আয় কমে যাওয়া বা কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা তৈরি হবে৷ অন্যদিকে প্রবাসীরা টাকা পাঠানো কমিয়ে দিলে তাদের পরিবার দেশে আগের মত খরচ করতে পারবেন না৷ এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ব্যবসা বাণিজ্যে৷ কমে যাবে বেচাকেনা৷ চাহিদা কমে গেলে ভোক্তা পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতির মুখে পড়বে৷
আবার বাংলাদেশেও করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে অর্থনীতির গতি ধীর হয়ে যাবে৷ সব মিলিয়ে চলতি বছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য পূরণ বড় চ্যালেঞ্জ হবে সরকারের জন্যে৷
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এডিবি এরিমধ্যে বলেছে বাংলাদেশের জিডিপি সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে এক দশমিক এক ভাগ কমে যেতে পারে৷ তাদের হিসাবে এতে মোট তিনশো কোটি ডলারের ক্ষতি হবে, আট লাখ ৯৪ হাজার ৯৩০ জন চাকুরি হারাবে৷ ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের এক প্রতিবিদনে এমন তথ্য দেয়া হয়েছে৷
তবে করোনা ভাইরাস যদি বিশ্ব অর্থনীতিতেই গভীর প্রভাব ফেলে বাংলাদেশ কিভাবে প্রস্তুতি নিবে বা অন্যদেশের অসুবিধা কতটা কাজে লাগাতে পারবে বাংলাদেশ সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে৷