‘অদৃশ্য শত্রু’ করোনায় স্বেচ্ছা অবরোধে বিশ্ব-বন্দি চারদেয়ালে

0
489

দুনিয়ার অধিকাংশ দেশ এখন স্বেচ্ছা অবরুদ্ধ। চোখে না দেখা এক ভাইরাস কাপিয়ে দিয়েছে গোটা বিশ্বকে। পৃথিবী করোনা ভাইরাস নামে এক নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে । পরস্পরের বিশ্বাস ও আস্থায় চিড় ধরেছে। প্রত্যেক দেশ নিজেই নিজ দেশের ওপর অবরোধ আরোপ করেছে। জনজীবন ক্রমেই বন্দি হয়ে পড়ছে চারদেয়ালে।করোনা ভাইরাসের অভূতপূর্ব প্রভাব পড়েছে বিশ্বের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়াঙ্গনসহ সব ক্ষেত্রে। শিক্ষা ও জনজীবন স্থবির হয়ে গেছে প্রায় সব দেশে। বিশেষভাবে আক্রান্ত দেশগুলো ছাড়াও পরস্পরের অবরোধের আওতায় পড়ে গেছে পৃথিবীর প্রায় সব দেশ। পরস্পরের বিশ্বাস ও আস্থায় চিড় ধরেছে। প্রত্যেক দেশ নিজেই নিজ দেশের ওপর অবরোধ আরোপ করেছে। মহামারি রূপ নেয়া করোনার থাবা সর্বত্র ।ভাইরাস এতোটাই দুনিয়াকে বদলে দিয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই সারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এ অবস্থা বেইজিং থেকে ওয়াশিংটন, রিয়াদ থেকে টোকিও পর্যন্ত।

প্রায় সব দেশের সরকার মনে করে, জরুরি ভিত্তিতে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে এই সংখ্যা  দ্রুত বেড়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে । মৃত্যুর মিছিল এড়াতে জনগণকে আগামী বেশ কিছুদিন পর্যন্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে না যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে প্রায় প্রতিটি দেশের সরকারের পক্ষ থেকে।

বিভিন্ন দেশ প্রথম যে পদক্ষেপ নিয়েছে তা হলো নাগরিকদের চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা। এক দেশের নাগরিক যাতে আরেক দেশে যেতে না পারে। যেমন বাংলাদেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি সফর করে ভারতে। চিকিৎসা ও পর্যটনসহ নানা কারনে তারা ভারত যায়। আগামী ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত সব ধরনের পর্যটক ভিসা স্থগিত করেছে ভারত সরকার। দেশটির কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, কুটনৈতিক, জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক সংস্থা, চাকুরি এবং প্রজেক্ট ভিসা বাদে বিদ্যমান সব ধরনের ভিসা স্থগিত থাকবে। যদিও ভারতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা অনেক কম। যে শতাধিক লোককে আক্রান্ত বলে চিহিৃত করা হয়েছে তার বেশিরভাগ ইতালি থেকে আসা পর্যটক। এই অবস্থা যে শুধু ভারতে তা নয়। ভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর আগে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে ইউরোপ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের ক্ষেত্রে নতুন বিধিনিষেধ আরোপের ঘোষণা দেন ট্রাম্প। ভাষণে তিনি বলেছেন, আগামী ৩০ দিনের জন্য ইউরোপ থেকে সব ধরনের ভ্রমণ স্থগিত থাকবে। কিন্তু এরপরেও যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্ত রোগির সংখ্যা বাড়ছে। বিভিন্ন প্রদেশে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কোন কোন প্রদেশ লক-ডাউন করার প্রক্রিয়ায় আছে ।

দিন যত গড়াচ্ছে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ততই বাড়ছে। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) প্রাদুর্ভাবে গোটা বিশ্বের মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। ১৬২টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া এ ভাইরাসে এরই মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা দুই লাখ ছাড়িয়েছে। মৃতের সংখ্যা শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এসংখ্যা এখন প্রায় ১০,০০০ ছাড়িয়েছে ।

অনেক প্রতিষ্ঠান এখন থেকে নিজেদের কর্মীদের যতটা সম্ভব ঘরে বসে কাজ করার পরামর্শ দিচ্ছে । কোন কোন দেশে মানুষ কেমন পরিস্থিতিতে, কী কী কাজে ঘরের বাইরে যেতে পারবে সে বিষয়ে ধারণা দওয়া হয়েছে, নাগরিকরা শুধু কাজ করার জন্য, খাবার কেনার জন্য, পোস্ট অফিস বা ব্যাংকে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হতে পারবেন। ডাক্তারের পরামর্শে হাঁটার জন্য বা মুক্ত বাতাসে খেলার জন্যও বাইরে যাওয়া যেতে পারে, তবে সঙ্গে একজন পরিবারের সদস্য বা বন্ধু থাকতে পারবে।‘ফার্মেসি, পশু-পাখির খাবারের দোকান, বইয়ের দোকান, সুপার মার্কেট এবং চুল কাটার সেলুন খোলা থাকলেও একসাথে একাধিক মানুষ যেতে পারবেন না।

করোনায় জরুরি পদক্ষেপ নিয়ে জাতির উদ্দেশে দেয়া হৃদয়গ্রাহী ভাষণে কানাডার প্রধানমন্ত্রী বললেন “প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে বিশ্ব। ক্রমেই বেড়ে চলেছে এ ভাইরাসে আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্য”। তিনি অনুরোধ করে বলেন: ১ মাস নিজ বাসায় অবস্থান এবং শুধু মাত্র মেডিসিন, প্রয়োজনীয় খাবার, পানীয় দোকান গুলো খোলা রাখতে বলেছেন৷ সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিটি নাগরিকের বাসায় ১ মাসের যাবতীয় সব ধরনের খাবার পানি মেডিসিন মাস্ক পৌছে দিবার প্রতিশ্রুতি দেন। তাছাড়া যার যখন যা লাগবে যোগাযোগ করলে, বাসায় সব কিছু পৌছে দেয়া হবে। তবুও বের  না হবার জন্য আকুল অবেদন করেন। অঙ্গিকার করে বলেন, ভয় নেই কাউকে অনাহারে মরতে হবে না। নিজ বাসায় অবস্থান করতে বলেন৷ আপাতত: দেশ লক ডাউন করে দিচচ্ছেন।।পরিস্থিতি ঠিক হলে আবার খুলে দিবেন। যারা অফিস আদালত কিংবা অন্য প্রতিষ্ঠানে কাজে নিয়োজিত আছেন, তাদের কারো কাজে যেতে হবে না। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অফিস কারখানা বন্ধ ঘোষনা করেছেন।

‘অদৃশ্য শত্রু’ করোনার হাত থেকে বাঁচতে দেশে দেশে জরুরি অবস্থা, এমনকি কোথাও কোথাও কার্ফ্যু জারি করা হয়েছে। বিভিন্ন দেশ সীমান্ত বন্ধ করে দিচ্ছে এবং স্বেচ্ছা অন্তরীণ হচ্ছে। করোনা আক্রান্ত বেশ কিছু শহর ও এলাকা কোয়ারেন্টিন করা হয়েছে। বাতিল করা হয়েছে বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের নির্ধারিত ফ্লাইট। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বিভিন্ন স্পোর্টস ইভেন্ট। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। দেশটির নিউইয়র্ক, নিউজার্সি ও কানেকটিকাট রাজ্যে কারফিউ ঘোষণা করা হয়েছে।

এশিয়ার দেশ চীন থেকে এই ভাইরাসের উৎপত্তি হলেও তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে। এখন চীন ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রনের দাবি করেছে। নতুন করে আক্রান্তের সংখ্যা কমে এসেছে।ইউরোপ ও আমেরিকায় যেভাবে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ছে চীনের নিকট প্রতিবেশি দেশগুলোতে সেভাবে ছড়ায়নি। যদিও ছড়াবে না এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। চীনের নিকটতম এলাকা তাইওয়ান, হংকং ও সিঙ্গাপুরে এটি নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় আছে বলে মনে করা হচ্ছে।

মধ্যএশিয়ার দেশ কাজাখস্তানে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। বাইরে থেকে অস্ট্রেলিয়ায় ঢুকলেই ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

চীনের প্রতিবেশি দেশ ভারতেও আক্রান্তের সংখ্যা এখন পর্যন্ত তুলনামুলকভাবে কম। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে। সব দেশকে ‘সন্দেহভাজনদের পরীক্ষা’ করতে পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ।

তবে বিস্ময়কর ভাবে চীনের আরেক প্রতিবেশি মিয়ানমারে এ রোগের অবস্থা সর্ম্পকে কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশে কয়েকজন আক্রান্তের কথা স্বীকার করা হয়েছে। ফিলিপাইনে স্কুল, সরকারি অফিসসহ সব কিছু বন্ধ রয়েছে। ম্যানিলায় কারফিউ দেয়া হয়েছে। স্থল, আকাশ ও সমুদ্র বন্দর দিয়ে রাজধানী ম্যানিলার সঙ্গে অভ্যন্তরীণ সব যোগাযোগ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট রুদ্রাগো। নিষিদ্ধ করা হয় কনসার্ট ও সিনেমা প্রদর্শন। এছাড়া সব স্কুলের ক্লাস এক মাস পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। থাইল্যান্ডে সর্তকতামুলক বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। দেশটি পুরোপুরি ভাবে পর্যটকশূন্য হয়ে পড়ছে।

দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি তালিকায় রয়েছে ইন্দোনেশিয়া। ইন্দোনেশিয়া এপর্যন্ত ৩০৯ জন আক্রান্ত হয়েছে যাদের মধ্যে ১৫ জন সুস্থ হয়েছে বলে জানা যায়।এপর্যন্ত ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে দেশটির মুখপাত্র আছমাদ ইউরিয়ানো। ইন্দোনেশিয়ার কর্তৃপক্ষ ভাইরাসের বিস্তার রোধের প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে পরের মাসের জন্য বিদেশী যাত্রীদের জন্য ভিসা-মুক্ত ভ্রমণ এবং ভিসা-অন-আগমন বিকল্প স্থগিত করছে।এদিকে ফিলিপিন্সে করোনায় মারা গেছে ১৭ জন এবং মালয়শিয়ায় ২ জন।

এছাড়া আফ্রিকার দেশ মৌরিতানিয়া, রুয়ান্ডা, সিসেলেস ও মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে আফ্রিকায় ভাইরাসটিতে আক্রান্ত দেশের সংখ্যা ২৩টিতে দাঁড়াল।

 মধ্যপ্রাচ্য: মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। নেয়া হয়েছে বিভিন্ন ধরনের সর্তকতামুলক ব্যবস্থা। অনেক দেশ ভিসা দেয়া বন্ধ করেছে। বিদেশি শ্রমিক নির্ভর মধ্যপ্রাচ্যর দেশগুলোর অর্থনীতির ওপর এর বিরুপ প্রভাব পড়ছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ দেশ ইরান। এক দশকের বেশি সময় ধরে ইরানের ওপর অবরোধ আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।চীনের পর ইরানে দ্রুত ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে। কত লোক মারা গেছে তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে এ সংখ্যা হাজারের কাছাকাছি বলে অনুমান করা হচ্ছে। অবরোধের কারনে দেশটির চিকিৎসা ব্যবস্থাতেও সঙ্কট রয়েছে। দেশটির জ্যেষ্ঠ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও অন্য দুজন কেবিনেট সদস্য করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছে ফারস নিউজ। এ ছাড়া দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসহাক জাহাঙ্গিরিকে জনসমক্ষে দেখা যাচ্ছে না বলে ধারণা করা হচ্ছে, তাঁরও করোনা সংক্রমণ ঘটেছে।

পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত করোনা সংক্রমণের ভয়ে উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলোয় সব ধরনের বাণিজ্যিক ফ্লাইট কুয়েত বন্ধ করেছে। ১৩ র্মাচ শুক্রবার থেকে পরবর্তী নোটিশ না দেওয়া পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত কার্যকর থাকবে। এ ছাড়া দেশটিতে ১২ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত জাতীয় ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এ সময় জরুরি সেবা চালু থাকলেও নাগরিকদের রেস্তোরাঁ, ক্যাফেতে যেতে নিষেধ করা হয়েছে।

কাতার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশটিতে এক দিনে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২৮ থেকে বেড়ে ২৬২ হয়েছে। নতুন করে যে ২৩৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন, সবাই বিদেশি এবং করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে এসেছিলেন।

ভাইরাসের বিস্তার রোধে মুসলিমদের প্রথম কিবলাহ ও তৃতীয় পবিত্র স্থান আল-আকসা মসজিদ সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জেরুজালেমের ওয়াকফ কমিটি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সাবধানতার অংশ হিসেবে এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। তবে মসজিদের বাইরের অংশ ইবাদতের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। এর আগে মুসলমানদের আরেক পবিত্র স্থান কাবা শরীফে উমরাহ পালনে বিধি নিষেধ আরোপ করে সৌদি আরব। ফলে কয়েকদিন ফাকা ছিলো কাবা চত্বর।

করোনাভাইরাস মোকাবেলায় মক্কা ও মদিনার দুটি বড় মসজিদ ছাড়া সব মসজিদে নামাজ স্থগিত করেছে সৌদি আরব। এমন দৃষ্টান্ত আগে কখনো দেখা যায় নাই। মঙ্গলবার ১৭ র্মাচ সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ধর্মীয় সংস্থা দ্য কাউন্সিল অব সিনিয়র স্কলার্স ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে বৈঠকের পর মসজিদগুলোতে নামাজে স্থগিতাদেশের সিদ্ধান্তের কথা জানায় কর্তৃপক্ষ। দেশটির ইসলাম ধর্মবিষয়কমন্ত্রী আবদুল্লাতিফ বিন আবদুলআজিজ আল-শেখ আল জানান, ‘মহামারী করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে সরকারের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে মসজিদগুলোতে নামাজে স্থগিতাদেশের সিদ্ধান্ত জারি করা হয়েছে।’ দেশটিতে এ পর্যন্ত ১৩৩ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।

আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল দুই সপ্তাহের জন্য স্থগিত করেছে সৌদি আরব। দেশটিতে কোনও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট অবতরণ ও উড্ডয়ন করবে না। বিমান চলাচল বাতিলের কারণে যেসব নাগরিক ও স্থায়ী বাসিন্দা অন্য দেশ হতে সৌদি আরব ফিরতে পারবেন না বা কোয়ারেন্টাইনে থেকে সৌদি আরবে ফিরবেন, তাদের জন্য এই দুই সপ্তাহ বিশেষ সরকারি ছুটি হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এর আগে পুরো ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং এশিয়া ও আফ্রিকার ১২টি দেশের সঙ্গে বিমান চলাচল স্থগিত করেছিল সৌদি আরব। সংযুক্ত আরব আমিরাত বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের ভিসা প্রদান স্থগিত রেখেছে। দেশটির শিক্ষা প্রতিষ্টানও বন্ধ রেখেছে।

করোনায় আক্রান্ত ইতালি, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ও ইরানের সব ধরনের ফ্লাইট লেবানন বন্ধ করে দিয়েছে। এর বাইরে দেশটিতে ফ্রান্স, মিসর, সিরিয়া, ইরাক, স্পেন, যুক্তরাজ্য, জার্মানির কোনো নাগরিক ঢুকতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াব।

বাংলাদেশসহ ১৪ দেশের নাগরিকদের কাতারে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে কাতার। ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানিয়েছে দোহা। এছাড়া বিভিন্ন দেশের সাথে কাতার এয়ার ওয়েজের বিমান যোগাযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে। একই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে কুয়েত।

 ইউরোপ: করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে নতুন করে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপের ঘোষণা দিয়েছে জার্মানি, ফ্রান্স ও স্পেন। জার্মানিতে ক্লাব, বার, অবকাশ কেন্দ্র, চিড়িয়াখানা, খেলার মাঠ বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছেন চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা ম্যার্কেল। নির্দিষ্ট সময়ে রেস্টুরেন্ট খোলা রাখা গেলেও টেবিলগুলোর মাঝে ন্যূনতম দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

ইউরোপের অবস্থা মোটেও ভালো নয়।ইউরোপের এক দেশ থেকে আরেক দেশে অসুখটি ছড়িয়ে পড়ছে। এরমধ্যে সবচেযে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ইতালি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলছে ইউরোপ এখন ভাইরাসটির কেন্দ্রবিন্দু। ইউরোপের সবেচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ দেশ ইতালি। যেখানে প্রায় তিন হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে। বলা যায় ইতালি এখন শোকে স্তবদ্ধ হয়ে পড়েছে। ইতালির প্রধানমন্ত্রী গুইসেপ কন্তে বলেছেন, ভাইরাসটির ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ মারাত্মক ও বিস্তৃত হবে। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের পর কোনো কিছুই আগের মতো থাকবে না, আমাদের বসতে হবে এবং বাণিজ্য ও মুক্ত বাজারের নিয়মগুলো নতুন করে লিখতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, করোনা মোকাবিলায় দেশটির সব স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় ও ডে কেয়ার সুবিধাগুলো বন্ধ থাকবে। কাল ১৩ র্মাচ শুক্রবার থেকে জরুরি কর্মী ছাড়া সব কর্মীকে বাড়িতে থাকতে হবে।

খারাপ পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে যাচ্ছে ইউরোপের আরেক দেশ স্পেন। স্পেন ও ইতালির পরে দেশটিতে করোনাভাইরাসে সংক্রমণের হার ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকায় স্পেন সরকারও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। দেশটি তাদের স্থলসীমান্তও বন্ধ করে দিয়েছে। ইতোমধ্যে ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে স্পেন। স্পেনে অধিক সংক্রামিত শহর মাদ্রিদে সংক্রামিত হয়েছে বিপুল সংখ্যক মানুষ। স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজের স্ত্রী বেগোনা গোমেজ নিজেও ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। মহামারি ঠেকাতে ইতোমধ্যেই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। দেশের বড় বড় শহরগুলোর সব দোকান, বার ও রেস্টুরেন্ট বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া এ সময়ের মধ্যে সব ধরনের লোক সমাগম, জনসভা ও প্যারেড বন্ধ থাকবে বলেও জানানো হয়েছে।

স্পেনের মতো ব্যবস্থা নিয়েছে ফ্রান্স। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইকে ‘যুদ্ধ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। তিনি বলেন, ‘উই আর অ্যাট ওয়্যার।’ একইসঙ্গে তিনি ফ্রান্সে পুরোপুরি লকডাউন ঘোষণা করেন। সবাইকে ঘরে অবস্থান করার নির্দেশ দেন। যদি অনলাইনে ফরম পূরণ না করে কেউ ঘরের বাইরে যান তাহলে তাকে জরিমানা করা হবে। ১৬ র্মাচ সোমবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল বলেন, আগামী ১৫ দিন ফ্রান্সে চলাচলে কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকবে। দেশের বেশিরভাগ দোকানপাট, রেস্তোরা ও বিনোদন কেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করেছে ফ্রান্স। সেদেশের প্রধানমন্ত্রী এদুয়ার্দ ফিলিপ জানিয়েছেন, ‘অপরিহার্য নয়’ এমন জনপরিসরগুলো এ ঘোষণার আওতায় পড়বে। ফরাসি কর্তৃপক্ষ এরইমধ্যে সব স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে, ১০০ এর বেশি মানুষের জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং মানুষকে দেওয়া হয়েছে সামাজিক জীবন-যাপন সীমিত করার পরামর্শ। তবে ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী ফিলিপ মনে করেন, এইসব ব্যবস্থাগুলো ভালোভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।

সুইজারল্যান্ড সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে দেশটির সঙ্গে ফ্রান্সের সীমানায় নজরদারি চালানো হবে। যারা সুইস নাগরিক তারা শুধু যাতায়াতের অনুমতি পাবেন অথবা যারা এ দেশের বাসিন্দা তারা এ সুবিধা পাবেন। পণ্যবাহী গাড়ি আসতে দেয়া হচ্ছে তবে ছোট চেকপোস্টগুলো বন্ধ রেখে বড়ে চেকপোস্ট দিয়ে বেশিরভাগ গাড়ি যেতে দেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

ইউরোপের দেশগুলো থেকে মাল্টায় ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন ও সুইজারল্যান্ড থেকে আসা নাগরিকদের দেশটিতে ঢুকতে দেওয়া হবে না। গত সোমবার ইতালিকেও এ তালিকায় ফেলে দেশটি।

জুনিয়র স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাদিন ডোরিস দেশটির প্রথম এমপি, যিনি করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন। এর ফলে ওয়েস্টমিনস্টার, এমনকি ডাউনিং স্ট্রিটেও এই রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। কারণ, গত সপ্তাহেই ডাউনিং স্ট্রিটে অনুষ্ঠিত একটি অভ্যর্থনায় তিনি অংশ নিয়েছিলেন, যাতে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনও। দেশটিতে করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে ৪৫৬–তে পৌঁছেছে। দেশটিতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ছয়জন। ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে ব্রিটেনের সরকার আগামী সপ্তাহে জনসমাগমে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে যাচ্ছে। নিজ দেশের নাগরিকদের বিশ্বের যে কোনো স্থানে অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ না করতে ভ্রমণ নির্দেশিকা ঘোষণা করেছে ব্রিটিশ সরকার।বৈশ্বিক মহামারী করোনার বিস্তার ঠেকানোর লড়াইয়ের অংশ হিসেবে মঙ্গলবার দেশটির সরকারের পক্ষ থেকে এমন সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।ইংল্যান্ডের প্রিমিয়ার লিগের সব খেলা আগামী ৪ এপ্রিল পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে। এছাড়া আয়োজকরা লন্ডন ম্যারাথনও স্থগিত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন মে মাসের স্থানীয় ও মেয়র নির্বাচন এক বছরের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেছেন।

ইউরোপের আরেক দেশ জার্মানীও নানা ধরনের সর্তকতামুলক ব্যবস্থা নিয়েছে। জার্মান চ্যান্সেলর সর্তক করেছেন দেশটির ৭০ শতাংশ মানুষ ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হতে পারে। ইতোমধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্টানগুলো বন্ধ করা হয়েছে। যদিও আক্রান্তের সংখ্যাও বেড়ে চলছে।জার্মানিতে প্রায় ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে রোগী বেড়েছে ৩৬১ জন। এ নিয়ে দেশটিতে রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ৬২২। এ পর্যন্ত মারা গেছেন তিনজন।

রাশিয়া ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স ও স্পেনের সব ধরনের ফ্লাইট বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ১৩ র্মাচ শুক্রবার থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর । এ ছাড়া ইতালিয়ান নাগরিকদের সব ধরনের ভিসা দেওয়া বন্ধ করে দিচ্ছে দেশটি। রাশিয়ায় করোনায় আক্রান্ত রোগী ২০ থেকে বেড়ে ২৮ জন হয়েছে। এর আগে ইতালিতে ভ্রমণ করা নাগরিকদের মধ্যে ওই রোগ পাওয়া গেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বার্তা : করোনাভাইরাস মহামারীর প্রকোপ কমিয়ে আনতে সন্দেহভাজন রোগীদের পরীক্ষার কোনো বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। একই সঙ্গে সংকট কাটাতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামের উৎপাদন বাড়াতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় গত সোমবার সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রস আনানম গেব্রেয়াসুস। তিনি বলেন, ‘সব দেশের প্রতি আমাদের খুব সাধারণ একটি বার্তা হল- পরীক্ষা, পরীক্ষা ও পরীক্ষা।