করোনায় নিয়ন্ত্রনে যেসব দেশ

0
433

করোনা নিয়ে বিশ্বের কী অবস্থা, সে কথা আজ সবাই জানে, বিশ্বব্যাপী লাখের উপর মানুষ মারা গেছে এবং প্রতিদিন মারা যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আক্রান্ত হয়েছে এবং হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস লন্ড-ভন্ড করে দিচ্ছে বিশ্বকে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে জীবনযাত্রা। গৃহবন্দি মানুষ। থমকে গেছে মানবসভ্যতা। সব মিলিয়ে মানুষের মাঝে তৈরি হয়েছে এক ধরনের তীব্র আতঙ্ক। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশগুলোও অদৃশ্য এই ভাইরাসের কাছে চরম অসহায় হয়ে পড়েছে। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, স্পেন, ইরান, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া,কানাডা, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, হংকং,  কিউবা, শ্রীলংকা, তুরস্ক, নেপাল, ভুটান নিয়ন্ত্রনের সাক্ষর রেখেছে।

করোনা ভাইরাসে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটছে যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, স্পেন, ইরান, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সে। এসব দেশে এত মানুষের মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। জানা গেছে, এসব দেশে বেশি মৃত্যুর পেছনে নানা কারণ রয়েছে। এর মধ্যে আছে সংকটের ভয়াবহতা বুঝতে বিলম্ব, পূর্ব-প্রস্তুতিতে উদাসীনতা, ব্যাপকহারে করোনা টেস্ট না করা ও অপ্রতুল স্বাস্থ্য সেবা। এছাড়া এসব দেশে বিপুল সংখ্যক প্রবীণ মানুষের বসবাসও সংক্রমণ ও মৃত্যুহার বাড়ার বড় কারণ।

মৃত্যুহার নিয়ন্ত্রনের রাখার ক্ষেত্রে দারুণ সাফল্য দেখিয়েছে জার্মানি ও দক্ষিণ কোরিয়া। এ দুই দেশে করোনায় মৃত্যুহার ১ শতাংশেরও কম। ইউরোপের বড় বড় দেশের মধ্যে জার্মানিতে মৃত্যুহার সবচেয়ে কম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর অন্যতম কারণ নিবিড়ভাবে করোনা পরীক্ষা। জার্মানি অনেক আগে থেকেই ব্যাপক হারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে। এমনকি কারও মধ্যে করোনার মৃদু উপসর্গ দেখা দিলেও পরীক্ষার আওতায় আনা হয়েছে। ফলে দেশটিতে করোনায় শনাক্ত রোগীর সংখ্যা প্রকৃত সংখ্যার কাছাকাছি। দক্ষিণ কোরিয়ায়ও একই অবস্থা।

জার্মানির স্বাস্থ্যসেবার সক্ষমতাও অনেক বেশি। এখানে নিবিড় পরিচর্যার সক্ষমতা ফ্রান্স, ইতালি ও যুক্তরাজ্যের মতো ইউরোপের উন্নত দেশগুলোর চেয়ে বেশি। জার্মানিতে বর্তমানে যত গুরুতর অসুস্থ করোনা রোগী রয়েছে, তার চেয়েও বেশি লোককে চিকিৎসার সামর্থ্য রয়েছে দেশটির। এ কারণে ইতালি ও ফ্রান্স থেকে করোনা রোগী নিয়ে জার্র্মানিতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। যুক্তরাজ্যে করোনা রোগী জার্মানির এক-তৃতীয়াংশ, অথচ মারা গেছে জার্মানির চেয়ে তিন গুণ মানুষ।

জার্মানি প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে রক্ষায়ও দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে। করোনা সংক্রমণ শুরু হতেই জার্মানিতে প্রবীণদের চলাচলে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। তাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎও নিষিব্দ করা হয়। এর ফলে রোগটি প্রবীণদের মধ্যে কম ছড়িয়েছে। জার্মানির মোট জনসংখ্যার ৭ ভাগের বেশির বয়স ৮০ বছরের ঊর্ধ্বে হলেও আক্রান্তদের মধ্যে এই বয়সী মাত্র ৩ শতাংশ। জার্মানির চিকিৎসাসেবারও সম্প্রতি আধুনিকায়ন করা হয়েছে। চিকিৎসাকর্মী বাড়ানো হয়েছে, অর্থায়নও বেড়েছে। এমনও হয়েছে যে, করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর গুরতর অসুস্থ রোগীকে ৩০ দিন পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে।

চীনের পরপরই করোনাভাইরাস যে দেশটিতে সবচেয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে দক্ষিণ কোরিয়া। তবে কর্তৃপক্ষ অবিলম্বে এটি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়। এ জন্য চীনের মতো কড়া পদক্ষেপও নিতে হয়নি সিউলকে। এমনকি দক্ষিণ কোরিয়ার সবচেয়ে সংক্রমিত এলাকা দায়েগুকেও লকডাউন করা হয়নি। দক্ষিণ কোরিয়ায় মৃতের হার ১ দশমিক ৬ শতাংশের কিছুটা বেশি। সারাবিশে^ করোনায় আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৫ শতাংশ মানুষের। দক্ষিণ কোরিয়ার মতো মৃত্যুর হার এখনও কম তুরস্ক, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশে। দক্ষিণ কোরিয়ার সাফল্যের মূলে রয়েছে দেশটির চমৎকার স্বাস্থ্যসেবা, ব্যাপক হারে করোনা পরীক্ষা ও আইসোলেশনে রাখা এবং আক্রান্তদের চিকিৎসা। এর আগে দেশটি সার্স ও মার্সের মতো মহামারির শিকার হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতাও কাজে দিয়েছে তাদের। চীনে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই গত ১১ জানুয়ারি থেকে পরীক্ষা শুরু করে দক্ষিণ কোরিয়া। দেশটিতে করোনায় আক্রান্তদের পৃথক হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ফলে অসুস্থদের মাধ্যমে সংক্রমণ তেমন ছড়াতে পারেনি।

অনেক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, দক্ষিণ কোরিয়া যেভাবে দ্রুততার সঙ্গে করোনা পরীক্ষা করেছে, তা অসাধারণ। বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশেই টেস্টের হার কম। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হচ্ছেন না। এতে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটছে। উপসর্গ পাওয়া গেলেই পরীক্ষা করাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।

একই অবস্থা কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশি কানাডায় করোনার সংক্রমণ এখনও অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। করোনা রোধে দেশটির জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর পদক্ষেপ দেশ বিদেশে প্রশংসিত হচ্ছে। অন্যদিকে চীনের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক থাকলেও অস্ট্রেলিয়াতেও করোনা মহামারি রূপ নিতে পারেনি। এছাড়া সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান ও হংকংয়ের করোনা নিয়ন্ত্রন করা গছে। । চীনের প্রতিবেশি এসব দেশে করোনা একেবারেই নিয়ন্ত্রণে। চীনের কারোনা শনাক্ত হওয়ার পরই তারা ত্বরিত পদক্ষেপ নেয়। ফলে এসব দেশে এখনও জীবনযাত্রা অনেকাংশে স্বাভাবিক।

চীনের মতো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহন ছাড়াই অনেক দেশ সফলতা পেয়েছে। এসব দেশ যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তার মধ্যে রয়েছে- ভ্রমণে কড়াকড়ি, সন্দেহভাজনদের কোয়ারেন্টাইন এবং সামাজিক যোগাযোগ কমানো, যেমন :সেলফ আইসোলেশন, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধি উন্নয়ন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব পদক্ষেপ এখন অন্যান্য দেশও নিচ্ছে। তবে এরই মধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য এখন এ ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে। কিন্তু চীনে সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর তারা দু’মাস সময় পেয়েছিল।

গত ৩১ ডিসেম্বর চীন রহস্যজনক ভাইরাসের সংক্রমণের তথ্য জানানোর তিন দিনের মাথায় সিঙ্গাপুর, হংকং ও তাইওয়ান সীমান্তে স্ক্রিনিং জোরদার করে। এক ধাপ এগিয়ে তাইওয়ান উহান থেকে আসা বিমানযাত্রীদের বিমানেই পরীক্ষা শুরু করে দেয়। পরে বিজ্ঞানীরা জানান, দৃশ্যমান উপসর্গ না দেখা গেলেও সংক্রমিত ব্যক্তির মাধ্যমেও করোনা ছড়াতে পারে। ফলে টেস্ট খুবই জরুরি।

দক্ষিণ এশিয়ার বড় দুই দেশে ভারত-পাকিস্তানে করোনা বিস্তৃত হল্ওে শ্রীলঙ্কা ও আফগানিস্তানে মৃত্য এখনও বেশ কম। অন্যদিকে নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ খুবই কম।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ইউরোপের বেশিরভাগ দেশে লকডাউন চললেও ব্যতিক্রম শুধু সুইডেন। এই দেশটিতে জীবনযাত্রা চলছে স্বাভাবিকভাবেই। কঠোর নিয়ম-কানুন না করে করোনাভাইরাস রোধে দেশটিতে দেওয়া হচ্ছে নানা নির্দেশনা। বলা হয়েছে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে। সুইডেনের মানুষ এসব নির্দেশনা মেনেই স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে ।

সুইডেনের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ আশা করছে, কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ না করেও এ ভাইরাসের বিস্তার রোধ করা যাবে। কঠোর নিয়ম না করেও দেশটিতে কিছু নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। যেমন-অসুস্থ বা বয়স্ক হলে ঘরে থাকা, কিছুক্ষণ পরপর হাত ধোয়া, অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ না করা, বাড়িতে বসে কাজ করা। দেশটির বেশিরভাগ মানুষ এসব নির্দেশনা পালন করছেন। সুইডেনে সরকারি কর্তৃপক্ষের ওপর মানুষের আস্থাও অনেক বেশি।
সুইডেনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য এ ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। দেশটির বেশিরভাগ বাড়িতেই একজন বাসিন্দা বাস করেন। এর ফলে পরিবারেও ভাইরাস ছড়ানোর সম্ভাবনা কম। তা ছাড়া নাগরিকদের বেশিরভাগই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। সুতরাং তাদের মধ্যে ব্যাপক হারে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাও কম।