১৯২৩ সালে সম্পাদিত লুজান চুক্তির মাধ্যমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর ব্রিটেনের নেতৃত্বে মিত্র শক্তিগুলো তুরস্কের সামগ্রিক উন্নতি রোধ করার জন্য বিবিধ নিষেধাজ্ঞা আরোপের সঙ্গে সঙ্গে তুরস্কের পরিচয়ও বদলে দেয় । মিত্রশক্তি হচ্ছে- সার্বিয়া, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য (ইংরেজ), ফ্রান্স, জাপান, ইতালি, রুমানিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। হেরেছিল কেন্দ্রীয় শক্তি। এরা হচ্ছে- ওসমানি সাম্রাজ্য, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, জার্মানি ও বুলগেরিয়া। তৎকালীন বিশ্বে অন্যতম পরাশক্তি ওসমানী সাম্রাজ্যের উৎখাতের ব্যাবস্থা করা হয় এই চুক্তিতে এবং পরবর্তী ১০০ বছরেও যেন তুর্কিরা নিজেদের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করার কোনো প্রচেষ্টা করতে না পারে তা সুনিশ্চিত করা হয়। ১৯২৩ সালে সম্পাদিত চুক্তির মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে ২০২৩ সালে। তুরস্ক মুক্তি পেতে যাচ্ছে অনেক বিধি নিষেধ এবং নিষেধাজ্ঞার হাত থেকে, তারপরে কেমন হবে তুরস্কের ভবিষ্যৎ?
ওসমানিদের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকে লুজানের চুক্তি। এটি ১৯২৩ সালে স্বাক্ষরিত হয়। এর মূল ক্রীড়নক ছিল বৃটেন। এ চুক্তিকে ‘শতাব্দী চুক্তি’ বলা হয়। চুক্তির মূল পয়েন্ট পাঁচটি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির কাছে পরাজয়ের পর ইউরোপের বহুকালের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ওসমানী সাম্রাজ্যের উৎখাতের সুবর্ণ সুযোগ আসে সুইজারল্যান্ডের লুজান শহরে ১৯২৩ সালে সম্পাদিত হওয়া চুক্তিতে । তারা তুরস্কের ওপর ইচ্ছা মত এমন অনেক শর্ত চাপিয়ে দেয় যা সুনিশ্চিত করে যে তুরস্ক একশো বছরের মধ্যে তাদের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হবেনা, এই চুক্তিই এককভাবে তুরস্ককে ইউরোপের পঙ্গু রাষ্ট্রে পরিণত করে।
ওসমানী সাম্রাজ্যের পরিসমাপ্তি ও বিভাজন : ওসমানী সম্প্রদায়ের সব উত্তরাধিকাদেরকে নির্বাসিত করা হয়, কাউকে গুপ্ত হত্যা করা হয়, অনেককে গুম করা হয়। তাদের সম্পদ বাজয়াপ্ত করা হয়। এই ভাবে খিলাফতের শেষ চিহ্ন পর্যন্ত মুছে ফেলা হয় তুরস্ক থেকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ওসমানী সাম্রাজ্যের বিভাজন এবং নতুন অনেক রাষ্ট্রের আবির্ভাব হয় । ১৫২১ খ্রিস্টাব্দে ওসমানী সালতানাতের আয়তন সর্বোচ্চ হয়, এ সময় তার আয়তন ছিল ৩৪ লক্ষ বর্গ কিমির বেশি। বিভিন্ন সময় কম বেশি হওয়া সাম্রাজ্যের গড় আয়তন ছিল ১৮ লক্ষ বর্গোকিমি। বর্তমান তুরস্কের আয়তন মাত্র ৭ লক্ষ ৮৩ হাজার বর্গ কিমি। বিশ্বখ্যাত অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতনের পর এর থেকে অন্তত ৪০টি নতুন রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়।
সেক্যুলার রাষ্ট্র: কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে তুরস্কে প্রতিষ্ঠিত হয় ইউরোপ আমেরিকার অধীনে ইসলাম বিরোধী সেক্যুলার রাষ্ট্র বা ধর্ম নিরেপেক্ষ রাষ্ট্র। নিষিদ্ধ করা হয় আরবী চর্চা, বন্ধ করা হয় হাজারো মাদ্রাসা, মসজিদে আজান নিষিদ্ধ করা হয়, হত্যা করা হয় বহু ইমাম, মুয়াজ্জিন, ইসলামী স্কলার এবং আলেমকে। ওসমানী সাম্রাজ্যে মূলত দুটি ভাষা প্রচলিত ছিল একটি আরবী অপরটির ফারসি। সাম্রাজ্যের বর্ণমালাকে আবজাদ বলা হতো, যা ওসমানী সাম্রাজ্যের ভাষা বলে পরিচিত ছিল। তাদের রাষ্ট্রীয় ভাষার পরিবর্তন ঘটিয়ে প্রচলন করা হয় ল্যাটিন ভাষা। এই ভাবে রাতারাতি একটি জাতিকে ফেলে দেয়া হয় অক্ষরজ্ঞানহীন, পরিচয়হীন একটি অন্ধকার কুপে।
প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান এবং আহরণের ওপর নিষেধাজ্ঞা : ১৯২৩ সালে সম্পাদিত হওয়া চুক্তিতে চুক্তির পরবর্তী একশো বছর তুরস্ক নিজেদের ভূমিতে বা বাইরে কোনো দেশে প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান এবং আহরণ করতে পারবে না। বর্তমান বিশ্বে অনেক দেশের অর্থনীতি শুধুমাত্র তেলের ওপর নির্ভরশীল সেখানে তুরস্ককে তেল উত্তোলন করা থেকে সম্পূর্ণ বিরত রাখা হয় ফলে তুরস্ক নিজেদের প্রয়োজনে সব রকম জ্বালানি আমদানি করে বাইরের দেশ থেকে যা তাদের অর্থনৈতিক উন্নতিতে প্রধান অন্তরক।
বসফোরাস প্রণালীর আন্তর্জাতিকরণ : তুরস্কের অর্থনীতির ওপর আরো একটি বৃহৎ ধাক্কা দেয়া হয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক পথ বসফরাসের ওপর তুরস্কের নিয়ন্ত্রণ শেষ করে দেয়ার মাধ্যমে। কৃষ্ণ সাগর এবং ভূমধ্যসাগরের মাঝে সংযোগস্থাপনকারি এই প্রণালীটি এশিয়া এবং ইউরোপের মধ্যেকার বাণিজ্যের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা। প্রতিদিন তুরস্কের বুকের ওপর থেকে হাজারো জাহাজ পার হলেও তুরস্ক তাদের থেকে এক টাকাও সংগ্রহ করতে পারেনা।
মক্কা ও মদিনার নিয়ন্ত্রণ তাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়া : ৪০০ বছর মক্কা এবং মদিনাকে নিয়ন্ত্রণ করা তুর্কি সুলতানরা নিজেদেরকে দুই পবিত্র মসজিদের খাদেম বলে অভিহিত করতে গর্ববোধ করতো। ওসমানী সাম্রাজ্য থেকে পৃথক হওয়ার পর ১৯৩২ সালে আমেরিকার মদদপুষ্ট সাউদ গোষ্ঠী সৌদি আরবের মসনদে বসার পর মক্কা ও মদিনার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। তুরস্কের বাসিন্দারা আজও হজ এবং ওমরাহ করার সময় মক্কা মদিনায় কেঁদে কেঁদে দোআ করে যে, “ইয়া আল্লাহ, আমাদের ক্ষমা করো, আমাদের ওপর তোমার অসন্তুষ্টি শেষ করো, আমাদেরকে আবার মক্কা মদিনার খাদেমের মর্যাদা ফিরিয়ে দাও।” তুর্কিরা হজের সময় নিজেদের সঙ্গে এক ধরনের মানচিত্র নিয়ে আসে যাতে মক্কা মদিনার পূর্বের সব পবিত্র স্থাপনার বর্ণনা আছে যার মধ্যে অনেক স্থাপনা সৌদি সরকার মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। তারা নাম নিয়ে নিয়ে সেই সব জায়গায় সাহাবীদের কবর জিয়ারত করে।
২০২৩ পর: তুরস্ক হয়তো আবারো ফেরাতে পারবেনা ওসমানী সেই সোনালী দিন গুলো তবে তারা যে আস্তে আস্তে সেই দিকেই যাবে তা এক প্রকার নিশ্চিত। তুরস্ক সেই উদ্দেশ্যেই তাদের জনগন সহ সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে ওসমানিয়ার সাম্রাজ্যের গৌরবময় দিনগুলো সম্পর্কে ড্রামা সিরিজ, চলচ্চিত্র ইত্যাদি তৈরির মাধ্যমে অবহিত করছে।
তুরস্কের বর্তমান অর্থনীতি খুব একটা বৃহৎ আয়তনের নয়। ২০১৯ সালের হিসেব অনুযায়ী তাদের জিডিপি হলো ৭৪৩ বিলিয়ান ডলার যা বিশ্বে ১৯তম । কিন্তু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রবল সম্ভাবনাময় দেশ তুরস্ক লুযান চুক্তির পর যে অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক অগ্রগতি করবে তা বোঝার জন্য অর্থনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন নেই।
ইতি মধ্যে তারা গ্রিসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভূমধ্যসাগরে তেলের অনুসন্ধান শুরু করেছে। নিজেদের দেশের প্রয়োজনের একটা বড়ো অংশ তারা নিজেদের উত্তোলিত তেল থেকে পূরণ করতে পারলে তাদের বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি অনেক কমবে এবং তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যা ২০১৯ সালের হিসেব অনুসারে ছিল ১ শতাংশেরও কম তা অনেক বৃদ্ধি পাবে। তারা নিশ্চিতভাবেই বসফরাসের ওপর নিজেদের অধিকার কায়েমের চেষ্টা করবে এবং এতে বাধা এলেও তারা সফল হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। আমেরিকা যে তাতে বাধা দেবে তা ভেবেই তারা এখন থেকে চীন রাশিয়া ইরান পাকিস্তানের সঙ্গে মজবুত কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে।
তুরস্ক এরদোয়ানের আমলে আতাতুর্কের প্রতিষ্ঠিত মুসলিম বিদ্বেষী সেক্যুলার ছবি থেকে বেরিয়ে এসেছে এবং মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বদান করার ক্ষেত্রে সবার থেকে এগিয়ে আছে। সব মিলিয়ে দেখতে গেলে তুরস্কের ভবিষ্যৎ যে খুব উজ্জ্বল তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। সব ঠিক ঠাক থাকলে তারা নব বিশ্ব শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে কয়েক বৎসরের মধ্যে এবং এটি নিঃসন্দেহে মুসলিম বিশ্বের জন্য আবার সুখের দিনের বার্তা বহন করে আনবে। ৩ বছর পর ২০২৩ সাল। মানে ১০০ বছরের চুক্তি শেষ হতে চলেছে। এরপর কী হবে? তুর্কি কী করবে?