স্বাস্থ্যকর শহর হওয়ার মানদণ্ড এবং আমাদের করনীয়

0
497

স্বাস্থ্যকর শহর হওয়ার মানদণ্ড এবং আমাদের করনীয়

বিশ্বের পরিবেশবিষয়ক নেতিবাচকের তালিকায় রয়েছে রাজধানী ঢাকা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও পরিবেশবিষয়ক সংস্থা ইপিএর মতে, যে কোন শহরের বায়ুর মানের সূচক ২০০-এর বেশি হলে তাকে খুবই অস্বাস্থ্যকর বলা হয়। যারফলে ঢাকার দূষণ নিয়েও কথা হয় নানা সময়ে। সোয়া কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তরপাশ থেকে শুরু করে উত্তরার উত্তরপাশ বা টঙ্গী খাল পর্যন্ত বিস্তৃত প্রায় ৩৬০ বর্গকিলোমিটারের এই শহরটির জনঘণত্ব রেকর্ড পরিমাণ।

এছাড়াও চট্টগ্রাম বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। আশি লক্ষ লোক সংখ্যার শহর, আয়তন ১৬০.৯৯ বর্গ কিমি। উত্তরে হাটহাজারী ও রাউজান, দক্ষিণে আনোয়ারা, পূর্বে রাউজান ও পটিয়া, পশ্চিমে সীতাকুণ্ড ও বঙ্গপোসাগর। কাগজে কলমে বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবেও পরিচিত। সর্ববৃহৎ বন্দর থাকার কারনে ঢাকার পর বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ শহর হচ্ছে চট্টগ্রাম। এটি এশিয়ায় ৭ম এবং বিশ্বের ১০ম দ্রুততম ক্রমবর্ধমান শহর। এই শহরটিগুলিকেও স্বাস্থ্য ও পরিবেশের মানদণ্ডের আদর্শে পরিণত করার যথেষ্ঠ সুযোগ আছে । বিশেষজ্ঞদের মতে, ঘনবসতিপূর্ণ স্বাস্থ্য সম্মত শহর হিসেবে গড়ে তুলতে দরকার বাস্তব সম্মত সমন্বিত মহাপরিকল্পনা এবং এর সঠিক বাস্তবায়ন।

সবক্ষেত্রেই দূষণ বাংলাদেশের মানুষের কাছে নতুন কোন বিষয় না হলেও পরিস্থিতি এখন সঙ্কটে রূপ নিয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন । তাঁদের মতে, ঢাকা-চট্টগ্রামের বায়ু এবং শব্দ দূষণ অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে।সার্দান ইউনির্ভাসিটি সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষনা প্রতিষ্ঠান থেকে সে চিত্রটি বার বার ফুটে উঠেছে । বাস্তব সম্মত সমন্বিত পরিকল্পনা এবং তার প্রয়োগের অভাবে দূষণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইটে গিয়ে জানা যায় যে, বর্তমানে বিশ্বের হাজারো শহর সংস্থাটির স্বাস্থ্যসম্মত শহর নেটওয়ার্কের আওতাভুক্ত। এই নেটওয়ার্কের আওতায় শহরগুলোর মেয়র এবং মিউনিসিপালিটি শহরের মানুষের জীবনযাত্রা উন্নয়নে নেতৃত্ব দিচ্ছে। আমাদের শহরগুলোর মেয়রের পক্ষেও সম্ভব । প্রয়েজন শুধু সাহসের সাথে আন্তরিকতা ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এতো বিশাল সংখ্যক মানুষের বাস যে শহরগুলিতে সেটিকে স্বাস্থ্যসম্মত করে গড়ে তুলতে হলে সম্বন্বিত মহা-পরিকল্পনা ছাড়া সম্ভব নয় । যা হবে প্রতিকারমূলক ও প্রতিষেধকমূলক ব্যবস্থা । বিশেষজ্ঞরা এই শহরগুলি অন্যান্য শহরের মত স্বাস্থ্যসম্মত শহরে পরিণত করার জন্য অন্তত কিছু সমস্যা সমাধাণের উপর জোর দিচ্ছেন:
বায়ু দূষণ: বিশ্বজুড়ে মানুষের মৃত্যু ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরির অন্যতম কারণ বায়ুদূষণ৷ দূষিত বাতাসের কারণে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হয়। যারফলে হৃদযন্ত্রের অসুখ, শ্বাসকষ্টজনিত জটিল সমস্যা, ফুসফুস সংক্রমণ ও ক্যানসারের মতো রোগে ভুগছে মানুষ৷দূষিত বায়ুর কারনে ঢাকার বাতাসকে অত্যন্ত দূষিত বলে ধরা হয়। বিশ্বব্যাপী বায়ুদূষণ নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার ২০১৯’ (এসওজিএ)-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে বায়ুদূষণে। বিশ্বে বায়ুদূষণে মৃত্যুতে বাংলাদেশ পঞ্চম। পৃথিবীর অন্য দেশগুলো তাদের বড় শহরগুলোর বায়ুদূষণ রোধে পদক্ষেপ নিয়েই চলেছে, সেখানে আমরা ব্যর্থ। যে কারণে বায়ুদূষণ পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন নগরবাসী। প্রথমত, পুরনো যানবাহনের প্রাধান্য । দ্বিতীয়ত, সমন্বয়হীন অপরিকল্পিতভাবে যখন-তখন রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও উন্নয়ন কাজ। তৃতীয়ত, শহরের আশপাশের ইটভাটা ও শিল্প-কলকারখানার দূষণ। চতুর্থত, শহরের ভেতরে যে ময়লা আবর্জনা জমে তার কারনে ।
পানি দূষণ: বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাব যদিও আগের তুলনায় এখন কম । তবে এখনো বিশুদ্ধ খাবার পানির পর্যাপ্ত সরবরাহ নাই। শহরের চারদিকের যে পানির উৎস রয়েছে সেগুলো একদিকে যেমন দূষিত অন্যদিকে এই জলাশয়গুলো নানা ধরণের রোগ-বালাই ছড়িয়ে পড়ে বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। যার মধ্যে পানিবাহিত নানা রোগ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মশা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগের বিস্তার। তবে এগুলি নিয়ন্ত্রণযোগ্য বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।তাঁরা বলেন,মশার বিস্তার কমাতে হলে আশপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। আর্ষেনিক মুক্ত পানি এবং শহরের যেখানে ওয়াশার পানি নাই সেখানে ব্যবস্থা করা ।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: দূষণের সব থেকে বড় উৎস বর্জ্য, আর এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন করতে পারেনি দুই সিটি করপোরেশন। আবার শহরের মধ্যে উন্নয়নকাজের ফলে সৃষ্ট দূষণ নিয়ন্ত্রণও ঠিকমতো করতে পারেনি দুই সিটি করপোরেশন।বর্জ্য অপসারণ ও সংগ্রহের ব্যবস্থা অনেক পুরনো। যারা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করেন তাদের যেমন স্বাস্থ্য সুরক্ষার কোন ব্যবস্থা নেই, ঠিক তেমনি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা হয় যত্রতত্র। পচনশীল, কঠিন কিংবা নবায়নযোগ্য বর্জ্য আলাদাভাবে ব্যবস্থাপনার নিয়ম থাকলেও তা মানা হয় না।
সবুজ পরিবেশ: শরীরর্চর্চা বা হাঁটার জন্য সবুজ পরিবেশ উদ্দ্যান , ফুটপাত থাকার নিয়ম থাকলেও এর ব্যবস্থা খুবই কম। একটি স্বাস্থ্যকর শহর হওয়ার জন্য যা অন্যতম মানদণ্ড।
ভেজাল মুক্ত খাবার: খাদ্যশৃঙ্খলে ক্ষতিকর পদার্থ ও ভেজালের কারনে স্বাস্থ্য সুরক্ষা হয় না।ভোক্তাদের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দেশে ট্রান্স ফ্যাট বিশ্লেষণ করতে সক্ষম কোনও ল্যাব সুবিধা নেই, খাদ্যপণ্য ট্র্যাক করার কোনও শনাক্তকরণের ব্যবস্থা নেই, সালমনেলা, লিস্টারিয়া এবং ই-কোলাইয়ের মতো জীবাণুগুলোকে পানি ও খাদ্যে প্রবেশ রোধ করার কোনও কার্যকর ব্যবস্থা নেই।দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য, ডিম এবং ভোজ্যতেলে ট্রেসেবিলিটিটি নিশ্চিতকরণ ভোক্তাদের খাদ্যজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকে বাঁচানোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এর মতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অনেক শিশুসহ সারাবিশ্বে খাদ্যজনিত রোগে বছরে প্রায় ২০ লাখ মানুষ মারা যায়।এফএও জানায়, বছরে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে ১৫ লাখেরও বেশি খাদ্যে দূষণজনিত রোগে আক্রান্ত হয় এবং এতে ১,৭৫,০০০ মানুষের মৃত্যু হয়।নিরাপদ খাদ্যের জন্য প্রকৃত খাদ্য লেবেলিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং লেবেলে প্রক্রিয়াজাত খাবারের অতিরিক্ত শর্করা, ট্রান্স ফ্যাট ইত্যাদি সম্পর্কে গ্রাহকদের অবহিত করা উচিত।
শব্দ দূষণ: বাংলাদেশে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে নানা ধরণের নীতিমালা থাকলেও সেগুলোর প্রয়োগ নেই বলে জানান পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা ।পশু-পাখি ছাড়াও এরফলে মানুষ অসুস্থ হচ্ছে এবং শ্রবণশক্তি হ্রাস পাচ্ছে । ডাব্লিউএইচও-এর মতে, স্বাস্থ্যসম্মত শহর শুধু একটি শহরের স্বাস্থ্যসেবার কাঠামোর উপর নির্ভর করে না। বরং শহরটির পরিবেশের উন্নয়নের অঙ্গীকার এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের আগ্রহের উপরও নির্ভর করে। স্বাস্থ্যসম্মত শহরের এই ধারণা স্বাস্থ্য ও সেবার সমতা নিশ্চিতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং অংশগ্রহণমূলক শাসনের অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে। আমাদের সেবার অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাথে সাথে সেবার মানষিকতারও উন্নয়ন দরকার ।
আমাদেরকে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও আইনিভাবে বায়ুদূষণ প্রতিকার ও প্রতিরোধ করতে হলে বায়ুদূষণের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে এবং অন্যদেরও এব্যাপারে সচেতন করতে হবে। যানবাহনে ক্যাটালাইটিক কনভার্টর ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। ডিজেলের পরিবর্তে সিএনজি গ্যাসের বা বৈদ্যুতিক গাড়ীর ব্যবহার বৃদ্ধি ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। টোকেন দিয়ে গাড়ী চালানো বন্ধ করতে হবে। ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার কমিয়ে গণপরিবহন ব্যবহারের প্রতি সবাইকে আগ্রহী করতে হবে। সাইকেল ব্যবহারে উৎসাহ দিতে হবে। বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। শিশু স্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি এই বায়ুদূষণ এবং এ থেকে সৃষ্ট স্বাস্থ্য জটিলতা থেকে রক্ষা পেতে আমাদের পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণ করতে হবে। প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও সামাজিক মিডিয়ায় শিক্ষামূলক প্রচারণা চালাতে হবে। একই সঙ্গে প্রশাসনিক ব্যবস্থার সফল প্রয়োগ একান্তভাবে প্রয়োজন এবং প্রশাসনকেও দায়বদ্বতার মধ্যে আনতে হবে । তবেই আমরা পরিবেশ ধুষন সমস্যার সমাধানের দিকে এগিয়ে যেতে পারবো।
যানজটের সামগ্রিক সমস্যার সমাধান শুধুমাত্র নগর পরিকল্পনা বা যানবাহন প্রকৌশলের মাধ্যমে সম্ভব নয়। কারণ যানজট শুধু রাস্তার সমস্যা নয়, এইটি আমাদের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা, প্রশাসনিক অদক্ষতা এবং নাগরিক অসদাচরণও দায়ী। রাজনৈতিক সরকার, সড়ক প্রকৌশলী, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, সুশীল সমাজ এবং গণমাধ্যম এই সকলেরই কাজের ধরন ভিন্ন, কিন্তু লক্ষ্য এক । তাই যানজট সমস্যার একটি দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের লক্ষ্যে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে ।
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় পাঁচ কোটি লোক নগরে বসবাস করে। ২০৩০ সালে নগরবাসীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে আট কোটির ওপর। নগরায়ণকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। আগামীর বাংলাদেশ হবে নগরীয় বাংলাদেশ । তাই পরিকল্পিত ও পরিবেশবান্ধব নগরায়ণ ছাড়া পরিবেশদূষণের মতো ভয়াবহ অবস্থা থেকে আমরা পরিত্রাণ পাব না। শুধু সরকারি পদক্ষেপে পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব নয়। পরিবেশ রক্ষায় সর্বমহলের সচেতনতাও প্রয়োজন।
বর্তমান অন্ধকারময় পরিস্থিতিতে অতীতকে ফেরানো সম্ভব নয় ঠিকই, তবে স্বাস্থ্যকর শহর হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সমন্বিত কর্মসূচির লক্ষ্যে সরকারি সংস্থার পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবক প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় একসঙ্গে কাজ করতে পারে । স্বাস্থ্যকর শহর এমন একটি শহর,যা কাঠামোগত ও সামাজিকভাবে উন্নত পরিবেশ তৈরি করবে। তার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদইচ্ছা এবং জবাবদিহিতা। প্রশাষনও আইনের উর্ধ্যে নয়, মহা-পরিকল্পনা বাহিরে গেলেই জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে । তবেই স্বাস্থ্যকর শহর হওয়ার মানদন্ডে বিশ্বের পরিবেশবিষয়ক নেতিবাচকের তালিকায থেকে ইতিবাচকের তালিকায় স্থান পাবে বাংলাদেশ । বিশ্ব পরিবেশ দিবসে এই হোক আমদের অঙ্গীকার ।
লেখক :-সরওয়ার জাহান প্রতিষ্ঠাতা, সাদার্ন ইউনিভার্সিটি ও টেকসই উন্নয়নকর্মী