দেশে ইসলামি ধারার ব্যাংক, কেন বাড়ছে এর জনপ্রিয়তা

0
352

দেশে ইসলামি ধারার ব্যাংক, কেন বাড়ছে এর জনপ্রিয়তা

ইসলামী চিন্তাধারায় বিশ্বাসী হওয়ায় অনেকে ইসলামি ব্যাংকে লেনদেন করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। দেশে এখন ১০টা ইসলামি ধারার ব্যাংক রয়েছে। প্রচলিত ধারা এবং ইসলামি ধারার ব্যাংক ব্যবস্থার মূল পার্থক্য সুদ এবং মুনাফার ক্ষেত্রে। ইসলামি ধারার ব্যাংকিং এ বলা হয় ‘প্রফিট- লস-শেয়ারিং’ অর্থাৎ ব্যাংক যেহেতু গ্রাহকের কাছ থেকে আমানত রাখছে, ব্যাংকের যদি লাভ হয় তাহলে আমানতের উপর গ্রাহক লভ্যাংশ পেতে পারে। কিন্তু ব্যাংকের যদি ক্ষতি হয় তাহলে গ্রাহক লভ্যাংশ পাওয়ার জন্য যোগ্য হবে না।

এটাই প্রচলিত এবং ইসলামি ব্যাংকের মধ্যে মূল পার্থক্য। এক্ষেত্রে আগে থেকেই গ্রাহককে প্রচলিত ব্যাংকের মত লিখিত কোন কাগজে লিখে দেবে না যে কত শতাংশ মুনাফা সে পাবে।কিন্তু ইসলামি ব্যাংকের ক্ষেত্রে মৌখিকভাবে মুনাফার একটা শতাংশের কথা জানিয়ে দেয়া হয়।

ইসলামি ধারার ব্যাংকিংএ কয়েকটি দিক রয়েছে। যেমন: মুদারাবা কনসেপ্ট- মুনাফার অংশীদারিত্ব, মুরাবাহা- লাভে বিক্রি (লোনের ক্ষেত্রে), এবং মুসারাকা- লাভ । বাংলাদেশে যে ১০টা ইসলামি ব্যাংক রয়েছে তাদের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে ব্যাংকগুলো পরিচালিত হচ্ছে শরিয়া অনুযায়ী এবং তাদের কার্যক্রম জনকল্যাণমুখী।

অনেক গ্রাহক বলেন, “সারা জীবন বেঁচে থাকবো না। তাই ইসলামের পথেই চলতে চাই। ইসলামি ব্যাংকে সুযোগ-সুবিধা ভালো। অন্য ব্যাংকের মত সুদ নেই। এখানে টাকা খাটালে তারা কিছুটা লাভ দেয় তারপর বলে যে পরে আবার লাভ হলে আবার দেবে।

বাংলাদেশের সব ইসলামি ব্যাংক পর্যবেক্ষণের জন্য রয়েছে কেন্দ্রীয় শরিয়া বোর্ড। এই বোর্ডের সদস্য ড.শমসের আলী বলছেন সাধরাণভাবে বলতে গেলে ইসলামি ব্যাংকে বিনিয়োগ করা এবং সেখানে থেকে লভ্যাংশ পাওয়ার ক্ষেত্রে কোন অস্পষ্টতা নেই।কিন্তু তার ভাষায় কিছু ‘গ্রে এরিয়া’ রয়েছে যেগুলো স্পষ্ট করার জন্য কাজ চলছে।তিনি বলেন, “অনেকে জানতে চায় ইসলামি এলসি এবং নন-ইসলামিক এলসির মধ্যে তফাত কী? এই রকম কতগুলো গ্রে এরিয়া আছে যেখানে গবেষণা করা দরকার। মানুষের টাকা খাটানো এবং সেটা ইনভেস্ট করে যে লাভটা হয় সে লাভটা তাকে দেয়া সেখানে কিছু অস্পষ্টতা নেই। কিন্তু অন্যান্য ব্যবসায়িক লেনদেনের মধ্যে যে অস্পষ্টতা আছে সেগুলোর জন্য রিসার্চ করা দরকার।” “মধ্যপ্রাচ্যের অনেক ব্যাংক এগুলো করছে (ইসলামি ব্যাংকিং) ওয়েস্টার্ন কান্ট্রিতে যারা করছে তাদের অভিজ্ঞতা কী, মাঝে মাঝে বন্ড ছাড়া হয় সেগুলো কীভাবে অপারেট করা হবে সেটা নিয়ে মাঝে মাঝে সেমিনার করা হয়। অনেক এরিয়া আছে যেগুলো আমি বলবো না সব কভার করা হচ্ছে কিন্তু প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।”

বাংলাদেশে ব্যাংক, কোম্পানি পরিচালনার জন্য ১৯৯১ সালে ব্যাংক-কোম্পানি আইন করা হয়। এই আইনের মধ্যে শরিয়ার রেফারেন্স দেয়া হয়েছে বিভিন্ন ধারায়। কিন্তু দেশে ইসলামি ব্যাংক আইন- নামে কোন আইন নেই। দেশের পুঁজি বাজারে ইসলামি ব্যাংক কীভাবে অংশে নেবে এবং ইসলামি সুকুক বন্ড সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন সার্কুলারে বলা আছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক -বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে ২০০৯ সালে তারা একটা গাইডলাইন তৈরি করেছে সেখান থেকে রেফারেন্স নিয়ে ইসলামি ব্যাংক পরিচালনা করা যায়। বাংলাদেশে ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এবং মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের একটা ইসলামিক ব্যাংক উইন্ডো ইউনিট রয়েছে। তারা ইসলামিক ব্যাংকের কার্যক্রম দেখভাল করে।মি. ইসলাম মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের যে গাইডলাইন রয়েছে তার পরে আর নতুন করে ইসলামি আইন করার দরকার নেই।

তিনি বলেন, “ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য যে নির্দেশনা আছে সে নির্দেশনা অনুযায়ী তারা কাজ করছে কিনা সেটা দেখভাল করার জন্য আমাদের আলাদা ইউনিট আছে -সেটাকে আমরা ইসলামিক ব্যাংক উইন্ডো ইউনিট বলি। ২০০৯ সালে যে গাইডলাইন দেয়া হয়েছিল সে অনুযায়ী ইউনিট দেখভাল করে -সেটাই একটা আইনের মতো। শরিয়া বোর্ড এবং ইসলামি গাইড লাইন থেকে ব্যাংকগুলো তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারে।”

ব্যাংকগুলোর নীতি নির্ধারণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ব্যাংকিং রেগুলেশন এন্ড পলিসি ডিপার্টমেন্ট’ রয়েছে। এই ডিপার্টমেন্টের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন ইসলামি ব্যাংকগুলোর জন্য গাইডলাইন থাকলেও সেটা সংসদে পাশ হওয়া কোন আইন নয়। তিনি বলেন ইসলামি ব্যাংকগুলো, কিছুটা শরিয়া এবং কিছুটা গাইডলাইন থেকে নিয়ম-নীতি নিয়ে মিশ্রভাবে ব্যাংক পরিচালনা করছে।

অনেকে মনে করেন ইসলামি ব্যাংকগুলোর জন্য একটা কার্যকরী আইন দরকার, যাতে করে কোন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হলে সেই আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া যায়। “ইসলামি ব্যাংকগুলোর জন্য বিভিন্ন নীতিমালা আছে, কিন্তু যেটা দরকার সেটা হল-আইন। যদি কোন ধরনের সমস্যা হয় কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হয় তখন কোন আইনের অধীনে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে? যদি সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের নির্দেশ না থাকে তাহলে সেখানে একটা সমস্যা হবে। যারা গ্রাহক তারা একটা আস্থার ভিত্তিতে যাচ্ছে, প্রচলিত ব্যাংকের চেয়ে এই ব্যাংকে তারা বেশি আস্থা পাচ্ছে বলেই তারা যাচ্ছে। কিন্তু আসলে সেটার যদি শক্ত আইনগত ভিত্তি না থাকে তাহলে তো কোন সমস্যা হলে গ্রাহকরাই সমস্যায় পড়ে যাবে।” তবে “এই-নীতির ভিতরের বিষয়গুলো আরো বোঝার ব্যাপার রয়েছে। মানুষের সেন্টিমেন্টকে ব্যবহার করে যদি কাজ করা হয় তাহলে তো সততার মাধ্যমে কাজ করা হল ন।”

কেন জনপ্রিয় হচ্ছে: বাংলাদেশে সম্প্রতি প্রচলিত ধারার বেশ কিছু ব্যাংকে ইসলামি ধারার ব্যাংকের একটি ‘উইণ্ডো’ বা শাখা খোলা হয়েছে। এছাড়া আরো একটি প্রচলিত ব্যাংক পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ধারায় ব্যাংকিং শুরু করতে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন দিনকে দিন বাড়ছে ইসলামি ব্যাংকের জনপ্রিয়তা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং এন্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের শিক্ষক সাদিয়া নুর খান বলছেন, বাংলাদেশের মানুষের ক্ষেত্রে ধর্মীয় আবেগটা বেশি কাজ করে। সুদ হারাম হলেও মুনাফা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য আর এটাই ইসলামি ব্যাংক জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম কারণ।

“বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যেটা হয়েছে সেটা সম্পূর্ণ ইমোশন। যেহেতু ইসলাম ধর্মে বার বার সুদকে হারাম বলা হয়েছে সেহেতু মুসলিমরা চায় কোনভাবেই তারা সুদের কারবারের সাথে জড়িত হবে না। এটাই প্রধান কারণ বাংলাদেশের মানুষের ইসলামি ব্যাংকিং এর দিকে ঝোঁকার।”

“মানুষের মধ্যে যেহেতু ব্যাংকিং-এর শিক্ষা খুব বেশি নেই, সুদ এবং মুনাফার পার্থক্য কিংবা যারা বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকিং করছে তারা কতটুকু ইসলামি ব্যাংকিং করছে কিংবা এই ব্যাংকিংটা আসলেই সেই ব্যাংকিং কিনা যেটা ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে – এসব ধারণা বিরাট সংখ্যক সাধারণ মানুষের মধ্যে নেই। মানুষের যেহেতু এখানে সচেতনতার অভাব আছে, ইসলামি ব্যাংকিং দেখলেই তারা মনে করছে এটাই সঠিক জায়গা। তারা মনে করছে এখানে যদি তারা লেনদেন করে তাহলে ঈমান ঠিক থাকবে। এই বিষয়গুলো থেকেই মানুষ ইসলামি ব্যাংকগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে ।